গীতবিতান - স্বদেশ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সূচীপত্র

১ :: আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি

     আমার   সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন   তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
  ও মা,   ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
                             মরি হায়, হায় রে—
ও মা,   অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে   আমি   কী দেখেছি মধুর হাসি॥

            কী শোভা, কী ছায়া গো,   কী স্নেহ, কী মায়া গো—
            কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে,   নদীর কূলে কূলে।
    মা, তোর   মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
                             মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর   বদনখানি মলিন হলে,   ও মা,   আমি নয়নজলে ভাসি॥

            তোমার এই    খেলাঘরে   শিশুকাল   কাটিল রে,
            তোমারি   ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
    তুই   দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
                             মরি হায়, হায় রে—
তখন  খেলাধুলা সকল ফেলে,   ও মা,   তোমার কোলে ছুটে আসি॥

            ধেনু-চরা তোমার মাঠে,   পারে যাবার খেয়াঘাটে,
            সারা দিন    পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
    তোমার    ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
                             মরি হায়, হায় রে—
ও মা,   আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥

            ও মা, তোর   চরণেতে   দিলেম এই   মাথা পেতে—
            দে গো তোর   পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
   ও মা,   গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
                             মরি হায়, হায় রে—
আমি   পরের ঘরে কিনব না আর,   মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি॥

২ :: ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা

ও আমার       দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে         বিশ্বময়ীর,   তোমাতে   বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা॥
তুমি               মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি               মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই     শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা॥
ওগো মা,        তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।
                     তোমার ’পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি               অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি               শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে          সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা॥
ও মা,             অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা—
তবু                 জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!
আমার            জনম গেল বৃথা কাজে,
আমি              কাটানু দিন ঘরের মাঝে—
তুমি               বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা॥

৩ :: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে

যদি তোর   ডাক শুনে কেউ না আসে   তবে   একলা চলো রে।
একলা চলো,  একলা চলো,  একলা চলো,  একলা চলো রে॥
যদি      কেউ কথা না কয়,  ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি      সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে  সবাই করে ভয়—
                     তবে  পরান খুলে
ও তুই   মুখ ফুটে তোর মনের কথা  একলা বলো রে॥
যদি      সবাই ফিরে যায়,   ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি      গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
                     তবে  পথের কাঁটা
ও তুই   রক্তমাখা চরণতলে  একলা দলো রে॥
যদি      আলো না ধরে,  ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি      ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে  দুয়ার দেয় ঘরে—
                      তবে    বজ্রানলে
আপন   বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে    একলা জ্বলো রে॥

৪ :: তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে

          তোর   আপন জনে ছাড়বে তোরে,
                তা ব’লে   ভাবনা করা চলবে না।
          ও তোর   আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
                হয়তো রে ফল ফলবে না॥
আসবে পথে আঁধার নেমে,    তাই ব’লেই কি রইবি থেমে—
           ও তুই   বারে বারে জ্বালবি বাতি,
                হয়তো বাতি জ্বলবে না॥
শুনে তোমার মুখের বাণী    আসবে ঘিরে বনের প্রাণী—
           হয়তো তোমার আপন ঘরে
                পাষাণ হিয়া গলবে না।
বদ্ধ দুয়ার দেখলি ব’লে  অমনি কি তুই আসবি চলে—
           তোরে   বারে বারে ঠেলতে হবে,
                 হয়তো দুয়ার টলবে না॥

৫ :: এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে ‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী

     এবার তোর    মরা গাঙে বান এসেছে,   ‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী॥
ওরে রে  ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি,   প্রাণপণে, ভাই, ডাক দে আজি—
     তোরা   সবাই মিলে বৈঠা নে রে,   খুলে ফেল্‌ সব দড়াদড়ি॥
     দিনে দিনে বাড়ল দেনা,  ও ভাই,  করলি নে কেউ বেচা কেনা—
                        হাতে নাই রে কড়া কড়ি।
     ঘাটে বাঁধা দিন গেল রে,   মুখ দেখাবি কেমন ক’রে—
        ওরে,   দে খুলে দে, পাল তুলে দে,  যা হয় হবে বাঁচি মরি॥

৬ :: নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে

নিশিদিন   ভরসা রাখিস,   ওরে মন,   হবেই হবে।
যদি পণ   করে থাকিস   সে পণ তোমার রবেই রবে।
               ওরে মন,  হবেই হবে॥
পাষাণসমান আছে পড়ে,    প্রাণ পেয়ে সে উঠবে ওরে,
         আছে যারা বোবার মতন তারাও কথা কবেই কবে॥
সময় হল, সময় হল— যে যার আপন বোঝা তোলো রে—
         দুঃখ যদি মাথায় ধরিস সে দুঃখ তোর সবেই সবে।
ঘণ্টা যখন উঠবে বেজে   দেখবি সবাই আসবে সেজে—
         এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে॥

৭ :: আমি ভয় করব না ভয় করব না

             আমি ভয়      করব না ভয় করব না।
        দু বেলা     মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না॥
তরীখানা বাইতে গেলে     মাঝে মাঝে তুফান মেলে—
তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে     ধরব না,     কান্নাকাটি ধরব না॥
শক্ত যা তাই সাধতে হবে,      মাথা তুলে রইব ভবে—
সহজ পথে চলব ভেবে     পড়ব না,     পাঁকের ’পরে পড়ব না॥
ধর্ম আমার মাথায় রেখে      চলব সিধে রাস্তা দেখে—
বিপদ যদি এসে পড়ে     সরব না,     ঘরের কোণে সরব না॥

৮ :: আপনি অবশ হলি তবে বল দিবি তুই কারে

        আপনি অবশ হলি, তবে   বল দিবি তুই কারে?
        উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া,  ভেঙে পড়িস না রে॥
করিস নে লাজ, করিস নে ভয়,    আপনাকে তুই করে নে জয়—
        সবাই তখন সাড়া দেবে   ডাক দিবি তুই যারে॥
বাহির যদি হলি পথে    ফিরিস নে আর কোনোমতে,
        থেকে থেকে পিছন-পানে চাস নে বারে বারে।
নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে,   ভয় শুধু তোর নিজের মনে—
        অভয়চরণ শরণ ক’রে   বাহির হয়ে যা রে॥

৯ :: আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে

                      আমরা   মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।
            ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে?।
            প্রাণের মাঝে থেকে থেকে   ‘আয়’ ব’লে ওই ডেকেছে কে,
সেই      গভীর স্বরে উদাস করে—  আর কে কারে ধরে রাখে?।
            যেথায় থাকি যে যেখানে   বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই      প্রাণের টানে টেনে আনে—  সেই   প্রাণের বেদন জানে না কে?।
            মান অপমান গেছে ঘুচে,  নয়নের জল গেছে মুছে—
সেই      নবীন আশে হৃদয় ভাসে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দেখে॥
            কত দিনের সাধনফলে   মিলেছি আজ দলে দলে—
আজ    ঘরের ছেলে সবাই মিলে   দেখা দিয়ে আয় রে মাকে॥

১০ :: আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে

আমরা       সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে—
                  নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
আমরা       যা খুশি তাই করি,   তবু     তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা       নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে—
                  নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
রাজা          সবারে দেন মান,    সে মান   আপনি ফিরে পান,
মোদের       খাটো ক’রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে—
                  নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা        চলব আপন মতে,    শেষে    মিলব তাঁরি পথে,
মোরা          মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে—
                  নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।

১১ :: সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান

                    সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
                    সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়,   আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
                    দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
                    নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,  নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
                    ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
                    নীরব হয়ে, নম্র হয়ে, পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়,   দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়॥

১২ :: নাই নাই ভয় হবে হবে জয় খুলে যাবে এই দ্বার

নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার—
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার॥
খনে খনে তুই হারায়ে আপনা   সুপ্তিনিশীথ করিস যাপনা—
বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার॥
স্থলে জলে তোর আছে আহ্বান, আহ্বান লোকালয়ে—
চিরদিন তুই গাহিবি যে গান সুখে দুখে লাজে ভয়ে।
ফুলপল্লব নদীনির্ঝর   সুরে সুরে তোর মিলাইবে স্বর—
ছন্দে যে তোর স্পন্দিত হবে আলোক অন্ধকার॥

১৩ :: আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন ওগো কর্ণধার

আমাদের   যাত্রা হল শুরু   এখন,  ওগো কর্ণধার।
                       তোমারে   করি নমস্কার।
এখন         বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর—
                       তোমারে   করি নমস্কার॥
আমরা       দিয়ে তোমার জয়ধ্বনি   বিপদ বাধা নাহি গণি
                                      ওগো কর্ণধার।
এখন         মাভৈঃ বলি ভাসাই তরী, দাও গো করি পার—
                        তোমারে   করি নমস্কার॥
এখন         রইল যারা আপন ঘরে   চাব না পথ তাদের তরে
                                      ওগো কর্ণধার।
যখন          তোমার সময় এল কাছে তখন কে বা কার—
                         তোমারে   করি নমস্কার।
মোদের       কেবা আপন, কে বা অপর, কোথায় বাহির, কোথা বা ঘর
                                      ওগো কর্ণধার।
চেয়ে           তোমার মুখে   মনের সুখে  নেব সকল ভার—
                          তোমারে   করি নমস্কার॥
আমরা        নিয়েছি দাঁড়, তুলেছি পাল,   তুমি এখন ধরো গো হাল
                                      ওগো কর্ণধার।
মোদের        মরণ বাঁচন ঢেউয়ের নাচন, ভাবনা কী বা তার—
                          তোমারে   করি নমস্কার।
আমরা        সহায় খুঁজে পরের দ্বারে    ফিরব না আর বারে বারে
                                      ওগো কর্ণধার।
কেবল        তুমিই আছ আমরা আছি   এই জেনেছি সার—
                          তোমারে   করি নমস্কার॥

১৪ :: জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা

জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
         তব শুভ নামে জাগে,   তব শুভ আশিস মাগে,
                   গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
         পূরব পশ্চিম আসে  তব সিংহাসন-পাশে
                   প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
         দারুণ  বিপ্লব-মাঝে  তব শঙ্খধ্বনি বাজে
                   সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
         দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে    রক্ষা করিলে অঙ্কে
                   স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥
          
রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে—
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
         তব করুণারুণরাগে   নিদ্রিত ভারত জাগে
                   তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে, জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

১৫ :: হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে

হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে—
উদার ছন্দে, পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যানগম্ভীর এই-যে ভূধর,   নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে—
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥

কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন—
শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।
পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার,  সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে—
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥

এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,  মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে—
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥

১৬ :: দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী

          দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী
          আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি।
          দিন আগত ওই,  ভারত তবু কই?
          সে কি রহিল লুপ্ত আজি সব-জন পশ্চাতে?
          লউক বিশ্বকর্মভার মিলি সবার সাথে।
প্রেরণ কর’ ভৈরব তব দুর্জয় আহ্বান হে,   জাগ্রত ভগবান হে॥

          বিঘ্নবিপদ দুঃখদহন তুচ্ছ করিল যারা
          মৃত্যুগহন পার হইল, টুটিল মোহকারা।
          দিন আগত ওই,  ভারত তবু কই?
          নিশ্চল নিবীর্যবাহু কর্মকীর্তিহীনে
          ব্যর্থশক্তি নিরানন্দ জীবনধনদীনে
প্রাণ দাও, প্রাণ দাও, দাও দাও প্রাণ হে,  জাগ্রত ভগবান হে॥

          নূতনযুগসূর্য উঠিল, ছুটিল তিমিররাত্রি,
          তব মন্দির-অঙ্গন ভরি মিলিল সকল যাত্রী।
          দিন আগত ওই,  ভারত তবু কই?
          গতগৌরব, হৃত-আসন, নতমস্তক লাজে—
          গ্লানি তার মোচন কর’ নরসমাজমাঝে।
স্থান দাও, স্থান দাও, দাও দাও স্থান হে,  জাগ্রত ভগবান হে॥

          জনগণপথ তব জয়রথচক্রমুখর আজি,
          স্পন্দিত করি  দিগ্‌দিগন্ত উঠিল শঙ্খ বাজি।
          দিন আগত ওই,  ভারত তবু কই?
          দৈন্যজীর্ণ কক্ষ তার, মলিন শীর্ণ আশা,
          ত্রাসরুদ্ধ চিত্ত তার, নাহি নাহি ভাষা।
কোটিমৌনকণ্ঠপূর্ণ বাণী কর’ দান হে,  জাগ্রত ভগবান হে॥

          যারা তব শক্তি লভিল নিজ অন্তরমাঝে
          বর্জিল ভয়, অর্জিল জয়, সার্থক হল কাজে।
          দিন আগত ওই,  ভারত তবু কই?
          আত্ম-অবিশ্বাস তার নাশ’ কঠিন ঘাতে,
          পুঞ্জিত অবসাদভার হান’ অশনিপাতে।
ছায়াভয়চকিতমূঢ় করহ পরিত্রাণ হে,  জাগ্রত ভগবান হে॥

১৭ :: মাতৃমন্দির-পুণ্য-অঙ্গন কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে

মাতৃমন্দির-পুণ্য-অঙ্গন কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে
বর  -পুত্রসঙ্ঘ বিরাজ’ হে।
শুভ  শঙ্খ বাজহ বাজ’ হে।
ঘন           তিমিররাত্রির চির প্রতীক্ষা
               পূর্ণ কর’, লহ’ জ্যোতিদীক্ষা,
               যাত্রীদল সব সাজ’ হে।
শুভ  শঙ্খ বাজহ বাজ’ হে।
বল   জয় নরোত্তম, পুরুষসত্তম,
               জয় তপস্বিরাজ হে।
               জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় হে।
এস’  বজ্রমহাসনে মাতৃ-আশীর্ভাষণে,
সকল সাধক এস’ হে, ধন্য কর’ এ দেশ হে।
সকল যোগী, সকল ত্যাগী, এস’ দুঃখসহদুঃখভাগী—
এস’ দুর্জয়শক্তিসম্পদ মুক্তবন্ধ সমাজ হে।
এস’ জ্ঞানী, এস’ কর্মী  নাশ’ ভারতলাজ হে।
               এস’ মঙ্গল, এস’ গৌরব,
               এস’ অক্ষয়পুণ্যসৌরভ,
এস’ তেজঃসূর্য উজ্জ্বল কীর্তি-অম্বর মাঝ হে।
বীরধর্মে পুণ্যকর্মে বিশ্বহৃদয়ে রাজ’ হে।
শুভ   শঙ্খ বাজহ বাজ’ হে।
জয়   জয় নরোত্তম, পুরুষসত্তম,
               জয় তপস্বিরাজ হে।
               জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় হে॥

১৮ :: আগে চল্ আগে চল্‌ ভাই

      আগে চল্, আগে চল্‌ ভাই!
পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে,
      বেঁচে মরে কিবা ফল ভাই!
      আগে চল্, আগে চল্‌ ভাই॥

প্রতি নিমেষেই যেতেছে সময়,
দিন ক্ষণ চেয়ে থাকা কিছু নয়—
’সময় সময়’ ক’রে পাঁজি পুঁথি ধ’রে
      সময় কোথা পাবি বল্‌ ভাই!
      আগে চল্, আগে চল্‌ ভাই॥

পিছায়ে যে আছে তারে ডেকে নাও
      নিয়ে যাও সাথে করে—
কেহ নাহি আসে, একা চলে যাও
      মহত্ত্বের পথ ধরে।
পিছু হতে ডাকে মায়ার কাঁদন,
ছিঁড়ে চলে যাও মোহের বাঁধন—
সাধিতে হইবে প্রাণের সাধন,
      মিছে নয়নের জল ভাই!
      আগে চল্, আগে চল্‌ ভাই॥

চিরদিন আছি ভিখারির বেশে
      জগতের পথপাশে—
যারা চলে যায় কৃপাচোখে চায়,
      পদধুলা উড়ে আসে।
ধূলিশয্যা ছেড়ে ওঠো ওঠো সবে
মানবের সাথে যোগ দিতে হবে—
তা যদি না পারো চেয়ে দেখো তবে
      ওই আছে রসাতল ভাই!
      আগে চল্, আগে চল্‌ ভাই॥

১৯ :: আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে

                         আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে।
                         কে আছ জাগিয়া  পুরবে চাহিয়া,
                 বলো ’উঠ উঠ’ সঘনে   গভীরনিদ্রামগনে॥
হেরো         তিমিররজনী যায় ওই,   হাসে উষা নব জ্যোতির্ময়ী—
                             নব আনন্দে, নব জীবনে,
                 ফুল্ল কুসুমে, মধুর পবনে, বিহগকলকূজনে॥
হেরো         আশার আলোকে জাগে শুকতারা উদয়-অচল-পথে,
                 কিরণকিরীটে তরুণ তপন উঠিছে অরুণরথে—
চলো যাই   কাজে মানবসমাজে,  চলো বাহিরিয়া জগতের মাঝে—
                 থেকো না অলস শয়নে, থেকো না মগন স্বপনে॥
                 যায়  লাজ ত্রাস, আলস বিলাস কুহক মোহ যায়।
                 ওই  দূর হয় শোক সংশয় দুঃখ স্বপনপ্রায়।
ফেলো জীর্ণ চীর, পরো নব সাজ,  আরম্ভ করো জীবনের কাজ—
                 সরল সবল আনন্দমনে, অমল অটল জীবনে॥

২০ :: বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বংলার ফল

বাংলার মাটি, বাংলার জল,  বাংলার বায়ু, বংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট,  বাংলার বন, বাংলার মাঠ—
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,  বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা—
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,  বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন—
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥

২১ :: আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

আজি           বাংলাদেশের হৃদয় হতে   কখন আপনি
তুমি এই        অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো   মা,  তোমায়  দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার  দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে,  বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো   মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার  দুয়ার আজি খুলে গেছে   সোনার মন্দিরে॥
তোমার  মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে   লুকায় অশনি,
তোমার  আঁচল ঝলে আকাশতলে   রৌদ্রবসনী!
ওগো   মা, তোমায়  দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার  দুয়ার আজি খুলে গেছে  সোনার মন্দিরে॥
যখন    অনাদরে চাই নি মুখে   ভেবেছিলেম দুঃখিনী মা
আছে   ভাঙা ঘরে একলা পড়ে,  দুখের বুঝি নাইকো সীমা।
কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ,  কোথা সে তোর মলিন হাসি—
আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল   ওই চরণের দীপ্তিরাশি!
ওগো   মা, তোমার  কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার  দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
আজি    দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী—
তোমার  অভয় বাজে হৃদয়মাঝে  হৃদয়হরণী!
ওগো   মা, তোমায়  দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার  দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥

২২ :: আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না

                আমায়  বোলো না গাহিতে বোলো না।
      এ কি  শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?।
এ যে  নয়নের জল, হতাশের শ্বাস,  কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ,
      এ যে  বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা।
      এ কি  শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?।
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি  কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি—
       মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ,  কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ—
       কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?
       এ কি  শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?।

২৩ :: অয়ি ভুবনমনোমোহিনী মা

              অয়ি   ভুবনমনোমোহিনী,   মা,
অয়ি  নির্মলসূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী  জনকজননিজননী॥
নীলসিন্ধুজলধৌতচরণতল,  অনিলবিকম্পিত-শ্যামল-অঞ্চল,
অম্বরচুম্বিতভালহিমাচল, শুভ্রতুষারকিরীটিনী॥
প্রথম প্রভাত উদয় তব গগনে,  প্রথম সামরব তব তপোবনে,
প্রথম প্রচারিত তব বনভবনে জ্ঞানধর্ম কত কাব্যকাহিনী।
চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য,   দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন—
জাহ্নবীযমুনা বিগলিত করুণা পুণ্যপীযূষস্তন্যবাহিনী॥

২৪ :: সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে

           সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
           সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে॥
জানি নে তোর ধনরতন  আছে কি না রানীর মতন,
শুধু    জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে॥
কোন্‌ বনেতে জানি নে ফুল  গন্ধে এমন করে আকুল,
           কোন্‌ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
আঁখি মেলে তোমার আলো  প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
           ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে॥

২৫ :: যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা

          যে তোমায়   ছাড়ে ছাড়ুক,  আমি তোমায় ছাড়ব না মা!
                      আমি  তোমার চরণ—
মা গো, আমি  তোমার চরণ করব শরণ,  আর কারো ধার ধারব না মা॥
          কে বলে তোর দরিদ্র ঘর,  হৃদয়ে তোর রতনরাশি—
আমি   জানি গো তার মূল্য জানি,    পরের আদর কাড়ব না মা॥
          মানের আশে দেশবিদেশে  যে মরে সে মরুক ঘুরে—
তোমার   ছেঁড়া কাঁথা আছে পাতা,  ভুলতে সে যে পারব না মা!।
          ধনে মানে লোকের টানে   ভুলিয়ে নিতে চায় যে আমায়—
ও মা,    ভয় যে জাগে শিয়র-বাগে,  কারো কাছেই হারব না মা॥

২৬ :: যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

যে তোরে  পাগল বলে  তারে তুই  বলিস নে কিছু॥
আজকে তোরে কেমন ভেবে  অঙ্গে যে তোর ধুলো দেবে
কাল সে প্রাতে মালা হাতে আসবে রে তোর পিছু-পিছু॥
আজকে আপন মানের ভরে  থাক্‌ সে বসে গদির ’পরে—
কালকে প্রেমে আসবে নেমে, করবে সে তার মাথা নিচু॥

২৭ :: ওরে তোরা নেই বা কথা বললি

                   ওরে, তোরা   নেই বা কথা বললি,
       দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী॥
  মরিস মিথ্যে ব’কে ঝ’কে,   দেখে কেবল হাসে লোকে,
       নাহয়   নিয়ে আপন মনের আগুন মনে মনেই জ্বললি॥
  অন্তরে তোর আছে কী যে   নেই রটালি নিজে নিজে,
       নাহয়   বাদ্যগুলো বন্ধ রেখে চুপেচাপেই চললি॥
কাজ থাকে তো কর্ গে না কাজ,   লাজ থাকে তো ঘুচা গে লাজ,
     ওরে,   কে যে তোরে কী বলেছে নেই বা তাতে টললি॥

২৮ :: যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা-না তবে তুই ফিরে যা-না

যদি তোর     ভাবনা থাকে ফিরে যা-না।  তবে তুই  ফিরে যা-না।
                   যদি তোর   ভয় থাকে তো করি মানা॥
যদি তোর     ঘুম জড়িয়ে থাকে গায়ে  ভুলবি যে পথ পায়ে পায়ে,
যদি তোর     হাত কাঁপে তো নিবিয়ে আলো সবারে করবি কানা॥
যদি তোর     ছাড়তে কিছু না চাহে মন  করিস ভারী বোঝা আপন—
তবে তুই       সইতে কভু পারবি নে রে  এ বিষম পথের টানা॥
যদি তোর     আপনা হতে অকারণে   সুখ সদা না জাগে মনে
তবে তুই       তর্ক  ক’রে সকল কথা করিবি নানাখানা॥

২৯ :: মা কি তুই পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে

  মা কি তুই    পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে?
  তারা যে       করে হেলা, মারে ঢেলা, ভিক্ষাঝুলি দেখতে পেলে॥
                     করেছি  মাথা নিচু, চলেছি  যাহার পিছু
                         যদি বা  দেয় সে কিছু অবহেলে—
  তবু কি         এমনি করে ফিরব ওরে আপন মায়ের প্রসাদ ফেলে?।
                     কিছু মোর  নেই ক্ষমতা  সে যে ঘোর  মিথ্যে কথা,
                         এখনো  হয় নি মরণ শক্তিশেলে—
  আমাদের     আপন শক্তি আপন ভক্তি চরণে তোর দেব মেলে॥
                     নেব গো  মেগে-পেতে  যা আছে  তোর ঘরেতে,
                         দে গো তোর  আঁচল পেতে চিরকেলে—
আমাদের  সেইখেনে মান,  সেইখেনে প্রাণ,  সেইখেনে দিই হৃদয় ঢেলে॥

৩০ :: ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি

ছি ছি,  চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি।
এবার   কঠিন হয়ে থাক্‌-না ওরে, বক্ষোদুয়ার আঁটি—
      জোরে     বক্ষোদুয়ার আঁটি॥
পরানটাকে গলিয়ে  ফেলে দিস নে, রে ভাই, পথে ঢেলে
                     মিথ্যে অকাজে—
ওরে  নিয়ে তারে চলবি পারে কতই বাধা কাটি,
      পথের     কতই বাধা কাটি॥
দেখলে ও তোর জলের ধারা  ঘরে পরে হাসবে যারা
                    তারা চার দিকে—
তাদের    দ্বারেই গিয়ে কান্না জুড়িস,    যায় না কি বুক ফাটি,
      লাজে     যায় না কি বুক ফাটি?।
দিনের বেলা জগৎ-মাঝে  সবাই যখন চলছে কাজে  আপন গরবে—
      তোরা     পথের ধারে ব্যথা নিয়ে করিস ঘাঁটাঘাঁটি—
      কেবল    করিস ঘাঁটাঘাঁটি॥

৩১ :: ঘরে মুখ মলিন দেখে গলিস নে ওরে ভাই

     ঘরে মুখ মলিন দেখে গলিস নে— ওরে ভাই,
     বাইরে মুখ আঁধার দেখে টলিস নে— ওরে ভাই॥
যা তোমার আছে মনে  সাধো তাই পরানপণে,
     শুধু তাই দশজনারে বলিস নে— ওরে ভাই॥
একই পথ আছে ওরে,  চলো সেই রাস্তা ধরে,
     যে আসে তারই পিছে চলিস নে— ওরে ভাই!
থাক্‌-না আপন কাজে,  যা খুশি বলুক-না যে,
     তা নিয়ে গায়ের জ্বালায় জ্বলিস নে— ওরে ভাই॥

৩২ :: এখন আর দেরি নয় ধর্ গো তোরা হাতে হাতে ধর্ গো

            এখন  আর দেরি নয়, ধর্ গো তোরা  হাতে হাতে ধর্ গো।
            আজ  আপন পথে ফিরতে হবে   সামনে মিলন-স্বর্গ॥
ওরে,    ওই উঠেছে শঙ্খ বেজে,  খুলল দুয়ার মন্দিরে যে—
            লগ্ন বয়ে যায় পাছে, ভাই,  কোথায় পূজার অর্ঘ্য?।
এখন    যার যা-কিছু আছে ঘরে   সাজা পূজার থালার ’পরে,
            আত্মদানের উৎসধারায়  মঙ্গলঘট ভর্ গো।
আজ    নিতেও হবে, আজ   দিতেও হবে,  দেরি কেন করিস তবে—
            বাঁচতে যদি হয় বেঁচে নে, মর্‌তে হয় তো মর‍্‍ গো॥

৩৩ :: বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি বারে বারে হেলিস নে ভাই

     বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি,  বারে বারে হেলিস নে ভাই!
     শুধু তুই  ভেবে ভেবেই হাতের লক্ষ্মী  ঠেলিস নে ভাই॥
একটা কিছু করে নে ঠিক,    ভেসে ফেরা মরার অধিক—
     বারেক এ দিক বারেক ও দিক, এ খেলা আর খেলিস নে ভাই॥
মেলে কি না মেলে রতন  করতে তবু হবে যতন—
     না যদি হয় মনের মতন  চোখের জলটা ফেলিস নে ভাই!
ভাসাতে হয় ভাসা ভেলা,  করিস নে আর হেলাফেলা—
     পেরিয়ে যখন যাবে বেলা  তখন আঁখি মেলিস নে ভাই॥

৩৪ :: আমরা পথে পথে যাব সারে সারে

আমরা     পথে পথে যাব সারে সারে,
তোমার     নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে॥
                বলব, ‘জননীকে কে দিবি দান,
                কে দিবি ধন তোরা কে দিবি প্রাণ’—
‘তোদের    মা ডেকেছে’ কব বারে বারে॥
                তোমার নামে প্রাণের সকল সুর
                আপনি উঠবে বেজে সুধামধুর
মোদের     হৃদয়যন্ত্রেরই তারে তারে।
                বেলা গেলে শেষে তোমারই পায়ে
                এনে দেব সবার পূজা কুড়ায়ে
তোমার     সন্তানেরই দান ভারে ভারে॥

৩৫ :: এ ভারতে রাখো নিত্য প্রভু তব শুভ আশীর্বাদ

এ ভারতে রাখো নিত্য, প্রভু, তব শুভ আশীর্বাদ—
তোমার অভয়, তোমার অজিত অমৃত বাণী,
               তোমার স্থির অমর আশা॥
অনির্বাণ ধর্ম আলো  সবার ঊর্ধ্বে জ্বালো জ্বালো,
               সঙ্কটে দুর্দিনে হে,
          রাখো তারে অরণ্যে তোমারই পথে॥
বক্ষে বাঁধি দাও তার  বর্ম তব নির্বিদার,
           নিঃশঙ্কে যেন সঞ্চরে নির্ভীক।
পাপের নিরখি জয়    নিষ্ঠা তবুও রয়—
           থাকে তব চরণে অটল বিশ্বাসে॥

৩৬ :: রইল বলে রাখলে কারে হুকুম তোমার ফলবে কবে

                রইল বলে রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে?
তোমার     টানাটানি টিঁকবে না ভাই, রবার যেটা সেটাই রবে॥
                যা-খুশি তাই করতে পারো   গায়ের জোরে রাখো মারো—
                যাঁর গায়ে সব ব্যথা বাজে তিনি যা সন সেটাই সবে॥
                অনেক তোমার টাকা কড়ি,  অনেক দড়া অনেক দড়ি,
                অনেক অশ্ব অনেক করী— অনেক তোমার আছে ভবে।
                ভাবছ হবে তুমিই যা চাও,  জগৎটাকে তুমিই নাচাও—
                দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয় না যেটা সেটাও হবে॥

৩৭ :: জননীর দ্বারে আজি ওই শুন গো শঙ্খ বাজে

জননীর দ্বারে আজি ওই শুন গো শঙ্খ বাজে।
থেকো না থেকো না, ওরে ভাই, মগন মিথ্যা কাজে॥
        অর্ঘ্য ভরিয়া আনি ধরো গো পূজার থালি,
        রতনপ্রদীপখানি যতনে আনো গো জ্বালি,
        ভরি লয়ে দুই পাণি বহি আনো ফুলডালি,
                  মার আহ্বানবাণী রটাও ভুবনমাঝে॥
আজি প্রসন্ন পবনে নবীন জীবন ছুটিছে।
আজি প্রফুল্ল কুসুমে নব সুগন্ধ উঠিছে।
        আজি উজ্জ্বল ভালে তোলো উন্নত মাথা,
        নবসঙ্গীততালে গাও গম্ভীর গাথা,
        পরো মাল্য কপালে নবপল্লব-গাঁথা,
                 শুভ সুন্দর কালে সাজো সাজো নব সাজে॥

৩৮ :: আজি এ ভারত লজ্জিত হে

                  আজি এ ভারত লজ্জিত হে,
                      হীনতাপঙ্কে মজ্জিত হে॥
নাহি পৌরুষ, নাহি বিচারণা,   কঠিন তপস্যা, সত্যসাধনা—
       অন্তরে বাহিরে ধর্মে কর্মে সকলই ব্রহ্মবিবর্জিত হে॥
ধিক্‌কৃত লাঞ্ছিত পৃথ্বী’পরে,     ধূলিবিলুণ্ঠিন্ত সুপ্তিভরে—
       রুদ্র, তোমার নিদারুণ বজ্রে করো তারে সহসা তর্জিত হে॥
পর্বতে প্রান্তরে নগরে গ্রামে   জাগ্রত ভারত ব্রহ্মের নামে,
       পুণ্যে বীর্যে অভয়ে অমৃতে হইবে পলকে সজ্জিত হে॥

৩৯ :: চলো যাই চলো যাই চলো যাই

চলো  যাই, চলো, যাই চলো, যাই—
        চলো  পদে পদে সত্যের ছন্দে
               চলো  দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।
                     চলো  মুক্তিপথে,
        চলো  বিঘ্নবিপদজয়ী মনোরথে
করো ছিন্ন, করো ছিন্ন, করো ছিন্ন—
                     স্বপ্নকুহক করো ছিন্ন।
               থেকো না জড়িত অবরুদ্ধ
                        জড়তার জর্জর বন্ধে।
        বলো  জয় বলো, জয় বলো, জয়—
                মুক্তির জয় বলো ভাই॥

        চলো   দুর্গমদূরপথযাত্রী    চলো দিবারাত্রি,
                    করো জয়যাত্রা,
        চলো বহি নির্ভয় বীর্যের বার্তা,
                বলো  জয় বলো, জয় বলো, জয়—
                        সত্যের জয় বলো ভাই॥

        দূর করো সংশয়শঙ্কার ভার,
                যাও চলি তিমিরদিগন্তের পার।
        কেন  যায় দিন হায় দুশ্চিন্তার দ্বন্দ্বে—
                চলো  দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।
                      চলো জ্যোতির্লোকে  জাগ্রত চোখে—
               বলো  জয় বলো, জয় বলো, জয়—
        বলো   নির্মল জ্যোতির জয় বলো ভাই॥
              হও  মৃত্যুতোরণ উত্তীর্ণ,
           যাক,  যাক ভেঙে যাক যাহা জীর্ণ।
  চলো  অভয় অমৃতময় লোকে,  অজর অশোকে,
               বলো  জয় বলো, জয় বলো, জয়—
                     অমৃতের জয় বলো ভাই॥

৪০ :: শুভ কর্মপথে ধর’ নির্ভয় গান

শুভ      কর্মপথে ধর’ নির্ভয় গান।
সব       দুর্বল সংশয় হোক অবসান।
চির-     শক্তির নির্ঝর নিত্য ঝরে
লহ’     সে অভিষেক ললাট’পরে।
তব      জাগ্রত নির্মল নূতন প্রাণ
ত্যাগব্রতে নিক দীক্ষা,
বিঘ্ন হতে নিক শিক্ষা—
নিষ্ঠুর সঙ্কট দিক সম্মান।
দুঃখই হোক তব বিত্ত মহান।
চল’  যাত্রী, চল’ দিনরাত্রি—
কর’  অমৃতলোকপথ অনুসন্ধান।
জড়তাতামস হও উত্তীর্ণ,
ক্লান্তিজাল কর’ দীর্ণ বিদীর্ণ—
দিন-অন্তে অপরাজিত চিত্তে
মৃত্যুতরণ তীর্থে কর’ স্নান॥

৪১ :: ওরে নূতন যুগের ভোরে

             ওরে,  নূতন যুগের ভোরে
দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে॥
কী রবে আর কী রবে না,    কী হবে আর কী হবে না
                         ওরে হিসাবি,
এ সংশয়ের মাঝে কি তোর ভাবনা মিশাবি?।
             যেমন করে ঝর্না নামে দুর্গম পর্বতে
নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে পড় অজানিতের পথে।
জাগবে ততই শক্তি যতই হানবে তোরে মানা,
অজানাকে বশ ক’রে তুই করবি আপন জানা।
               চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী—
পায়ের বেগেই পথ কেটে যায়,  করিস নে আর দেরি॥

৪২ :: ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো

ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।
একলা রাতের অন্ধকারে    আমি চাই   পথের আলো॥
         দুন্দুভিতে হল রে কার আঘাত শুরু,
         বুকের মধ্যে উঠল বেজে গুরুগুরু—
পালায় ছুটে সুপ্তিরাতের স্বপ্নে-দেখা মন্দ ভালো॥
         নিরুদ্দেশের পথিক আমায় ডাক দিলে কি—
         দেখতে তোমায় না যদি পাই নাই-বা দেখি।
         ভিতর থেকে ঘুচিয়ে দিলে চাওয়া পাওয়া,
ভাব্‌নাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া
বজ্রশিখায় এক পলকে মিলিয়ে দিলে সাদা কালো॥

৪৩ :: ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে

      ওদের    বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে,
                   মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
      ওদের    যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে,
                   ততই মোদের আঁখি ফুটবে॥
আজকে যে তোর কাজ করা চাই,  স্বপ্ন দেখার সময় তো নাই—
      এখন     ওরা যতই গর্জাবে, ভাই, তন্দ্রা ততই ছুটবে,
                   মোদের   তন্দ্রা ততই ছুটবে॥
      ওরা       ভাঙতে যতই চাবে জোরে   গড়বে ততই দ্বিগুণ করে,
      ওরা       যতই রাগে মারবে রে ঘা ততই যে ঢেউ উঠবে।
      তোরা     ভরসা না ছাড়িস কভু,  জেগে আছেন জগৎ-প্রভু—
      ওরা       ধর্ম যতই দলবে ততই ধুলায় ধ্বজা লুটবে,
                   ওদের   ধুলায় ধ্বজা লুটবে॥

৪৪ :: বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান

        বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান—
                তুমি কি  এমনি শক্তিমান!
  আমাদের  ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান—
                তোমাদের  এমনি অভিমান॥
    চিরদিন  টানবে পিছে,  চিরদিন রাখবে  নীচে—
  এত বল  নাই রে তোমার,  সবে না সেই টান॥
শাসনে  যতই ঘেরো  আছে বল  দুর্বলেরও,
  হও-না  যতই বড়ো  আছেন ভগবান।
     আমাদের  শক্তি মেরে  তোরাও  বাঁচবি নে রে,
         বোঝা তোর  ভারী হলেই ডুববে তরীখান॥

৪৫ :: খ্যাপা তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে

খ্যাপা তুই    আছিস আপন খেয়াল ধরে।
যে আসে     তোরই পাশে,  সবাই হাসে দেখে তোরে॥
জগতে        যে যার আছে আপন কাজে দিবানিশি।
তারা           পায় না বুঝে তুই কী খুঁজে ক্ষেপে-বেড়াস জনম ভ’রে॥
তোর           নাই অবসর, নাইকো দোসর ভবের মাঝে।
তোরে         চিনতে যে চাই, সময় না পাই নানান কাজে।
ওরে, তুই    কী শুনাতে এত প্রাতে মরিস ডেকে?
এ যে          বিষম জ্বালা ঝালাপালা, দিবি সবায় পাগল করে।
ওরে, তুই     কী এনেছিস, কী টেনেছিস ভাবের জালে?
তার কি       মূল্য আছে কারো কাছে কোনো কালে?।
আমরা        লাভের কাজে হাটের মাঝে ডাকি তোরে!
তুই কি        সৃষ্টিছাড়া, নাইকো সাড়া, রয়েছিস কোন্‌ নেশার ঘোরে?
এ জগৎ      আপন মতে আপন পথে চলে যাবে—
বসে তুই      আর-এক কোণে নিজের মনে নিজের ভাবে॥
ওরে ভাই,    ভাবের সাথে ভবের মিলন হবে কবে—
মিছে তুই     তারি লাগি আছিস জাগি না জানি কোন্‌ আশার জোরে॥

৪৬ :: সাধন কি মোর আসন নেবে হট্টগোলের কাঁধে

           সাধন কি মোর আসন নেবে হট্টগোলের কাঁধে?
           খাঁটি জিনিস হয় রে মাটি নেশার পরমাদে॥
কথায় তো শোধ হয় না দেনা,  গায়ের জোরে জোড় মেলে না—
           গোলেমালে ফল কি ফলে জোড়াতাড়ার ছাঁদে?।
           কে বলো তো বিধাতারে তাড়া দিয়ে ভোলায়?
           সৃষ্টিকরের ধন কি মেলে জাদুকরের ঝোলায়?
মস্ত-বড়োর লোভে শেষে     মস্ত ফাঁকি জোটে এসে,
           ব্যস্ত-আশা জড়িয়ে পড়ে সর্বনাশার ফাঁদে॥