গীতবিতান - পূজা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সূচীপত্র

১ :: কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা

 কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা,
 তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা—
 এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
        সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
 তাই কি আমার ঘুম ছুটেছে, বাঁধ টুটেছে মনে,
 খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে,
 কাঁপে আমার দিবানিশার সকল আঁধার আলা!
 এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
        সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
 রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি,
 বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি।
 শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে,
 অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।
 নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা—
 এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
        সুরের-গন্ধ-ঢালা?।

২ :: সুরের গুরু দাও গো সুরের দীক্ষা

       সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা—
 মোরা   সুরের কাঙাল, এই আমাদের ভিক্ষা॥
       মন্দাকিনীর ধারা,    ঊষার শুকতারা,
       কনকচাঁপা কানে কানে যে সুর পেল শিক্ষা॥
       তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত
       যাব যেথায় বেসুর বাজে নিত্য।
       কোলাহলের বেগে     ঘূর্ণি উঠে জেগে,
       নিয়ো তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা॥

৩ :: তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে

 তোমার   সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে
        দেবে কি গো বাসা আমায় একটি ধারে?।
            আমি  শুনব ধ্বনি কানে,
            আমি  ভরব ধ্বনি প্রাণে,
        সেই ধ্বনিতে চিত্তবীণায় তার বাঁধিব বারে বারে॥
 আমার   নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে
        ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে।
            আমার  দিন ফুরাবে যবে,
            যখন   রাত্রি আঁধার হবে,
        হৃদয়ে মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে॥

৪ :: তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী

 তুমি    কেমন করে গান করো হে গুণী,
 আমি    অবাক্‌ হয়ে শুনি কেবল শুনি॥
    সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
    সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
    পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে
         বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী॥
    মনে করি অমনি সুরে গাই,
    কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই।
    কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে—
    হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে,
    আমায় তুমি ফেলেছ কোন্‌ ফাঁদে
         চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি॥

৫ :: আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান

 আমি তোমায় যত      শুনিয়েছিলেম গান
 তার বদলে আমি     চাই নে কোনো দান॥
 ভুলবে সে গান যদি   নাহয় যেয়ো ভুলে
 উঠবে যখন তারা     সন্ধ্যাসাগরকূলে,
 তোমার সভায় যবে    করব অবসান
 এই ক’দিনের শুধু     এই ক’টি মোর তান॥
 তোমার গান যে কত   শুনিয়েছিলে মোরে
 সেই কথাটি তুমি     ভুলবে কেমন করে?
 সেই কথাটি, কবি,    পড়বে তোমার মনে
 বর্ষামুখর রাতে,      ফাগুন-সমীরণে—
 এইটুকু মোর শুধু     রইল অভিমান
 ভুলতে সে কি পার   ভুলিয়েছ মোর প্রাণ॥

৬ :: তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে

 তুমি যে       সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,
 এ আগুন    ছড়িয়ে গেল সব খানে॥
 যত সব       মরা গাছের ডালে ডালে
                   নাচে আগুন তালে তালে রে,
 আকাশে      হাত তোলে সে কার পানে॥
 আঁধারের     তারা যত অবাক্‌ হয়ে রয় চেয়ে,
 কোথাকার   পাগল হাওয়া বয় ধেয়ে।
 নিশীথের     বুকের মাঝে এই-যে অমল
                   উঠল ফুটে স্বর্ণকমল রে,
 আগুনের    কী গুণ আছে কে জানে॥

৭ :: তোমার বীণা আমার মনোমাঝে

 তোমার বীণা আমার মনোমাঝে
 কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে॥
 আকাশ যবে শিহরি উঠে গানে
 গোপন কথা কহিতে থাকে ধরার কানে কানে—
 তাহার মাঝে সহসা মাতে বিষম কোলাহলে
 আমার মনে বাঁধনহারা স্বপন দলে দলে।
 হে বীণাপাণি, তোমার সভাতলে
 আকুল হিয়া উন্মাদিয়া বেসুর হয়ে বাজে॥
 চলিতেছিনু তব কমলবনে,
 পথের মাঝে ভুলালো পথ উতলা সমীরণে।
 তোমার সুর ফাগুনরাতে জাগে,
 তোমার সুর অশোকশাখে অরুণরেণুরাগে।
 সে সুর বাহি চলিতে চাহি আপন-ভোলা মনে
 গুঞ্জরিত-ত্বরিত-পাখা মধুকরের সনে।
 কুহেলী কেন জড়ায় আবরণে—
 আঁধারে আলো আবিল করে, আঁখি যে মরে লাজে॥

৮ :: তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান গাহিবারে॥

 তোমার   নয়ন আমায় বারে বারে   বলেছে গান গাহিবারে॥
               ফুলে ফুলে তারায় তারায়
               বলেছে সে কোন্‌ ইশারায়
               দিবস-রাতির মাঝ-কিনারায়   ধূসর আলোয় অন্ধকারে।
               গাই নে কেন কী কব তা,
               কেন আমার আকুলতা—
               ব্যথার মাঝে লুকায় কথা,   সুর যে হারাই অকূল পারে॥
               যেতে যেতে গভীর স্রোতে   ডাক দিয়েছ তরী হতে।
               ডাক দিয়েছ ঝড়-তুফানে
               বোবা মেঘের বজ্রগানে,
               ডাক দিয়েছ মরণপানে     শ্রাবণরাতের উতল ধারে।
               যাই নে কেন জান না কি—
               তোমার পানে মেলে আঁখি
               কূলের ঘাটে বসে থাকি,    পথ কোথা পাই পারাবারে॥

৯ :: অরূপ তোমার বাণী

        অরূপ, তোমার বাণী
অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্‌ সে আনি॥
নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা—
আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা
     নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি॥
যেমন তোমার বসন্তবায় গীতলেখা যায় লিখে
বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে বনে বনে দিকে দিকে
তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিশ্বাস দাও পুরে,
শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে,
   বিঘ্ন তাহার পুণ্য করুক তব দক্ষিণপাণি॥

১০ :: গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে

         গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে
         রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে॥
 বিশ্বকবির চিত্তমাঝে    ভুবনবীণা যেথায় বাজে
         জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে॥
         ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে,
         অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে।
 সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা—   সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা—
         গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে॥

১১ :: আমার সুরে লাগে তোমার হাসি

             আমার সুরে লাগে তোমার হাসি,
 যেমন    ঢেউয়ে ঢেউয়ে রবির কিরণ দোলে আসি॥
             দিবানিশি আমিও যে     ফিরি তোমার সুরের খোঁজে,
             হঠাৎ এ মন ভোলায় কখন তোমার বাঁশি॥
 আমার  সকল কাজই রইল বাকি, সকল শিক্ষা দিলেম ফাঁকি।
 আমার  গানে তোমায় ধরব ব’লে   উদাস হয়ে যাই যে চলে,
             তোমার গানে ধরা দিতে ভালোবাসি॥

১২ :: আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে

    আমার  বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
    তোমার  সুরে সুরে সুর মেলাতে॥
 একতারাটির একটি তারে  গানের বেদন বইতে নারে,
 তোমার সাথে বারে বারে  হার মেনেছি এই খেলাতে
    তোমার  সুরে সুরে সুর মেলাতে॥
         এ তার বাঁধা কাছের সুরে,
         ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে।
 গানের লীলার সেই কিনারে  যোগ দিতে কি সবাই পারে
    বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে—
      তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে?।

১৩ :: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

 জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
 বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে॥
      এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
      তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,
      গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে
          তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে॥
      নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে
      আঁধার-কেশভার দিয়েছে বিছায়ে।
          আজি এ কোন্‌ গান নিখিল প্লাবিয়া
          তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া!
          ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে,
             গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে॥

১৪ :: যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে

 যারা     কথা দিয়ে তোমার কথা বলে
 তারা     কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে॥
             একের কথা আরে
             বুঝতে নাহি পারে,
             বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে॥
 যারা      কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর
 তাদের   সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর।
              বোঝে কি নাই বোঝে
              থাকে না তার খোঁজে,
              বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে॥

১৫ :: তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে

তোমারি      ঝরনাতলার নির্জনে
মাটির এই   কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্‌ ক্ষণে॥
রবি ঐ        অস্তে নামে শৈলতলে,
বলাকা        কোন্‌ গগনে উড়ে চলে—
আমি এই     করুণ ধারার কলকলে
নীরবে         কান পেতে রই আনমনে
তোমারি       ঝরনাতলার নির্জনে॥
দিনে মোর    যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ করে,
মেটে বা       নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে
সারাদিন      অনেক ঘুরে দিনের শেষে
এসেছি        সকল চাওয়ার বাহির-দেশে,
নেব আজ    অসীম ধারার তীরে এসে
প্রয়োজন      ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে
তোমারি       ঝরনাতলার নির্জনে॥

১৬ :: কূল থেকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে

 কূল থেকে মোর গানের তরী  দিলেম খুলে,
 সাগর-মাঝে ভাসিয়ে দিলেম  পালটি তুলে॥
 যেখানে ঐ কোকিল ডাকে ছায়াতলে
         সেখানে নয়,
 যেখানে ঐ গ্রামের বধূ  আসে জলে
         সেখানে নয়,
 যেখানে নীল মরণলীলা  উঠছে দুলে
 সেখানে মোর গানের তরী  দিলেম খুলে॥
 এবার, বীণা, তোমায় আমায়  আমরা একা—
 অন্ধকারে নাইবা কারে  গেল দেখা
 কুঞ্জবনের শাখা হতে  যে ফুল তোলে
         সে ফুল এ নয়,
 বাতায়নের লতা হতে  যে ফুল দোলে
         সে ফুল এ নয়—
 দিশাহারা আকাশ-ভরা  সুরের ফুলে
 সেই দিকে মোর গানের তরী  দিলেম খুলে॥

১৭ :: তোমার কাছে এ বর মাগি মরণ হতে যেন জাগি

তোমার কাছে এ বর মাগি,  মরণ হতে যেন জাগি
                 গানের সুরে॥
যেমনি নয়ন মেলি যেন  মাতার স্তন্যসুধা-হেন
নবীন জীবন দেয় গো পূরে  গানের সুরে॥
             সেথায় তরু তৃণ যত
মাটির বাঁশি হতে ওঠে গানের মতো।
আলোক সেথা দেয় গো আনি
আকাশের আনন্দবাণী,
হৃদয়মাঝে বেড়ায় ঘুরে    গানের সুরে॥

১৮ :: কেন তোমরা আমায় ডাকো আমার মন না মানে

 কেন  তোমরা আমায় ডাকো, আমার মন না মানে।
           পাই নে সময় গানে গানে॥
 পথ আমারে শুধায় লোকে,  পথ কি আমার পড়ে চোখে,
        চলি যে কোন্‌ দিকের পানে  গানে গানে॥
        দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি,  নিই নে কানে।
           মন ভেসে যায় গানে গানে।
 আজ যে কুসুম-ফোটার বেলা,  আকাশে আজ রঙের মেলা,
        সকল দিকেই আমায় টানে  গানে গানে॥

১৯ :: দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে

      দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে—
আমার  সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে॥
    বাতাস বহে মরি মরি,    আর বেঁধে রেখো না তরী—
       এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে॥
       তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
       বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।
    কবে নিয়ে আমার বাঁশি  বাজাবে গো আপনি আসি
       আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে॥

২০ :: রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি বেলাশেষের তান

     রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি বেলাশেষের তান।
     পথে চলি, শুধায় পথিক ‘কী নিলি তোর দান’॥
 দেখাব যে সবার কাছে  এমন আমার কী-বা আছে,
     সঙ্গে আমার আছে শুধু এই কখানি গান॥
     ঘরে আমার রাখতে যে হয় বহু লোকের মন—
     অনেক বাঁশি, অনেক কাঁসি,  অনেক আয়োজন।
 বঁধুর কাছে আসার বেলায়  গানটি শুধু নিলেম গলায়,
     তারি গলার মাল্য ক’রে করব মূল্যবান॥

২১ :: জাগ’ জাগ’ রে জাগ’ সঙ্গীত চিত্ত অম্বর কর তরঙ্গিত

জাগ’ জাগ’ রে জাগ’ সঙ্গীত—চিত্ত অম্বর কর তরঙ্গিত
নিবিড়নন্দিত প্রেমকম্পিত হৃদয়কুঞ্জবিতানে॥
মুক্তবন্ধন সপ্তসুর তব করুক বিশ্ববিহার,
সূর্যশশিনক্ষত্রলোকে করুক হর্ষ প্রচার।
তানে তানে প্রাণে প্রাণে গাঁথ’ নন্দনহার।
পূর্ণ কর’ রে গগন-অঙ্গন তাঁর বন্দনগানে॥

২২ :: হেথা যে গান গাইতে আসা আমার হয় নি সে গান গাওয়া

হেথা  যে গান গাইতে আসা, আমার  হয় নি সে গান গাওয়া—
আজও কেবলই সুর সাধা, আমার  কেবল গাইতে চাওয়া॥
আমার  লাগে নাই সে সুর, আমার  বাঁধে নাই সে কথা,
শুধু  প্রাণেরই মাঝখানে আছে  গানের ব্যাকুলতা।
আজও  ফোটে নাই সে ফুল, শুধু  বহেছে এক হাওয়া॥
আমি  দেখি নাই তার মুখ, আমি  শুনি নাই তার বাণী,
কেবল  শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার  পায়ের ধ্বনিখানি—
আমার দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন  করে আসা-যাওয়া।
শুধু  আসন পাতা হল আমার  সারাটি দিন ধ’রে—
ঘরে  হয় নি প্রদীপ জ্বালা, তারে  ডাকব কেমন করে।
আছি  পাবার আশা নিয়ে, তারে  হয় নি আমার পাওয়া॥

২৩ :: আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান

    আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান,
    দিয়ো তোমার জগৎ-সভায় এইটুকু মোর স্থান॥
 আমি তোমার ভুবন-মাঝে  লাগি নি, নাথ, কোনো কাজে—
    শুধু কেবল সুরে বাজে  অকাজের এই প্রাণ॥
    নিশায় নীরব দেবালয়ে তোমার আরাধন,
    তখন মোরে আদেশ কোরো গাইতে হে রাজন।
 ভোরে যখন আকাশ জুড়ে  বাজবে বীণা সোনার সুরে
    আমি যেন না রই দূরে,  এই দিয়ো মোর মান॥

২৪ :: গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে

    গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে।
    ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে॥
ঐ যে তোমার ভোরের পাখি    নিত্য করে ডাকাডাকি,
    অরুণ-আলোর খেয়ায় যখন এস ঘাটের পারে,
    মোর প্রভাতীর গানখানিতে দাঁড়াও আমার দ্বারে॥
    আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে,
    জল ভরেছে ঐ গগনের নীল নয়নের কোণে।
আজকে এলে নতুন বেশে    তালের বনে মাঠের শেষে,
    অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে।
    দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে॥

২৫ :: সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে

   সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে
   বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে॥
উধাও আকাশ উদার ধরা    সুনীল-শ্যামল-সুধায়-ভরা
   মিলায় দূরে, পরশ তাদের মেলে না যে—
   বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে॥
   বিশ্ব যে সেই সুরের পথের হাওয়ায় হাওয়ায়
   চিত্ত আমার ব্যাকুল করে আসা-যাওয়ায়।
তোমায় বসাই এ-হেন ঠাঁই    ভুবনে মোর আর-কোথা নাই,
   মিলন হবার আসন হারাই আপন-মাঝে—
   বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে॥

২৬ :: গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি

    গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
    তখন তারে চিনি আমি,   তখন তারে জানি।
তখন তারি আলোর ভাষায়  আকাশ ভরে ভালোবাসায়,
    তখন তারি ধুলায় ধুলায় জাগে পরম বাণী॥
    তখন সে যে বাহির ছেড়ে অন্তরে মোর আসে,
    তখন আমার হৃদয় কাঁপে তারি ঘাসে ঘাসে।
রূপের রেখা রসের ধারায়   আপন সীমা কোথায় হারায়,
    তখন দেখি আমার সাথে সবার কানাকানি॥

২৭ :: খেলার ছলে সাজিয়ে আমার গানের বাণী

     খেলার ছলে সাজিয়ে আমার গানের বাণী
     দিনে দিনে ভাসাই দিনের তরীখানি॥
স্রোতের লীলায় ভেসে ভেসে    সুদূরে কোন্‌ অচিন দেশে
     কোনো ঘাটে ঠেকবে কিনা নাহি জানি॥
     নাহয় ডুবে গেলই,    নাহয় গেলই বা।
     নাহয় তুলে লও গো, নাহয় ফেলোই বা।
 হে অজানা, মরি মরি,     উদ্দেশে এই খেলা করি,
     এই খেলাতেই আপন-মনে ধন্য মানি॥

২৮ :: যতখন তুমি আমায় বসিয়ে রাখ বাহির-বাটে

 যতখন   তুমি আমায় বসিয়ে রাখ বাহির-বাটে
 ততখন   গানের পরে গান গেয়ে মোর প্রহর কাটে॥
 যবে     শুভক্ষণে ডাক পড়ে সেই ভিতর-সভার মাঝে
 এ গান   লাগবে বুঝি কাজে
 তোমার   সুরের রঙের রঙিন নাটে॥
 তোমার   ফাগুনদিনের বকুল চাঁপা, শ্রাবণদিনের কেয়া,
        তাই দেখে তো শুনি তোমার কেমন যে তান দে’য়া।
 আমি    উতল প্রাণে আকাশ-পানে হৃদয়খানি তুলি
 বীণায়    বেঁধেছি গানগুলি
 তোমার   সাঁঝ-সকালের সুরের ঠাটে॥

২৯ :: আমার যে গান তোমার পরশ পাবে

আমার     যে গান তোমার পরশ পাবে
         থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে?।
      সুরে সুরে খুঁজি তারে   অন্ধকারে,
আমার  যে আঁখিজল তোমার পায়ে নাবে
         থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে?।
 যখন  শুষ্ক প্রহর বৃথা কাটাই
 চাহি  গানের লিপি তোমায় পাঠাই।
       কোথায় দুঃখসুখের তলায়    সুর যে পলায়,
 আমার  যে শেষ বাণী তোমার দ্বারে যাবে
          থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে?।

৩০ :: গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে

 গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে।
     দাও আমারে সোনার-বরন সুরের ধারা ঢেলে॥
 যে সুর গোপন গুহা হতে  ছুটে আসে আকুল স্রোতে,
     কান্নাসাগর-পানে যে যায় বুকের পাথর ঠেলে॥
     যে সুর ঊষার বাণী বয়ে আকাশে যায় ভেসে,
     রাতের কোলে যায় গো চলে সোনার হাসি হেসে।
 যে সুর চাঁপার পেয়ালা ভ’রে  দেয় আপনায় উজাড় ক’রে,
     যায় চলে যায় চৈত্রদিনের মধুর খেলা খেলে॥

৩১ :: কণ্ঠে নিলেম গান আমার শেষ পারানির কড়ি

কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি—
    একলা ঘাটে রইব না গো পড়ি॥
        আমার   সুরের রসিক নেয়ে
        তারে   ভোলাব গান গেয়ে,
           পারের খেয়ায় সেই ভরসায় চড়ি॥
    পার হব কি নাই হব তার খবর কে রাখে—
    দূরের হাওয়ায় ডাক দিল এই সুরের পাগলাকে।
        ওগো   তোমরা মিছে ভাব,
        আমি   যাবই যাবই যাব—
           ভাঙল দুয়ার, কাটল দড়াদড়ি॥

৩২ :: আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিয়েছিলে

আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিয়েছিলে,
  আমার গাঁথা স্বপন-মালা কখন চেয়ে নিয়েছিলে॥
         মন যবে মোর দূরে দূরে
         ফিরেছিল আকাশ ঘুরে
         তখন আমার ব্যথার সুরে
                আভাস দিয়ে গিয়েছিলে॥
যবে    বিদায় নিয়ে যাবে চলে
      মিলন-পালা সাঙ্গ হলে
         শরৎ-আলোয় বাদল-মেঘে
         এই কথাটি রইবে লেগে—
         এই শ্যামলে এই নীলিমায়
                আমায় দেখা দিয়েছিলে॥

৩৩ :: কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে

 কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে—
      সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়।
 ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে—
      সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়॥
 ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়,
   তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে—
      সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়॥
 কতই নামে ডেকেছি যে,   কতই ছবি এঁকেছি যে,
   কোন্‌ আনন্দে চলেছি তার ঠিকানা না পেয়ে—
      সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়।
 পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেনে রাত কাটায় জাগি
   তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে—
      সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়॥

৩৪ :: তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে আলোয় আকাশ ভরা

তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে আলোয় আকাশ ভরা।
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে ফুল্ল শ্যামল ধরা॥
     তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
     রাত্রি জাগে জগৎ লয়ে কোলে,
ঊষা এসে পূর্বদুয়ার খোলে কলকণ্ঠস্বরা॥
চলছে ভেসে মিলন-আশা-তরী অনাদিস্রোত বেয়ে।
কত কালের কুসুম উঠে ভরি বরণডালি ছেয়ে।
     তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
     যুগে যুগে বিশ্বভুবনতলে
পরান আমার বধূর বেশে চলে চিরস্বয়ম্বরা॥

৩৫ :: প্রভু তোমার বীণা যেমনি বাজে

 প্রভু,    তোমার বীণা যেমনি বাজে
            আঁধার-মাঝে
            অমনি ফোটে তারা।
 যেন     সেই বীণাটি গভীর তানে
            আমার প্রাণে
            বাজে তেমনিধারা॥
 তখন    নূতন সৃষ্টি প্রকাশ হবে
             কী গৌরবে
             হৃদয়-অন্ধকারে।
 তখন     স্তরে স্তরে আলোকরাশি
              উঠবে ভাসি
              চিত্তগগনপারে॥
 তখন     তোমারি সৌন্দর্যছবি,
              ওগো কবি,
              আমায় পড়বে আঁকা—
 তখন     বিস্ময়ের রবে না সীমা,
              ওই মহিমা
              আর যাবে না ঢাকা।
 তখন     তোমারি প্রসন্ন হাসি
              পড়বে আসি
              নবজীবন-’পরে।
 তখন      আনন্দ-অমৃতে তব
              ধন্য হব
              চিরদিনের তরে॥

৩৬ :: তুমি একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে

 তুমি    একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে
              প্রভু,   আমার জীবনে!
 তোমার   পরশরতন গেঁথে গেঁথে আমায় সাজালে
               প্রভু,   গভীর গোপনে॥
 দিনের আলোর আড়াল টানি   কোথায় ছিলে নাহি জানি,
                অস্তরবির তোরণ হতে চরণ বাড়ালে
                    আমার  রাতের স্বপনে॥
 আমার   হিয়ায় হিয়ায় বাজে আকুল আঁধার যামিনী,
                 সে যে  তোমার বাঁশরি।
 আমি    শুনি তোমার আকাশপারের তারার রাগিণী,
                 আমার সকল পাশরি।
 কানে আসে আশার বাণী— খোলা পাব দুয়ারখানি
             রাতের শেষে শিশির-ধোওয়া প্রথম সকালে
                  তোমার  করুণ কিরণে॥

৩৭ :: শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়

শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো॥
সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা—
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়ো॥
হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়,
বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তার যা-কিছু সঞ্চয়।
হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো, দাও গো আমার হাতে—
ধরব তারে, ভরব তারে, রাখব তারে সাথে,
একলা পথে চলা আমার করব রমণীয়॥

৩৮ :: তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও সে ঘুম আমার রমণীয়

তোমার   সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও সে ঘুম আমার রমণীয়—
            জাগরণের সঙ্গিনী সে, তারে তোমার পরশ দিয়ো॥
            অন্তরে তার গভীর ক্ষুধা,   গোপনে চায় আলোকসুধা,
            আমার রাতের বুকে সে যে তোমার প্রাতের আপন প্রিয়॥
            তারি লাগি আকাশ রাঙা আঁধার-ভাঙা অরুণরাগে,
            তারি লাগি পাখির গানে নবীন আশার আলাপ জাগে।
            নীরব তোমার চরণধ্বনি   শুনায় তারে আগমনী,
            সন্ধ্যাবেলার কুঁড়ি তারে সকালবেলায় তুলে নিয়ো॥

৩৯ :: মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে

মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়ায়ে আমি
আর কতকাল এমনে কাটিবে স্বামী—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
রজনীর তারা উঠেছে গগন ছেয়ে,
আছে সবে মোর বাতায়ন-পানে চেয়ে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
জীবনে আমার সঙ্গীত দাও আনি,
নীরব রেখো না তোমার বীণার বাণী—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
মিলাব নয়ন তব নয়নের সাথে,
মিলাব এ হাত তব দক্ষিণহাতে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
হৃদয়পাত্র সুধায় পূর্ণ হবে,
তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥

৪০ :: মোর প্রভাতের এই প্রথম খনের কুসুমখানি

 মোর     প্রভাতের এই প্রথম খনের কুসুমখানি
 তুমি      জাগাও তারে ওই নয়নের আলোক হানি॥
 সে যে    দিনের বেলায় করবে খেলা হাওয়ায় দুলে,
 রাতের   অন্ধকারে নেবে তারে বক্ষে তুলে—
 ওগো     তখনি তো গন্ধে তাহার ফুটবে বাণী॥
 আমার   বীণাখানি পড়ছে আজি সবার চোখে,
 হেরো     তারগুলি তার দেখছে গুনে সকল লোকে।
 ওগো     কখন সে যে সভা ত্যেজে আড়াল হবে,
 শুধু       সুরটুকু তার উঠবে বেজে করুণ রবে—
 যখন     তুমি তারে বুকের ’পরে লবে টানি॥

৪১ :: মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল

মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল
      মাথায় আমার ধরতে দাও,  ওগো,  ধরতে দাও।
ওই মাধুরীসরোবরের নাই যে কোথাও তল,
      হোথায় আমায় ডুবতে দাও,  ওগো,  মরতে দাও॥
দাও গো মুছে আমার ভালে অপমানের লিখা;
নিভৃতে আজ, বন্ধু, তোমার আপন হাতের টিকা
      ললাটে মোর পরতে দাও,  ওগো,  পরতে দাও॥
বহুক তোমার ঝড়ের হাওয়া আমার ফুলবনে,
      শুকনো পাতা মলিন কুসুম ঝরতে দাও।
পথ জুড়ে যা পড়ে আছে আমার এ জীবনে
      দাও গো তাদের সরতে দাও,  ওগো,  সরতে দাও।
তোমার মহাভাণ্ডারেতে আছে অনেক ধন—
কুড়িয়ে বেড়াই মুঠা ভ’রে, ভরে না তায় মন,
      অন্তরেতে জীবন আমার ভরতে দাও॥

৪২ :: এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে

     এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
         কী উৎসবের লগনে॥
সব আলোটি কেমন ক’রে   ফেল আমার মুখের ’পরে,
    তুমি  আপনি থাকো আলোর পিছনে॥
        প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয়-গগনে
           কী উৎসবের লগনে
সব আলো তার কেমন ক’রে   পড়ে আমার মুখের ’পরে
    আমি  আপনি পড়ি আলোর পিছনে॥

৪৩ :: কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে

          কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
                 আজ    ফাগুন-দিনের সকালে॥
তার    বর্ণে তোমার নামের রেখা   গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,
              সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে    
                 আজ    ফাগুন-দিনের সকালে॥
              গানটি তোমার চলে এল আকাশে
                 আজ    ফাগুন-দিনের বাতাসে।
ওগো,   আমার নামটি তোমার সুরে  কেমন করে দিলে জুড়ে
              লুকিয়ে তুমি ওই গানেরই আড়ালে
                 আজ    ফাগুন-দিনের সকালে॥

৪৪ :: বল তো এইবারের মতো

         বল তো এইবারের মতো
প্রভু, তোমার আঙিনাতে তুলি আমার ফসল যত॥
কিছু-বা ফল গেছে ঝরে,   কিছু-বা ফল আছে ধরে,
         বছর হয়ে এল গত—
রোদের দিনে ছায়ায় বসে   বাজায় বাঁশি রাখাল যত॥
         হুকুম তুমি কর যদি
চৈত্র-হাওয়ায় পাল তুলে দিই—  ওই-যে মেতে ওঠে নদী।
পার ক’রে নিই ভরা তরী,   মাঠের যা কাজ সারা করি,
         ঘরের কাজে হই গো রত—
এবার আমার মাথার বোঝা   পায়ে তোমার করি নত॥

৪৫ :: তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ

 তোমায়    নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ
 ও মোর    ভালোবাসার ধন।
               দেখা দেবে ব’লে তুমি হও যে অদর্শন
 ও মোর    ভালোবাসার ধন॥
 ওগো,      তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের—
               ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন
 ও মোর   ভালোবাসার ধন॥
 আমি      তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন—
               প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।
 তোমার    শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে—
               ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন
               ও মোর   ভালোবাসার ধন॥

৪৬ :: ধীরে বন্ধু ধীরে ধীরে

      ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে
          চলো তোমার বিজনমন্দিরে॥
জানি নে পথ, নাই যে আলো,  ভিতর বাহির কালোয় কালো,
          তোমার চরণশব্দ বরণ করেছি
           আজ এই অরণ্যগভীরে॥
               ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে
          চলো  অন্ধকারের তীরে তীরে।
   চলব আমি নিশীথরাতে  তোমার হাওয়ার ইশারাতে,
          তোমার  বসনগন্ধ বরণ করেছি
             আজ এই  বসন্তসমীরে॥

৪৭ :: এবার আমায় ডাকলে দূরে

               এবার আমায় ডাকলে দূরে
               সাগর-পারের গোপন পুরে॥
বোঝা আমার নামিয়েছি যে,   সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
      স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে তৃষ্ণাতুরে॥
               আমার সন্ধ্যাফুলের মধু
             এবার যে ভোগ করবে বঁধু।
  তারার আলোর প্রদীপখানি   প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
     আমার যত কথা ছিল ভেসে যাবে তোমার সুরে॥

৪৮ :: দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল

দুঃখের বরষায়  চক্ষের জল যেই  নামল
বক্ষের দরজায়  বন্ধুর রথ সেই  থামল॥
মিলনের পত্রটি  পূর্ণ যে বিচ্ছেদ  -বেদনায়;
অর্পিনু হাতে তার,  খেদ নাই আর মোর  খেদ নাই॥
বহুদিনবঞ্চিত  অন্তরে সঞ্চিত  কী আশা,
চক্ষের নিমেষেই  মিটল সে পরশের  তিয়াষা।
এত দিনে জানলেম  যে কাঁদন কাঁদলেম  সে কাহার জন্য।
ধন্য এ জাগরণ,  ধন্য এ ত্রন্দন, ধন্য রে ধন্য॥

৪৯ :: সে দিনে আপদ আমার যাবে কেটে

সে দিনে           আপদ আমার যাবে কেটে
পুলকে             হৃদয় যেদিন পড়বে ফেটে॥
তখন       তোমার গন্ধ তোমার মধু  আপনি বাহির হবে বঁধু হে,
তারে       আমার ব’লে ছলে বলে  কে বলো আর রাখবে এঁটে॥
আমারে    নিখিল ভুবন দেখছে চেয়ে রাত্রিদিবা।
আমি কি          জানি নে তার অর্থ কিবা!
তারা যে   জানে আমার চিত্তকোষে  অমৃতরূপ আছে বসে গো—
তারেই     প্রকাশ করি, আপনি মরি,  তবে আমার দুঃখ মেটে॥

৫০ :: আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি

আমার  হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে  দেখতে আমি পাই নি।
              তোমায়   দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,   আমার   হৃদয়-পানে চাই নি॥
         আমার সকল ভালোবাসায়   সকল আঘাত সকল আশায়
         তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি॥
         তুমি মোর আনন্দ হয়ে  ছিলে আমার খেলায়—
         আনন্দে তাই ভুলেছিলেম,  কেটেছে দিন হেলায়।
         গোপন রহি গভীর প্রাণে  আমার দুঃখসুখের গানে
         সুর দিয়েছ তুমি, আমি  তোমার গান তো গাই নি॥

৫১ :: কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধুলো যত

কেন   চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না  শুকনো ধুলো যত!
         কে জানিত আসবে তুমি গো  অনাহূতের মতো॥
         পার হয়ে এসেছ মরু,  নাই যে সেথায় ছায়াতরু—
         পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো  এমন ভাগ্যহত॥
         আলসেতে বসেছিলেম আমি  আপন ঘরের ছায়ে,
         জানি নাই যে তোমায় কত ব্যথা  বাজবে পায়ে পায়ে।
         ওই বেদনা আমার বুকে  বেজেছিল গোপন দুখে—
         দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো  গভীর হৃদয়ক্ষত॥

৫২ :: আমায় বাঁধবে যদি কাজের ডোরে

    আমায়   বাঁধবে যদি কাজের ডোরে
    কেন      পাগল কর এমন ক’রে?।
বাতাস আনে কেন জানি     কোন্‌ গগনের গোপন বাণী,
                 পরানখানি দেয় যে ভ’রে॥
সোনার আলো কেমনে হে,    রক্তে নাচে সকল দেহে।
কারে পাঠাও ক্ষণে ক্ষণে     আমার খোলা বাতায়নে,
                  সকল হৃদয় লয় যে হ’রে॥

৫৩ :: ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু

ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু,
      তোমার নামে বাজায় যারা বেণু॥
পাষাণ দিয়ে বাঁধা ঘাটে  এই-যে কোলাহলের হাটে
      কেন আমি কিসের লোভে এনু॥
কী ডাক ডাকে বনের পাতাগুলি,  কার ইশারা -তৃণের অঙ্গুলি!
প্রাণেশ আমার লীলাভরে  খেলেন প্রাণের খেলাঘরে,
      পাখির মুখে এই-যে খবর পেনু॥

৫৪ :: আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব

  আমারে তুমি অশেষ করেছ,  এমনি লীলা তব—
  ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ,  জীবন নব নব॥
     কত-যে গিরি কত-যে নদী -তীরে
     বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
     কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
        কাহারে তাহা কব॥
 তোমারি ওই অমৃতপরশে  আমার হিয়াখানি
 হারালো সীমা বিপুল হরষে,  উথলি উঠে বাণী।
     আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
     দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী—
     হল না সারা কত-না যুগ ধরি
        কেবলই আমি লব॥

৫৫ :: প্রভু বলো বলো কবে

                      প্রভু, বলো বলো কবে
তোমার  পথের ধুলার রঙে রঙে আঁচল রঙিন হবে।
             তোমার বনের রাঙা ধূলি  ফুটায় পূজার কুসুমগুলি,
             সেই ধূলি হায় কখন আমায় আপন করি লবে?
             প্রণাম দিতে চরণতলে  ধুলার কাঙাল যাত্রীদলে
             চলে যারা, আপন ব’লে চিনবে আমায় সবে॥

৫৬ :: আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে

 আমার   না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
                    তোমার ভাবনা তারার মতন রাজে॥
               নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
               না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
 আমার    লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে—
                    অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে॥
                 ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান
                     তোমায় আমার গান।
                 পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে,
                 জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে—
     তুমি     অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে
                    প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে॥

৫৭ :: আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও

আমার    হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও,
         কে আমারে কী-যে বলে ভোলাও ভোলাও॥
    ওরা কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে,
         বাঁশির ডাকে সকল বাঁধন খোলাও॥
         মনে পড়ে, কত-না দিন রাতি
         আমি ছিলেম তোমার খেলার সাথি।
    আজকে তুমি তেমনি ক’রে  সামনে তোমার রাখো ধরে,
         আমার প্রাণে খেলার সে ঢেউ তোলাও॥

৫৮ :: ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে

ভেঙে মোর   ঘরের চাবি    নিয়ে যাবি    কে আমারে
                 ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে  তোমার দেখা,  একা একা  দিন যে আমার কাটে না রে॥
                 বুঝি গো  রাত পোহালো,
                 বুঝি ওই  রবির আলো
                 আভাসে  দেখা দিল গগন-পারে—
সমুখে    ওই হেরি পথ,  তোমার কি রথ  পৌঁছবে না মোর দুয়ারে॥
                 আকাশের  যত তারা
                 চেয়ে রয়  নিমেষহারা,
                 বসে রয়  রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি  দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
                 প্রভাতের  পথিক সবে
                 এল কি  কলরবে—
                 গেল কি  গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা  ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে  অরুণবীণার তারে তারে॥

৫৯ :: তোমায় কিছু দেব ব’লে চায় যে আমার মন

তোমায় কিছু দেব ব’লে চায় যে আমার মন,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
যখন তোমার পেলেম দেখা, অন্ধকারে একা একা
   ফিরতেছিলে বিজন গভীর বন।
ইচ্ছা ছিল একটি বাতি জ্বালাই তোমার পথে,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
দেখেছিলেম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি,
   গায়ে তোমার ছড়ায় ধুলাবালি।
অপমানের পথের মাঝে  তোমার বীণা নিত্য বাজে
   আপন-সুরে-আপনি-নিমগন।
ইচ্ছা ছিল বরণমালা পরাই তোমার গলে,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
দলে দলে আসে লোকে, রচে তোমার স্তব—
   নানা ভাষায় নানান কলরব।
ভিক্ষা লাগি তোমার দ্বারে  আঘাত করে বারে বারে
   কত-যে শাপ, কত-যে ত্রন্দন।
ইচ্ছা ছিল বিনা পণে আপনাকে দিই পায়ে,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥

৬০ :: আমার অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা

আমার    অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা।
আজ      নিশিশেষে শেষ করে দিই চোখের জলের পালা॥
আমার    কঠিন হৃদয়টারে ফেলে   দিলেম পথের ধারে,
তোমার   চরণ দেবে তারে মধুর   পরশ পাষাণ-গালা॥
ছিল       আমার আঁধারখানি,   তারে তুমিই নিলে টানি,
তোমার   প্রেম এল যে আগুন হয়ে— করল তারে আলা।
সেই-যে   আমার কাছে আমি   ছিল   সবার চেয়ে দামি,
তারে      উজাড় করে সাজিয়ে দিলেম   তোমার বরণডালা॥

৬১ :: তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে

তুমি       খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে
তোমার   আঙিনাতে বেড়াই যখন গেয়ে গেয়ে॥
             তোমার পরশ আমার মাঝে  সুরে সুরে বুকে বাজে,
             সেই আনন্দ নাচায় ছন্দ  বিশ্বভুবন ছেয়ে ছেয়ে॥
             ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে নাড়া,
             গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া দেয় সে সাড়া।
             তোমার আঁধার তোমার আলো দুই আমারে লাগল ভালো—
             আমার হাসি বেড়ায় ভাসি  তোমার হাসি বেয়ে বেয়ে॥

৬২ :: আমার সকল রসের ধারা

                আমার সকল রসের ধারা
           তোমাতে আজ হোক-না হারা॥
 জীবন জুড়ে লাগুক পরশ,   ভুবন ব্যেপে জাগুক হরষ,
   তোমার রূপে মরুক ডুবে   আমার দুটি আঁখিতারা॥
             হারিয়ে-যাওয়া মনটি আমার
             ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার॥
 ছড়িয়ে-পড়া আশাগুলি   কুড়িয়ে তুমি লও গো তুলি,
   গলার হারে দোলাও তারে   গাঁথা তোমার ক’রে সারা॥

৬৩ :: রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে

           রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
        তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে॥
 সেইখানেতে সাদায় কালোয়    মিলে গেছে আঁধার আলোয়—
         সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে॥
          নিতলনীল নীরব-মাঝে বাজল গভীর বাণী,
          নিকষেতে উঠল ফুটে সোনার রেখাখানি।
 মুখের পানে তাকাতে যাই,    দেখি-দেখি দেখতে না পাই—
        স্বপন-সাথে জড়িয়ে জাগা, কাঁদি আকুল ধারে॥

৬৪ :: আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে

 আমার   খেলা যখন ছিল তোমার সনে
                 তখন     কে তুমি তা কে জানত।
 তখন     ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
                জীবন     বহে যেত অশান্ত॥
 তুমি      ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
               যেন আমার আপন সখার মতো,
 হেসে     তোমার সাথে ফিরেছিলেম ছুটে
               সে দিন কত-না বন-বনান্ত॥
 ওগো,    সেদিন তুমি গাইতে যে-সব গান
                কোনো     অর্থ তাহার কে জানত।
 শুধু       সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,
                সদা     নাচত হৃদয় অশান্ত।
 হঠাৎ     খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি—
                স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
 তোমার   চরণ-পানে নয়ন করি নত
                 ভুবন     দাঁড়িয়ে আছে একান্ত॥

৬৫ :: সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর

 সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর—
 আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর॥
 কত বর্ণে কত গন্ধে     কত গানে কত ছন্দে
 অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর।
 আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর॥
 তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় খুলে,
 বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে।
 তোমার আলোয় নাই তো ছায়া,     আমার মাঝে পায় সে কায়া,
 হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দরবিধুর।
 আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর॥

৬৬ :: আজি যত তারা তব আকাশে

              আজি   যত তারা তব আকাশে
              সবে   মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে॥
 নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া,   মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে,
        তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত   আমারি অঙ্গে বিকাশে॥
 দিকে দিগন্তে যত আনন্দ   লভিয়াছে এক গভীর গন্ধ,
        আমার চিত্তে মিলি একত্রে   তোমার মন্দিরে উছাসে।
              আজি কোনোখানে কারেও না জানি,
              শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে,
        নিখিল নিশ্বাস আজি এ বক্ষে   বাঁশরির সুরে বিলাসে॥

৬৭ :: আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো

 আমি   কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো—
                আমার   জুড়ালো হৃদয় প্রভাতে।
 আমি   কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো—
                ডুবিয়া   নিবিড় গভীর শোভাতে॥
 আজ   গিয়েছি সবার মাঝারে, সেথায় দেখেছি আলোক-আসনে—
                দেখেছি   আমার হৃদয়রাজারে।
 আমি   দুয়েকটি কথা কয়েছি তা সনে সে নীরব সভা-মাঝারে—
                দেখেছি   চিরজনমের রাজারে॥
 এই   বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে, আলোক আমার তনুতে
                কেমনে   মিলে গেছে মোর তনুতে—
 তাই   এ গগন-ভরা প্রভাত পশিল আমার অণুতে অণুতে।
 আজ   ত্রিভুবন-জোড়া কাহার বক্ষে দেহ মন মোর ফুরালো—
                যেন রে   নিঃশেষে আজি ফুরালো।
 আজ   যেখানে যা হেরি সকলেরই মাঝে জুড়ালো জীবন জুড়ালো—
                আমার   আদি ও অন্ত জুড়ালো॥

৬৮ :: প্রভু আমার প্রিয় আমার পরম ধন হে

         প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে।
         চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে॥
 তৃপ্তি আমার, অতৃপ্তি মোর,   মুক্তি আমার, বন্ধনডোর,
         দুঃখসুখের চরম আমার জীবন মরণ হে॥
         আমার সকল গতির মাঝে পরম গতি হে,
         নিত্য প্রেমের ধামে আমার পরম পতি হে।
 ওগো সবার, ওগো আমার,   বিশ্ব হতে চিত্তে বিহার—
         অন্তবিহীন লীলা তোমার নূতন নূতন হে॥

৬৯ :: তুমি বন্ধু তুমি নাথ নিশিদিন তুমি আমার

 তুমি বন্ধু, তুমি নাথ, নিশিদিন তুমি আমার।
 তুমি সুখ, তুমি শান্তি, তুমি হে অমৃতপাথার॥
 তুমিই তো আনন্দলোক,  জুড়াও প্রাণ, নাশো শোক,
 তাপহরণ তোমার চরণ অসীমশরণ দীনজনার॥

৭০ :: ও অকূলের কূল ও অগতির গতি

 ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি,
 ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি।
 ও নয়নের আলো, ও রসনার মধু,
 ও রতনের হার, ও পরানের বঁধু।
 ও অপরূপ রূপ, ও মনোহর কথা,
 ও চরমের সুখ, ও মরমের ব্যথা।
 ও ভিখারির ধন, ও অবোলার বোল—
 ও জনমের দোলা, ও মরণের কোল॥

৭১ :: আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি

         আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি।
         আপন-মনে আমারি পটে আঁকো মানস ছবি॥
 তাপস তুমি ধেয়ানে তব   কী দেখ মোরে কেমনে কব,
         আপন-মনে মেঘস্বপন আপনি রচ রবি।
         তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী।
         তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা—
         নিজেরে তুমি ভোলাবে ব’লে আমারে নিয়ে খেলা।
 কণ্ঠে মম কী কথা শোন   অর্থ আমি বুঝি না কোনো,
         বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী।
         মুকুল মম সুবাসে তব গোপনে সৌরভী॥

৭২ :: ভুলে যাই থেকে থেকে

 ভুলে যাই   থেকে থেকে
 তোমার   আসন-’পরে বসাতে চাও   নাম আমাদের হেঁকে হেঁকে॥
 দ্বারী মোদের চেনে না যে,   বাধা দেয় পথের মাঝে।
 বাহিরে  দাঁড়িয়ে আছি,   লও ভিতরে ডেকে ডেকে॥
 মোদের  প্রাণ দিয়েছ আপন হাতে, মান দিয়েছ তারি সাথে।
 থেকেও সে মান  থাকে না যে লোভে আর  ভয়ে লাজে—
 ম্লান হয় দিনে দিনে,   যায় ধুলাতে  ঢেকে ঢেকে॥

৭৩ :: তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে

            তোমার   এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে,
            আমার   প্রাণে নইলে সে কি কোথাও ধরবে?।
 এই-যে আলো সূর্যে গ্রহে তারায়   ঝ’রে পড়ে শতলক্ষ ধারায়,
               পূর্ণ হবে এ প্রাণ যখন ভরবে॥
 তোমার   ফুলে যে রঙ ঘুমের মতো লাগল
 আমার   মনে লেগে তবে সে যে জাগল গো।
 যে প্রেম কাঁপায় বিশ্ববীণায় পুলকে  সঙ্গীতে সে উঠবে হেসে পলকে
              যে দিন আমার সকল হৃদয় হরবে॥

৭৪ :: এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে

       এরে  ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে,
            হাসিতে আকাশ ভরিলে॥
 পথে পথে ফেরে, দ্বারে দ্বারে যায়,  ঝুলি ভরি রাখে যাহা-কিছু পায়—
 কতবার তুমি পথে এসে, হায়,   ভিক্ষার ধন হরিলে॥
 ভেবেছিল চির-কাঙাল সে এই ভুবনে,   কাঙাল মরণে জীবনে।
 ওগো মহারাজা, বড়ো ভয়ে ভয়ে   দিনেশষে এল তোমারি আলয়ে—
 আধেক আসনে তারে ডেকে লয়ে  নিজ মালা দিয়ে বরিলে॥

৭৫ :: আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না

 আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
    এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা॥
 কত জনম-মরণেতে  তোমারি ওই চরণেতে
    আপনাকে যে দেব, তবু   বাড়বে দেনা॥
    আমারে যে নামতে হবে   ঘাটে ঘাটে,
    বারে বারে এই ভুবনের   প্রাণের হাটে।
 ব্যবসা মোর তোমার সাথে  চলবে বেড়ে দিনে রাতে,
    আপনা নিয়ে করব যতই বেচা কেনা॥

৭৬ :: তুমি যে এসেছ মোর ভবনে রব উঠেছে ভুবনে॥

      তুমি যে  এসেছ মোর ভবনে  রব উঠেছে ভুবনে॥
 নহিলে ফুলে কিসের রঙ লেগেছে,   গগনে কোন্‌ গান জেগেছে,
             কোন্‌ পরিমল পবনে॥
    দিয়ে    দুঃখসুখের বেদনা  আমায় তোমার সাধনা।
 আমার   ব্যথায় ব্যথায় পা ফেলিয়া  এলে তোমার সুর মেলিয়া,
            এলে আমার জীবনে॥

৭৭ :: তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভ’রে

 তুমি যে           চেয়ে আছ        আকাশ ভ’রে
 নিশিদিন         অনিমেষে         দেখছ মোরে॥
 আমি চোখ      এই আলোকে   মেলব যবে
 তোমার ওই     চেয়ে-দেখা       সফল হবে,
 এ আকাশ       দিন গুনিছে      তারি তরে॥
 ফাগুনের        কুসুম-ফোটা     হবে ফাঁকি
 আমার এই     একটি কুঁড়ি       রইলে বাকি।
 সে দিনে         ধন্য হবে            তারার মালা
 তোমার এই    লোকে লোকে     প্রদীপ জ্বালা
 আমার এই     আঁধারটুকু         ঘুচলে পরে॥

৭৮ :: আমার বাণী আমার প্রাণে লাগে

    আমার বাণী আমার প্রাণে লাগে—
 যত তোমায় ডাকি, আমার   আপন হৃদয় জাগে॥
 শুধু তোমায় চাওয়া  সেও আমার পাওয়া,
 তাই তো পরান পরানপণে হাত বাড়িয়ে মাগে॥
    হায় অশক্ত, ভয়ে থাকিস পিছে।
 লাগলে সেবায় অশক্তি তোর   আপনি হবে মিছে।
    পথ দেখাবার তরে যাব কাহার ঘরে—
 যেমনি আমি চলি, তোমার   প্রদীপ চলে আগে॥

৭৯ :: অসীম ধন তো আছে তোমার তাহে সাধ না মেটে

 অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে।
 নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে॥
 দিয়ে রতন মণি, দিয়ে  তোমার রতন মণি  আমায় করলে ধনী—
        এখন  দ্বারে এসে ডাকো,  রয়েছি দ্বার এঁটে॥
        আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে—
        বিশ্বভুবন মাতাল যে তাই হাসির কলরবে।
 তুমি  রইবে না ওই রথে, তুমি  রইবে না ওই রথে  নামবে ধুলাপথে—
        যুগ-যুগান্ত আমার সাথে চলবে হেঁটে হেঁটে॥

৮০ :: যদি আমায় তুমি বাঁচাও তবে

 যদি        আমায় তুমি বাঁচাও, তবে
 তোমার   নিখিল ভুবন ধন্য হবে॥
 যদি        আমার মনের মলিন কালী  ঘুচাও পুণ্যসলিল ঢালি
 তোমার   চন্দ্র সূর্য নূতন আলোয়  জাগবে জ্যোতির মহোৎসবে॥
 আজও   ফোটে নি মোর শোভার কুঁড়ি,
 তারি       বিষাদ আছে জগৎ জুড়ি।
 যদি        নিশার তিমির গিয়া টুটে  আমার হৃদয় জেগে উঠে
 তবে       মুখর হবে সকল আকাশ  আনন্দময় গানের রবে॥

৮১ :: যিনি সকল কাজের কাজী মোরা তাঁরি কাজের সঙ্গী

 যিনি   সকল কাজের কাজী, মোরা তাঁরি কাজের সঙ্গী।
 যাঁর   নানা রঙের রঙ্গ, মোরা তাঁরি রসের রঙ্গী॥
                 তাঁর   বিপুল ছন্দে ছন্দে
                 মোরা  যাই চলে আনন্দে,
 তিনি   যেমনি বাজান ভেরী মোদের তেমনি নাচের ভঙ্গী॥
                 এই   জন্ম-মরণ-খেলায়
                 মোরা  মিলি তাঁরি মেলায়,
 এই   দুঃখসুখের জীবন মোদের তাঁরি খেলার অঙ্গী।
                 ওরে   ডাকেন তিনি যবে
                 তাঁর   জলদ-মন্দ্র রবে
 ছুটি   পথের কাঁটা পায়ে দ’লে সাগর গিরি লঙ্ঘি॥

৮২ :: আমরা তারেই জানি তারেই জানি সাথের সাথি

 আমরা    তারেই জানি তারেই জানি সাথের সাথি,
    তারেই করি টানাটানি দিবারাতি॥
       সঙ্গে তারি চরাই ধেনু,
          বাজাই বেণু,
    তারি লাগি বটের ছায়ায় আসন পাতি॥
       তারে হালের মাঝি করি
          চালাই তরী,
    ঝড়ের বেলায় ঢেউয়ের খেলায় মাতামাতি।
       সারা দিনের কাজ ফুরালে
          সন্ধ্যাকালে
    তাহারি পথ চেয়ে ঘরে জ্বালাই বাতি॥

৮৩ :: যা হবার তা হবে

                       যা হবার তা হবে।
     যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে?।
 পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে   পথ যে কোথায় সেই তা জানে,
     ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায়— সেই তো ঘরে লবে॥

৮৪ :: অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে

   অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।
   কখন্‌ তুমি এলে, হে নাথ, মৃদু চরণপাতে?।
 ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী,   তোমায় বুঝি হারাই আমি—
   আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে॥
   যে নিশীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো
   তারি মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো।
 তোমার পথে চলা যখন   ঘুচে গেল দেখি তখন
   আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে॥

৮৫ :: হে মোর দেবতা ভরিয়া এ দেহ প্রাণ

 হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
 কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান?।
    আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
    দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি,
    আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
       শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান॥
    আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
    রচিয়া তুলিছে বিচিত্র তব বাণী।
       তারি সাথে, প্রভু, মিলিয়া তোমার প্রীতি
       জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি—
       আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
          আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান॥

৮৬ :: শুধু কি তার বেঁধেই তোর কাজ ফুরাবে

 শুধু কি     তার বেঁধেই তোর কাজ ফুরাবে
                গুণী মোর, ও গুণী!
                বাঁধা বীণা রইবে পড়ে এমনি ভাবে,
                গুণী মোর, ও গুণী!
 তা হলে    হার হল যে হার হল,
 শুধু          বাঁধাবাঁধিই সার হল, গুণী মোর, ও গুণী!
 বাঁধনে      যদি তোমার হাত লাগে
                তা হলেই সুর জাগে,  গুণী মোর, ও গুণী!
 না হলে     ধুলায় পড়ে লাজ কুড়াবে॥

৮৭ :: আমারে তুমি কিসের ছলে পাঠাবে দূরে

      আমারে তুমি কিসের ছলে পাঠাবে দূরে,
      আবার আমি চরণতলে আসিব ঘুরে॥
 সোহাগ করে করিছ হেলা     টানিবে ব’লে দিতেছ ঠেলা—
      হে রাজা, তব কেমন খেলা রাজ্য জুড়ে॥

৮৮ :: সভায় তোমার থাকি সবার শাসনে

              সভায় তোমার থাকি সবার শাসনে,
 আমার   কণ্ঠে সেথায় সুর কেঁপে যায় ত্রাসনে॥
              তাকায় সকল লোকে,
 তখন     দেখতে না পাই চোখে
 কোথায়  অভয় হাসি হাসো আপন আসনে॥
              কবে আমার এ লজ্জাভয় খসাবে,
 তোমার   একলা ঘরের নিরালাতে বসাবে।
              যা শোনাবার আছে
 গাব       ওই চরণের কাছে,
 দ্বারের    আড়াল হতে শোনে বা কেউ না-শোনে॥

৮৯ :: তোমার প্রেমে ধন্য কর যারে সত্য ক’রে পায় সে আপনারে॥

 তোমার প্রেমে ধন্য কর যারে   সত্য ক’রে পায় সে আপনারে॥
                দুঃখে শোকে নিন্দা-পরিবাদে
                চিত্ত তার ডোবে না অবসাদে,
                   টুটে না বল সংসারের ভারে॥
 পথে যে তার গৃহের বাণী বাজে,   বিরাম জাগে কঠিন তার কাজে।
                নিজেরে সে যে তোমারি মাঝে দেখে,
                জীবন তার বাধায় নাহি ঠেকে,
                   দৃষ্টি তার আঁধার-পরপারে॥

৯০ :: লুকিয়ে আস আঁধার রাতে তুমি আমার বন্ধু

 লুকিয়ে আস আঁধার রাতে, তুমি আমার বন্ধু!
 লও যে টেনে কঠিন হাতে, তুমি আমার আনন্দ॥
 দুঃখরথের তুমিই রথী, তুমিই আমার বন্ধু।
 তুমি সঙ্কট তুমিই ক্ষতি, তুমিই আমার আনন্দ॥
 শত্রু আমারে করো গো জয়, তুমিই আমার বন্ধু।
 রুদ্র তুমি হে ভয়ের ভয়, তুমি আমার আনন্দ॥
 বজ্র এসো হে বক্ষ চিরে, তুমিই আমার বন্ধু।
 মৃত্যু লও হে বাঁধন ছিঁড়ে, তুমি আমার আনন্দ॥

৯১ :: তুমি কি এসেছ মোর দ্বারে

     তুমি কি এসেছ মোর দ্বারে
     খুঁজিতে আমার আপনারে?।
           তোমারি যে ডাকে
 কুসুম গোপন হতে বাহিরায় নগ্ন শাখে শাখে,
     সেই ডাকে ডাকো আজি তারে॥
     তোমারি সে ডাকে বাধা ভোলে,
 শ্যামল গোপন প্রাণ ধূলি-অবগুণ্ঠন খোলে
           সে ডাকে তোমারি
 সহসা নবীন ঊষা আসে হাতে আলোকের ঝারি,
     দেয় সাড়া ঘন অন্ধকারে॥

৯২ :: আজ আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও

 আজ     আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
              আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও॥
 যে জন   আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে
 আজ      এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে
 এই         অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও।
               বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া  আলোয়-পাগল প্রভাত হাওয়া,
               সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও॥
 আজ      নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে  দাও,
               মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে  দাও।
 আমার    পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান—
 তার        নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান।
 তারে       আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও।
               বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া  প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া,
               সেই  হাওয়াতে হৃদয়  আমার নুইয়ে  দাও॥

৯৩ :: এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে

 এ অন্ধকার  ডুবাও তোমার  অতল অন্ধকারে
              ওহে     অন্ধকারের  স্বামী।
 এসো  নিবিড়, এসো  গভীর,  এসো  জীবন-পারে
              আমার   চিত্তে এসো নামি।
 এ দেহ  মন মিলায়ে  যাক, হইয়া  যাক হারা
              ওহে     অন্ধকারের  স্বামী।
 বাসনা  মোর,  বিকৃতি  মোর, আমার  ইচ্ছাধারা
              ওই     চরণে  যাক থামি।
 নির্বাসনে  বাঁধা  আছি  দুর্বাসনার  ডোরে
              ওহে     অন্ধকারের  স্বামী।
 সব  বাঁধনে তোমার  সাথে বন্দী  করো মোরে
              ওহে    আমি  বাঁধন-কামী।
 আমার  প্রিয়,  আমার শ্রেয়, আমার  হে পরম,
              ওহে    অন্ধকারের  স্বামী,
 সকল ঝরে সকল  ভরে আসুক সে  চরম—
              ওগো,   মরুক-না এই  আমি॥

৯৪ :: ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা

            ধায়  যেন মোর সকল  ভালোবাসা
 প্রভু,    তোমার পানে, তোমার  পানে,  তোমার পানে।
            যায়  যেন মোর সকল  গভীর আশা
 প্রভু,    তোমার কানে, তোমার  কানে,  তোমার  কানে॥
            চিত্ত  মম যখন যেথা  থাকে    সাড়া যেন দেয়  সে তব ডাকে,
            যত  বাঁধন সব টুটে  গো যেন
 প্রভু,    তোমার টানে, তোমার  টানে,  তোমার  টানে॥
            বাহিরের  এই ভিক্ষা-ভরা  থালি    এবার যেন নিঃশেষে  হয় খালি,
            অন্তর  মোর গোপনে যায়  ভরে
 প্রভু,    তোমার দানে, তোমার  দানে,  তোমার দানে।
            হে  বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,   এ  জীবনে যা-কিছু  সুন্দর
            সকলই  আজ বেজে উঠুক  সুরে
 প্রভু,    তোমার গানে, তোমার  গানে,  তোমার  গানে॥

৯৫ :: জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো

          জীবন  যখন শুকায়ে  যায় করুণাধারায়  এসো।
          সকল  মধুরী লুকায়ে  যায়,   গীতসুধারসে এসো॥
   কর্ম  যখন  প্রবল-আকার   গরজি  উঠিয়া ঢাকে চারিধার
          হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ,   শান্ত  চরণে এসো॥
   আপনারে  যবে করিয়া  কৃপণ   কোণে পড়ে  থাকে দীনহীন  মন
          দুয়ার  খুলিয়া,  হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।
   বাসনা  যখন বিপুল  ধুলায়    অন্ধ করিয়া অবোধে  ভুলায়,
          ওহে  পবিত্র,  ওহে অনিদ্র, রুদ্র  আলোকে এসো॥

৯৬ :: পাত্রখানা যায় যদি যাক ভেঙেচুরে

             পাত্রখানা  যায় যদি যাক ভেঙেচুরে—
 আছে    অঞ্জলি  মোর, প্রসাদ  দিয়ে দাও-না  পূরে॥
             সহজ  সুখের সুধা  তাহার মূল্য  তো নাই,
             ছড়াছড়ি  যায় সে-যে  ওই যেখানে চাই—
             বড়ো-আপন  কাছের জিনিস রইল দূরে।
             হৃদয়  আমার সহজ  সুধায় দাও-না  পূরে॥
     বারে বারে চাইব  না আর মিথ্যা  টানে
     ভাঙন-ধরা  আঁধার-করা  পিছন-পানে।
         বাসা  বাঁধার বাঁধনখানা  যাক-না  টুটে,
         অবাধ  পথের শূন্যে  আমি চলব ছুটে।
             শূন্য-ভরা  তোমার বাঁশির  সুরে সুরে
             হৃদয়  আমার সহজ  সুধায় দাও-না  পূরে॥

৯৭ :: গাব তোমার সুরে দাও সে বীণাযন্ত্র

 গাব  তোমার সুরে   দাও সে বীণাযন্ত্র,
 শুনব  তোমার বাণী   দাও সে  অমর মন্ত্র।
 করব  তোমার সেবা   দাও সে  পরম শক্তি,
 চাইব  তোমার মুখে   দাও সে  অচল ভক্তি॥
 সইব  তোমার আঘাত  দাও সে  বিপুল ধৈর্য,
 বইব  তোমার ধ্বজা    দাও সে  অটল  স্থৈর্য॥
 নেব  সকল বিশ্ব     দাও সে  প্রবল প্রাণ,
 করব  আমায় নিঃস্ব   দাও সে  প্রেমের  দান॥
 যাব  তোমার সাথে    দাও সে  দখিন হস্ত,
 লড়ব  তোমার রণে   দাও সে  তোমার  অস্ত্র॥
 জাগব  তোমার সত্যে  দাও সেই  আহ্বান।
 ছাড়ব  সুখের দাস্য,   দাও  দাও  কল্যাণ॥

৯৮ :: শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে

      শ্রাবণের     ধারার মতো পড়ুক ঝরে,  পড়ুক ঝরে
      তোমারি     সুরটি  আমার মুখের ’পরে, বুকের ’পরে॥
       পুরবের     আলোর  সাথে পড়ুক  প্রাতে দুই নয়ানে—
      নিশীথের    অন্ধকারে  গভীর ধারে  পড়ুক প্রাণে।
      নিশিদিন    এই  জীবনের সুখের ’পরে, দুখের ’পরে
       শ্রাবণের    ধারার মতো পড়ুক ঝরে,  পড়ুক ঝরে॥
   যে  শাখায়    ফুল ফোটে  না, ফল  ধরে না  একেবারে,
 তোমার  ওই    বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে  সেই শাখারে।
       যা-কিছু     জীর্ণ  আমার,  দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
         তাহারি    স্তরে স্তরে  পড়ুক ঝরে  সুরের ধারা।
       নিশিদিন    এই  জীবনের তৃষার ’পরে, ভুখের ’পরে
       শ্রাবণের     ধারার মতো পড়ুক ঝরে,  পড়ুক ঝরে॥

৯৯ :: বাজাও আমারে বাজাও

                         বাজাও  আমারে বাজাও।
   বাজালে  যে সুরে  প্রভাত-আলোরে  সেই সুরে মোরে  বাজাও॥
   যে সুর ভরিলে ভাষাভোলা  গীতে    শিশুর নবীন জীবনবাঁশিতে
            জননীর-মুখ-তাকানো  হাসিতে—  সেই সুরে  মোরে বাজাও॥
                         সাজাও  আমারে সাজাও।
            যে  সাজে সাজালে  ধরার ধূলিরে  সেই সাজে মোরে  সাজাও।
   সন্ধ্যামালতী  সাজে যে  ছন্দে    শুধু আপনারই  গোপন গন্ধে,
            যে সাজ নিজেরে ভোলে  আনন্দে—  সেই সাজে  মোরে সাজাও॥

১০০ :: তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা

 তুমি  যত ভার দিয়েছ  সে ভার    করিয়া দিয়েছ  সোজা।
 আমি যত  ভার জমিয়ে  তুলেছি    সকলই হয়েছে বোঝা।
         এ বোঝা  আমার নামাও  বন্ধু,  নামাও—
 ভারের বেগেতে  চলেছি কোথায়,   এ  যাত্রা তুমি  থামাও॥
 আপনি  যে দুখ  ডেকে আনি সে-যে    জ্বালায় বজ্রানলে—
 অঙ্গার  ক’রে  রেখে যায়, সেথা   কোনো ফল  নাহি ফলে।
         তুমি  যাহা দাও সে-যে দুঃখের  দান
         শ্রাবণধারায়  বেদনার রসে   সার্থক  করে প্রাণ।
 যেখানে  যা-কিছু  পেযেছি কেবলই   সকলই  করেছি জমা—
 যে  দেখে সে আজ  মাগে-যে  হিসাব,   কেহ  নাহি করে  ক্ষমা।
         এ বোঝা  আমার নামাও  বন্ধু নামাও—
 ভারের বেগেতে  ঠেলিয়া চলেছি,   এ  যাত্রা মোর  থামাও॥

১০১ :: দাঁড়াও আমার আঁখির আগে

               দাঁড়াও  আমার আঁখির  আগে।
               তোমার  দৃষ্টি হৃদয়ে  লাগে॥
   সমুখ-আকাশে চরাচরলোকে  এই  অপরূপ আকুল  আলোকে দাঁড়াও  হে,
     আমার  পরান পলকে পলকে  চোখে চোখে তব  দরশ মাগে॥
       এই-যে  ধরণী চেয়ে ব’সে  আছে   ইহার মাধুরী  বাড়াও হে।
          ধুলায়  বিছানো  শ্যাম  অঞ্চলে   দাঁড়াও হে  নাথ, দাঁড়াও  হে।
   যাহা-কিছু  আছে সকলই ঝাঁপিয়া, ভুবন ছাপিয়া, জীবন ব্যাপিয়া  দাঁড়াও হে।
     দাঁড়াও  যেখানে বিরহী  এ হিয়া  তোমারি  লাগিয়া একেলা  জাগে॥

১০২ :: যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু

       যদি এ  আমার হৃদয়দুয়ার  বন্ধ রহে গো কভু
       দ্বার  ভেঙে তুমি এসো  মোর প্রাণে,   ফিরিয়া  যেয়ো না প্রভু॥
 যদি  কোনো দিন এ  বীণার তারে   তব  প্রিয় নাম নাহি ঝঙ্কারে
       দয়া  করে তবু রহিয়ো  দাঁড়ায়ে,  ফিরিয়া  যেয়ো না  প্রভু॥
 যদি  কোনো দিন  তোমার  আহ্বানে   সুপ্তি  আমার চেতনা না  মানে
       বজ্রবেদনে জাগায়ো  আমারে,   ফিরিয়া  যেয়ো না  প্রভু।
 যদি  কোনো দিন  তোমার আসনে  আর-কাহারেও  বসাই যতনে,
       চিরদিবসের  হে রাজা আমার,  ফিরিয়া  যেয়ো না  প্রভু॥

১০৩ :: তোমারি রাগিণী জীবনকুঞ্জে বাজে যেন সদা বাজে গো

 তোমারি  রাগিণী জীবনকুঞ্জে   বাজে  যেন সদা বাজে  গো।
 তোমারি  আসন  হৃদয়পদ্মে   রাজে  যেন সদা রাজে  গো॥
 তব নন্দনগন্ধমোদিত   ফিরি  সুন্দর ভুবনে
 তব পদরেণু  মাখি লয়ে  তনু    সাজে যেন সদা  সাজে গো॥
 সব  বিদ্বেষ দূরে  যায় যেন তব মঙ্গলমন্ত্রে ,
 বিকাশে  মাধুরী হৃদয়ে  বাহিরে তব সঙ্গীতছন্দে।
 তব  নির্মল নীরব  হাস্য   হেরি  অম্বর ব্যাপিয়া
 তব  গৌরবে সকল  গর্ব লাজে যেন  সদা লাজে গো॥

১০৪ :: চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে

        চরণ  ধরিতে দিয়ো  গো আমারে,   নিয়ো না, নিয়ো  না সরায়ে—
        জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে   বক্ষে  ধরিব জড়ায়ে॥
  স্খলিত  শিথিল কামনার  ভার   বহিয়া বহিয়া  ফিরি কত  আর—
        নিজ  হাতে তুমি গেঁথে  নিয়ো হার,   ফেলো  না আমারে ছড়ায়ে॥
        চিরপিপাসিত  বাসনা বেদনা   বাঁচাও  তাহারে  মারিয়া।
        শেষ  জয়ে যেন হয় সে  বিজয়ী   তোমারি কাছেতে হারিয়া।
   বিকায়ে বিকায়ে  দীন আপনারে   পারি না  ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে—
        তোমারি  করিয়া নিয়ো  গো আমারে   বরণের  মালা পরায়ে॥

১০৫ :: তোমারি নাম বলব নানা ছলে

          তোমারি  নাম বলব নানা  ছলে,
   বলব  একা বসে আপন  মনের ছায়াতলে॥
   বলব  বিনা ভাষায়,   বলব  বিনা আশায়,
   বলব  মুখের হাসি  দিয়ে,   বলব  চোখের জলে॥
   বিনা  প্রয়োজনের  ডাকে    ডাকব তোমার  নাম,
   সেই  ডাকে মোর শুধু-শুধুই   পূরবে  মনস্কাম।
   শিশু  যেমন মাকে   নামের  নেশায় ডাকে,
   বলতে  পারে এই সুখেতেই   মায়ের  নাম সে বলে॥

১০৬ :: আমার এ ঘরে আপনার করে গৃহদীপখানি জ্বালো হে

 আমার এ  ঘরে আপনার  করে   গৃহদীপখানি  জ্বালো হে।
 সব দুখশোক  সার্থক হোক    লভিয়া  তোমারি  আলো হে॥
 কোণে কোণে যত লুকানো  আঁধার    মিলাবে ধন্য  হয়ে,
 তোমারি পুণ্য-আলোকে  বসিয়া   সবারে  বাসিব ভালো  হে॥
 পরশমণির  প্রদীপ তোমার,   অচপল  তার জ্যোতি
 সোনা ক’রে লবে  পলকে আমার   সকল  কলঙ্ক কালো।
 আমি যত  দীপ জ্বালিয়াছি  তাহে    শুধু জ্বালা, শুধু  কালী—
 আমার  ঘরের দুয়ার  শিয়রে   তোমারি  কিরণ ঢালো  হে॥

১০৭ :: সংসারে তুমি রাখিলে মোরে যে ঘরে

 সংসারে  তুমি রাখিলে  মোরে যে ঘরে
      সেই  ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া।
 করুণা  করিয়া  নিশিদিন নিজ  করে
      রাখিয়ো  তাহার  একটি দুয়ার  খুলিয়া॥
 মোর  সব কাজে মোর  সব অবসরে
 সে দুয়ার রবে তোমারি  প্রবেশ-তরে,
 সেথা  হতে বায়ু বহিবে  হৃদয়’পরে
      চরণ  হইতে তব পদধূলি  তুলিয়া॥
 যত  আশ্রয় ভেঙে ভেঙে যায়, স্বামী,
      এক  আশ্রয়ে রহে  যেন চিত  লাগিয়া।
 যে অনলতাপ  যখনি সহিব আমি
      এক  নাম বুকে বার বার দেয় দাগিয়া।
 যবে  দুখদিনে শোকতাপ  আসে প্রাণে
 তোমারি  আদেশ বহিয়া  যেন সে আনে,
 পরুষ  বচন যতই আঘাত  হানে
      সকল  আঘাতে তব সুর  উঠে জাগিয়া॥

১০৮ :: আমার মুখের কথা তোমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে

 আমার  মুখের কথা  তোমার    নাম দিয়ে দাও  ধুয়ে,
 আমার নীরবতায়  তোমার    নামটি রাখো  থুয়ে।
 রক্তধারার  ছন্দে আমার   দেহবীণার  তার
 বাজাক  আনন্দে  তোমার    নামেরই  ঝঙ্কার।
 ঘুমের ’পরে জেগে  থাকুক    নামের তারা  তব,
 জাগরণের  ভালে আঁকুক   অরুণলেখা  নব।
 সব  আকাঙ্ক্ষা  আশায় তোমার   নামটি জ্বলুক শিখা,
 সকল  ভালোবাসায়  তোমার    নামটি রহুক  লিখা।
 সকল  কাজের শেষে  তোমার    নামটি উঠুক ফ’লে
 রাখব কেঁদে হেসে  তোমার    নামটি বুকে  কোলে।
 জীবনপদ্মে  সঙ্গোপনে   রবে  নামের মধু,
 তোমায়  দিব মরণ-ক্ষণে   তোমারি  নাম বঁধু॥

১০৯ :: প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে

            প্রাণ  ভরিয়ে  তৃষা হরিয়ে
 মোরে   আরো আরো  আরো দাও  প্রাণ।
            তব  ভুবনে তব ভবনে
 মোরে   আরো আরো  আরো দাও  স্থান॥
            আরো  আলো আরো আলো
 এই      নয়নে, প্রভু, ঢালো।
            সুরে  সুরে বাঁশি  পূরে
 তুমি     আরো আরো  আরো দাও  তান॥
            আরো  বেদনা আরো  বেদনা
 প্রভু,     দাও  মোরে আরো  চেতনা।
            দ্বার  ছুটায়ে  বাধা টুটায়ে
 মোরে   করো  ত্রাণ মোরে  করো ত্রাণ।
            আরো  প্রেমে আরো  প্রেমে
 মোর    আমি  ডুবে যাক  নেমে।
            সুধাধারে  আপনারে
 তুমি     আরো আরো  আরো করো  দান॥

১১০ :: বল দাও মোরে বল দাও প্রাণে দাও মোর শকতি

 বল দাও মোরে বল দাও,   প্রাণে দাও মোর শকতি
 সকল হৃদয় লুটায়ে   তোমারে করিতে প্রণতি—
 সরল সুপথে ভ্রমিতে,   সব অপকার ক্ষমিতে,
 সকল গর্ব দমিতে   খর্ব করিতে কুমতি॥
 হৃদয়ে তোমারে বুঝিতে,   জীবনে তোমারে পূজিতে,
 তোমার মাঝারে খুঁজিতে   চিত্তের চিরবসতি
 তব কাজ শিরে বহিতে,   সংসারতাপ সহিতে,
 ভবকোলাহলে রহিতে,   নীরবে করিতে ভকতি॥
 তোমার বিশ্বছবিতে   তব প্রেমরূপ লভিতে,
 গ্রহ-তারা-শশী-রবিতে   হেরিতে তোমার আরতি।
 বচনমনের অতীতে   ডুবিতে তোমার জ্যোতিতে,
 সুখে দুখে লাভে ক্ষতিতে   শুনিতে তোমার ভারতী॥

১১১ :: অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে

 অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে—
 নির্মল করো, ঊজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে॥
 জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
 মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে॥
 যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।
 সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
 চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে।
 নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে॥

১১২ :: আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে

 আমার বিচার তুমি করো তব   আপন করে।
 দিনের কর্ম আনিনু তোমার    বিচারঘরে॥
 যদি পূজা করি মিছা দেবতার,   শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
 যদি পাপমনে করি অবিচার   কাহারো ’পরে,
 আমার বিচার তুমি করো তব   আপন করে॥
 লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ,   ভয়ে হয়ে থাকি ধর্মবিমুখ,
 পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ   ক্ষণেক-তরে—
 তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায়   কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়,
 আপনি বিনাশ করি আপনায়   মোহের ভরে,
 আমার বিচার তুমি করো তব   আপন করে॥

১১৩ :: তোমারি ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী

 তোমারি ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী।
 তোমারি প্রেম স্মরণে রাখি, চরণে রাখি আশা—
 দাও দুঃখ, দাও তাপ, সকলই সহিব আমি॥
 তব প্রেম-আঁখি সতত জাগে, জেনেও না জানি।
 ওই   মঙ্গলরূপ ভুলি, তাই শোকসাগরে নামি॥
 আনন্দময় তোমার বিশ্ব শোভাসুখপূর্ণ,
 আমি   আপন দোষে দুঃখ পাই বাসনা-অনুগামী॥
 মোহবন্ধ ছিন্ন করো কঠিন আঘাতে,
 অশ্রুসলিলধৌত হৃদয়ে থাকো দিবসযামী॥

১১৪ :: অন্ধজনে দেহো আলো মৃতজনে দেহো প্রাণ

 অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ—
 তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান॥
          শুষ্ক হৃদয় মম   কঠিন পাষাণসম,
 প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান॥
 যে তোমারে ডাকে না হে তারে তুমি ডাকো-ডাকো।
 তোমা হতে দূরে যে যায় তারে তুমি রাখো রাখো।
          তৃষিত যেজন ফিরে   তব সুধাসাগরতীরে
 জুড়াও তাহারে স্নেহনীরে,  সুধা করাও হে পান॥
 তোমারে পেয়েছিনু যে,  কখন্‌ হারানু অবহেলে,
 কখন্‌ ঘুমাইনু হে, আঁধার হেরি আঁখি মেলে।
          বিরহ জানাইব কায়, সান্ত্বনা কে দিবে হায়,
 বরষ বরষ চলে যায়, হেরি নি প্রেমবয়ান—
 দরশন দাও হে, দাও হে দাও, কাঁদে হৃদয় ম্রিয়মাণ॥

১১৫ :: হে মহাজীবন হে মহামরণ লইনু শরণ লইনু শরণ॥

     হে মহাজীবন, হে মহামরণ,   লইনু শরণ, লইনু শরণ॥
               আঁধার প্রদীপে জ্বালাও শিখা,
        পরাও পরাও জ্যোতির টিকা— করো হে আমার লজ্জাহরণ॥
 পরশরতন তোমারি চরণ— লইনু শরণ, লইনু শরণ।
                যা-কিছু মলিন, যা- কিছু কালো,
        যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো— ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ॥

১১৬ :: পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে

                পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
           পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে?।
           এসেছে নিবিড় নিশি,   পথরেখা গেছে মিশি—
           সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে॥
 ভয় হয়, পাছে ঘুরে ঘুরে   যত আমি যাই তত যাই চলে দূরে—
           মনে করি আছ কাছে   তবু ভয় হয়, পাছে          
           আমি আছি তুমি নাই কালি নিশিভোরে॥

১১৭ :: দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া নিত্য কল্যাণ-কাজে হে

 দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া   নিত্য কল্যাণ-কাজে হে।
 ফিরিব আহ্বান মানিয়া   তোমারি রাজ্যের মাঝে হে॥
 মজিয়া অনুখন লালসে  রব না পড়িয়া আলসে,
 হয়েছে জর্জর জীবন   ব্যর্থ দিবসের লাজে হে॥
 আমারে রহে যেন না ঘিরি   সতত বহুতর সংশয়ে,
 বিবিধ পথে যেন না ফিরি    বহুল-সংগ্রহ-আশয়ে।
 অনেক নৃপতির শাসনে   না রহি শঙ্কিত আসনে,
 ফিরিব নির্ভয়গৌরবে   তোমারি ভৃত্যের সাজে হে॥

১১৮ :: ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়

            ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়,
             তবু জানো মন তোমারে চায়॥
                অন্তরে আছ অন্তর্যামী,
                আমা চেয়ে আমায় জানিছ স্বামী—
                সব সুখে দুখে ভুলে থাকায়
                   জানো মম মন তোমারে চায়॥
    ছাড়িতে পারি নি অহঙ্কারে,
    ঘুরে মরি শিরে বহিয়া তারে,
    ছাড়িতে পারিলে বাঁচি যে হায়—
          তুমি জানো মন তোমারে চায়।
                 যা আছে আমার সকলই কবে
                 নিজ হাতে তুমি তুলিয়া লবে—
                 সব ছেড়ে সব পাব তোমায়।
                      মনে মনে মন তোমারে চায়॥

১১৯ :: তোমারি সেবক করো হে আজি হতে আমারে

    তোমারি সেবক করো হে আজি হতে আমারে।
    চিত্ত-মাঝে দিবারাত   আদেশ তব দেহো নাথ,
         তোমার কর্মে রাখো বিশ্বদুয়ারে॥
      করো ছিন্ন মোহপাশ   সকল লুব্ধ আশ,
         লোকভয় দূর করি দাও দাও।
      রত রাখো কল্যাণে   নীরবে নিরভিমানে,
         মগ্ন করো আনন্দরসধারে॥

১২০ :: তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ লহো

 তুমি     এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।
                  এবার তুমি ফিরো না হে—
                         হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো॥
            যে দিন গেছে তোমা বিনা   তারে আর ফিরে চাহি না,
                         যাক সে ধুলাতে।
 এখন   তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন জাগি অহরহ॥
            কী আবেশে কিসের কথায়   ফিরেছি হে যথায় তথায়
                         পথে প্রান্তরে,
 এবার   বুকের কাছে ও মুখ রেখে   তোমার  আপন বাণী কহো॥
            কত কলুষ কত ফাঁকি   এখনো যে আছে বাকি
                         মনের গোপনে,
          আমায়  তার লাগি আর ফিরায়ো না—
                   তারে   আগুন দিয়ে দহো॥

১২১ :: হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই

           হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই।
           সংসারে যা দিবে মানিব তাই,
                 হৃদয়ে তোমায় যেন পাই॥
           তব দয়া জাগিবে স্মরণে
           নিশিদিন জীবনে মরণে,
 দুঃখে সুখে সম্পদে বিপদে   তোমারি দয়া-পানে চাই—
                 তোমারি দয়া যেন পাই॥
 তব দয়া শান্তির নীরে  অন্তরে নামিবে ধীরে।
           তব দয়া মঙ্গল-আলো
           জীবন-আঁধারে জ্বালো—
 প্রেমভক্তি মম  সকল শক্তি মম   তোমারি দয়ারূপে পাই,
            আমার বলে কিছু নাই।

১২২ :: ভুবনেশ্বর হে

         ভুবনেশ্বর হে,
 মোচন কর’ বন্ধন সব মোচন কর’ হে॥
     প্রভু মোচন কর’ ভয়,
     সব   দৈন্য করহ লয়,
 নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর’ নিঃসংশয়।
     তিমিররাত্রি,   অন্ধ যাত্রী,
 সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে॥
          ভুবনেশ্বর হে,
 মোচন কর’ জড়বিষাদ মোচন কর’ হে।
     প্রভু,   তব প্রসন্ন মুখ
     সব   দুঃখ করুক সুখ,
 ধূলিপতিত দুর্বল চিত করহ জাগরূক।
     তিমিররাত্রি, অন্ধ যাত্রী,
 সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে॥
           ভুবনেশ্বর হে,
 মোচন কর’ স্বার্থপাশ মোচন কর’ হে।
     প্রভু,   বিরস বিকল প্রাণ,
     কর   প্রেমসলিল দান,
 ক্ষতিপীড়িত শঙ্কিত চিত কর’ সম্পদবান।
     তিমিররাত্রি,   অন্ধ  যাত্রী,
 সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে॥

১২৩ :: আমার সত্য মিথ্যা সকলই ভুলায়ে দাও

        আমার  সত্য মিথ্যা সকলই ভুলায়ে দাও,
              আমায়   আনন্দে ভাসাও॥
 না চাহি তর্ক  না চাহি যুক্তি,   না জানি বন্ধ না জানিমুক্তি,
 তোমার   বিশ্বব্যাপিনী ইচ্ছা আমার অন্তরে জাগাও॥
               সকল বিশ্ব ডুবিয়া যাক শান্তিপাথারে,
                   সব সুখ দুখ থামিয়া যাক হৃদয়মাঝারে।
               সকল বাক্য সকল শব্দ   সকল চেষ্টা হউক স্তব্ধ—
 তোমার   চিত্তজয়িনী বাণী আমার অন্তরে শুনাও॥

১২৪ :: ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে॥

 ভয় হতে তব অভয়মাঝে   নূতন জনম দাও হে॥
 দীনতা হতে অক্ষয় ধনে,   সংশয় হতে সত্যসদনে,
 জড়তা হতে নবীন জীবনে   নূতন জনম দাও হে॥
 আমার ইচ্ছা হইতে, প্রভু,   তোমার ইচ্ছামাঝে—
 আমার স্বার্থ হইতে, প্রভু,   তব মঙ্গলকাজে—
 অনেক হইতে একের ডোরে,   সুখদুখ হতে শান্তিক্রোড়ে—
 আমা হতে, নাথ, তোমাতে মোরে   নূতন জনম দাও হে॥

১২৫ :: পাদপ্রান্তে রাখ’ সেবকে

              পাদপ্রান্তে রাখ’ সেবকে,
              শান্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে॥
  সর্বলোকপরমশরণ,   সকলমোহকলুষহরণ,
  দুঃখতাপবিঘ্নতরণ,    শোকশান্তস্নিগ্ধচরণ,
              সত্যরূপ প্রেমরূপ হে,
              দেবমনুজবন্দিতপদ বিশ্বভূপ হে॥
  হৃদয়ানন্দ পূর্ণ ইন্দু,   তুমি অপার প্রেমসিন্ধু।
  যাচে তৃষিত অমিয়বিন্দু,   করুণালয় ভক্তবন্ধু
              প্রেমনেত্রে চাহ’ সেবকে,
              বিকশিতদল চিত্তকমল হৃদয়দেব হে॥
  পুণ্যজ্যোতিপূর্ণগগন,   মধুর হেরি সকল ভুবন,
  সুধাগন্ধমুদিত পবন, ধ্বনিতগীত হৃদয়ভবন।
              এস’ এস’ শুন্য জীবনে,
              মিটাও আশ সব তিয়াষ অমৃতপ্লাবনে॥
  দেহ’ জ্ঞান, প্রেম দেহ’, শুষ্ক চিত্তে বরিষ স্নেহ।
  ধন্য হোক হৃদয় দেহ, পুণ্য হোক সকল গেহ।
              পাদপ্রান্তে রাখ’ সেবকে,
              শান্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে॥

১২৬ :: বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

          বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।
 শুষ্ক হৃদয় লয়ে   আছে দাঁড়াইয়ে
          ঊধর্বমুখে নরনারী॥
 না থাকে অন্ধকার,   না থাকে মোহপাপ,
          না থাকে শোকপরিতাপ।
 হৃদয় বিমল হোক,   প্রাণ সবল হোক,
          বিঘ্ন দাও অপসারি॥
 কেন এ হিংসাদ্বেষ,  কেন এ ছদ্মবেশ,
          কেন এ মান-অভিমান।
 বিতর’ বিতর’ প্রেম   পাষাণহৃদয়ে,
          জয় জয় হোক তোমারি॥

১২৭ :: সার্থক কর’ সাধন

         সার্থক কর’ সাধন,
 সান্ত্বন কর ধরিত্রীর বিরহাতুর কাঁদন
 প্রাণভরণ দৈন্যহরণ   অক্ষয়করুণাধন॥
          বিকশিতকর’ কলিকা,
 চম্পকবন করুক রচন নব কুসুমাঞ্জলিকা।
 কর’ সুন্দর গীতমুখর   নীরব আরাধন
           অক্ষয়করুণাধন॥
               চরণপরশহরষে
 লজ্জিত বনবীথিধূলি সজ্জিত তুমি কর’ সে।
               মোচন কর’ অন্তরতর
                  হিমজড়িমা-বাঁধন
                   অক্ষয়করুণাধন॥

১২৮ :: আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে

 আমার মিলন লাগি তুমি   আসছ কবে থেকে!
 তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়  রাখবে কোথায় ঢেকে?।
 কত কালের সকাল-সাঁঝে  তোমার চরণধ্বনি বাজে,
 গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে   গেছে আমায় ডেকে॥
 ওগো পথিক, আজকে আমার  সকল পরান ব্যেপে
 থেকে থেকে হরষে যেন   উঠছে কেঁপে কেঁপে।
 যেন সময় এসেছে আজ   ফুরালো মোর যা ছিল কাজ—
 বাতাস আসে, হে মহারাজ,  তোমার গন্ধ মেখে॥

১২৯ :: কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো

           কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো!
           বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো॥
 রয়েছে দীপ, না আছে শিখা,   এই কি ভালে ছিল রে লিখা—
           ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
                বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো॥
           বেদনাদূতী গাহিছে, ‘ওরে প্রাণ,
           তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
 নিশীথে  ঘন অন্ধকারে   ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
           দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
                তোমার লাগি জাগেন ভগবান।’
           গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
           বাদলজল পড়িছে ঝরি ঝরি।
 এ ঘোর রাতে কিসের লাগি   পরান মম সহসা জাগি
           এমন কেন করিছে মরি মরি।
                বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি॥
           বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
           নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
 জানি না কোথা অনেক দূরে   বাজিল গান গভীর সুরে,
           সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
                নিবিড়তর তিমির চোখে আনে॥
           কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো!
           বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
 ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,   সময় গেলে হবে না যাওয়া—
           নিবিড় নিশা নিকষঘনকালো।
                পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো॥

১৩০ :: তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি

 তোরা   শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
               ওই যে  আসে, আসে, আসে।
             যুগে যুগে পলে পলে দিন-রজনী
               সে যে  আসে, আসে, আসে॥
 গেয়েছি গান যখন যত   আপন মনে খ্যাপার মতো
             সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী—
               সে যে  আসে, আসে, আসে॥
             কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে
               সে যে  আসে, আসে, আসে।
             কত শ্রাবণ-অন্ধকারে মেঘের রথে
               সে যে  আসে, আসে, আসে।
 দুখের পরে পরম দুখে   তারি চরণ বাজে বুকে,
             সুখে কখন বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি।
               সে যে  আসে, আসে, আসে॥

১৩১ :: হে অন্তরের ধন

                     হে অন্তরের ধন,
              তুমি যে বিরহী,তোমার শুন্য এ ভবন॥
 আমার ঘরে তোমায় আমি   একা রেখে দিলাম স্বামী—
              কোথায় যে বাহিরে আমি ঘুরি সকল ক্ষণ॥
                    হে অন্তরের ধন,
              এই বিরহে কাঁদে আমার নিখিল ভুবন।
 তোমার বাঁশি নানা সুরে   আমায় খুঁজে বেড়ায় দূরে,
              পাগল হল বসন্তের এই দখিন-সমীরণ॥

১৩২ :: তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি

 তোমার পূজার   ছলে তোমায়   ভুলেই থাকি।
 বুঝতে নারি   কখন্‌ তুমি   দাও-যে ফাঁকি॥
 ফুলের মালা   দীপের আলো   ধূপের ধোঁওয়ার
 পিছন হতে   পাই নে সুযোগ   চরণ ছোঁওয়ার,
 স্তবের বাণীর   আড়াল টানি   তোমায় ঢাকি॥
 দেখব ব’লে    এই আয়োজন  মিথ্যা রাখি,
 আছে তো মোর   তৃষা-কাতর   আপন আঁখি।
 কাজ কী আমার   মন্দিরেতে   আনাগোনায়—
 পাতব আসন   আপন মনের   একটি কোণায়,
 সরল প্রাণে   নীরব হয়ে   তোমায় ডাকি॥

১৩৩ :: নীরবে আছ কেন বাহিরদুয়ারে

 নীরবে  আছ কেন  বাহিরদুয়ারে—
 আঁধার  লাগে চোখে, দেখি  না তুহারে॥
        সময়  হল জানি, নিকটে  লবে টানি,
                 আমার তরীখানি ভাসাবে জুয়ারে॥
 সফল  হোক প্রাণ এ  শুভলগনে,
 সকল তারা  তাই গাহুক  গগনে।
        করো  গো সচকিত  আলোকে পুলকিত
                 স্বপননিমীলিত হৃদয়গুহারে॥

১৩৪ :: তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে

 তোমার  আমার এই  বিরহের  অন্তরালে
 কত আর  সেতু বাঁধি  সুরে সুরে  তালে তালে॥
        তবু  যে পরানমাঝে  গোপনে বেদনা  বাজে—
        এবার  সেবার কাজে  ডেকে লও  সন্ধ্যাকালে॥
 বিশ্ব  হতে থাকি দূরে  অন্তরের অন্তঃপুরে,
 চেতনা  জড়ায়ে রহে   ভাবনার  স্বপ্নজালে।
        দুঃখ  সুখ আপনারই   সে বোঝা  হয়েছে ভারী,
        যেন  সে সঁপিতে  পারি    চরম পূজার  থালে॥

১৩৫ :: নিশা-অবসানে কে দিল গোপনে আনি

 নিশা-অবসানে  কে দিল গোপনে  আনি
 তোমার  বিরহ-বেদনা-মানিকখানি॥
      সে  ব্যথার দান  রাখিব  পরানমাঝে—
      হারায়  না যেন জটিল  দিনের কাজে,
             বুকে  যেন দোলে সকল  ভাবনা হানি॥
 চিরদুখ  মম চিরসম্পদ হবে,
 চরম  পূজায় হবে  সার্থক কবে।
      স্বপনগহন  নিবিড়তিমিরতলে
      বিহ্বল  রাতে সে যেন  গোপনে জ্বলে,
             সেই  তো নীরব তব  আহ্বানবাণী॥

১৩৬ :: বিশ্ব যখন নিদ্রামগন গগন অন্ধকার

 বিশ্ব  যখন  নিদ্রামগন, গগন  অন্ধকার,
         কে দেয়  আমার বীণার তারে  এমন ঝঙ্কার॥
 নয়নে  ঘুম নিল কেড়ে,   উঠে বসি  শয়ন ছেড়ে—
             মেলে  আঁখি চেয়ে  থাকি, পাই নে  দেখা তার॥
 গুঞ্জরিয়া  গুঞ্জরিয়া  প্রাণ উঠিল  পূরে,
         জানি  নে কোন্‌  বিপুল বাণী  বাজে ব্যাকুল  সুরে।
 কোন্‌  বেদনায় বুঝি  না রে    হৃদয় ভরা  অশ্রুভারে,
             পরিয়ে  দিতে চাই  কাহারে আপন  কণ্ঠহার॥

১৩৭ :: যে দিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই

 যে  দিন    ফুটল কমল  কিছুই জানি  নাই,
             আমি  ছিলেম  অন্যমনে।
 আমার   সাজিয়ে  সাজি তারে আনি  নাই,
             সে যে  রইল  সঙ্গোপনে॥
             মাঝে মাঝে  হিয়া  আকুলপ্রায়
             স্বপন  দেখে চমকে ঊঠে  চায়,
             মন্দ  মধুর গন্ধ আসে  হায়
                কোথায়   দখিন-সমীরণে॥
 ওগো,  সেই  সুগন্ধে  ফিরায়  উদাসিয়া
                আমায়   দেশে-দেশান্তে।
 যেন    সন্ধানে তার  উঠে  নিশ্বাসিয়া
                ভুবন   নবীন-বসন্তে।
             কে  জানিত দূরে তো  নেই সে,
             আমারি  গো আমারি সেই  যে,
             এ  মাধুরী  ফুটেছে হায় রে
                আমার   হৃদয়-উপবনে॥

১৩৮ :: প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে

 প্রভু,   তোমা  লাগি আঁখি  জাগে;
                  দেখা  নাই পাই
                    পথ  চাই,
         সেও  মনে ভালো  লাগে॥
 ধূলাতে  বসিয়া  দ্বারে    ভিখারি হৃদয়  হা রে
             তোমারি  করুণা মাগে;
                  কৃপা  নাই পাই
                    শুধু  চাই,
             সেও  মনে ভালো লাগে॥
 আজি এ  জগতমাঝে   কত সুখে  কত কাজে
             চলে  গেল সবে আগে;
                 সাথি  নাই পাই
                    তোমায়  চাই,
             সেও  মনে ভালো  লাগে॥
 চারি  দিকে সুধা-ভরা    ব্যাকুল  শ্যামল ধরা
             কাঁদায়  রে অনুরাগে;
                 দেখা  নাই পাই
                    ব্যথা  পাই,
             সেও  মনে ভলো  লাগে॥

১৩৯ :: যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু এবার এ জীবনে

 যদি   তোমার  দেখা না পাই, প্রভু,  এবার এ জীবনে
 তবে  তোমায়  আমি পাই নি  যেন সে কথা রয়  মনে।
 যেন   ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
                   এ  সংসারের হাটে
          আমার   যতই  দিবস কাটে,
          আমার   যতই দু  হাত ভরে উঠে  ধনে
 তবু  কিছুই  আমি পাই নি  যেন   সে  কথা রয় মনে।
 যেন  ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
                   যদি  আলসভরে
           আমি   বসি  পথের ’পরে,
           যদি    ধূলায়  শয়ন পাতি  সযতনে,
 যেন  সকল পথই  বাকি আছে সে  কথা রয় মনে।
 যেন  ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
                   যতই  উঠে হাসি,
           ঘরে   যতই  বাজে বাঁশি,
           ওগো  যতই গৃহ  সাজাই আয়োজনে,
 যেন  তোমায়  ঘরে হয় নি আনা   সে কথা রয়  মনে।
 যেন  ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥

১৪০ :: হেরি অহরহ তোমারি বিরহ ভুবনে ভুবনে রাজে হে

 হেরি  অহরহ তোমারি  বিরহ ভুবনে  ভুবনে রাজে হে,
      কত রূপ  ধরে কাননে  ভূধরে আকাশে  সাগরে সাজে  হে॥
         সারা  নিশি ধরি  তারায় তারায় অনিমেষ  চোখে নীরবে  দাঁড়ায়,
             পল্লবদলে  শ্রাবণধারায়  তোমারি বিরহ  বাজে হে॥
 ঘরে ঘরে  আজি কত  বেদনায়    তোমারি গভীর  বিরহ ঘনায়
       কত  প্রেমে হায়, কত  বাসনায়, কত  সুখে দুখে  কাজে হে।
           সকল  জীবন উদাস  করিয়া    কত গানে সুরে  গলিয়া ঝরিয়া
             তোমার  বিরহ উঠিছে  ভরিয়া আমার  হিয়ার মাঝে  হে॥

১৪১ :: আমার গোধূলিলগন এল বুঝি কাছে গোধূলি লগন রে

 আমার    গোধূলিলগন  এল বুঝি কাছে  গোধূলি লগন  রে।
               বিবাহের  রঙে রাঙা হয়ে  আসে সোনার গগন  রে।
 শেষ  ক’রে দিল পাখি  গান-গাওয়া,   নদীর  উপরে পড়ে এল  হাওয়া;
          ও  পারের তীর, ভাঙা  মন্দির  আঁধারে মগন  রে।
            আসিছে  মধুর  ঝিল্লিনূপুরে  গোধূলিলগন  রে॥
 আমার   দিন  কেটে গেছে  কখনো খেলায়, কখনো  কত কী কাজে।
                এখন কী শুনি পুরবীর সুরে কোন্‌ দূরে বাঁশি বাজে।
 বুঝি  দেরি নাই, আসে  বুঝি আসে, আলোকের  আভা লেগেছে  আকাশে—
          বেলাশেষে  মোরে কে  সাজাবে, ওরে, নবমিলনের  সাজে!
              সারা হল কাজ, মিছে কেন আজ ডাক মোরে আর কাজে॥
 আমি   জানি যে  আমার হয়ে গেছে  গণা গোধূলিলগন  রে।
               ধূসর  আলোকে মুদিবে  নয়ন অস্তগগন  রে।
 তখন এ  ঘরে কে খুলিবে  দ্বার,   কে  লইবে টানি  বাহু আমার,
           আমায়  কে জানে কী  মন্ত্রে গানে  করিবে মগন রে—
               সব  গান সেরে  আসিবে যখন  গোধূলিলগন  রে॥

১৪২ :: নাই বা ডাকো রইব তোমার দ্বারে

 নাই  বা ডাকো রইব  তোমার দ্বারে,
 মুখ  ফিরালে ফিরব  না এইবারে॥
        বসব  তোমার পথের  ধূলার ’পরে,
        এড়িয়ে  আমায় চলবে  কেমন করে—
        তোমার  তরে যে জন  গাঁথে মালা
               গানের কুসুম জুগিয়ে দেব তারে॥
 রইব  তোমার ফসল-খেতের  কাছে
 যেথায়  তোমার পায়ের  চিহ্ন আছে।
        জেগে  রব গভীর  উপবাসে
        অন্ন  তোমার আপনি  যেথায় আসে—
        যেথায়  তুমি লুকিয়ে  প্রদীপ  জ্বালো
               বসে রব সেথায় অন্ধকারে॥

১৪৩ :: সকাল-সাঁজে

                         সকাল-সাঁজে
                 ধায়  যে ওরা নানা  কাজে॥
 আমি  কেবল বসে আছি,   আপন মনে  কাঁটা বাছি
                পথের মাঝে   সকাল-সাঁজে॥
                         এ পথ বেয়ে
                   সে আসে, তাই আছি চেয়ে।
 কতই  কাঁটা বাজে  পায়ে,   কতই  ধুলা লাগে  গায়ে—
                   মরি লাজে    সকাল-সাঁজে॥

১৪৪ :: জগত জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে

           জগত  জুড়ে উদার  সুরে  আনন্দগান  বাজে,
           সে গান  কবে গভীর রবে  বাজিবে হিয়া-মাঝে॥
 বাতাস  জল আকাশ আলো  সবারে  কবে বাসিব ভালো,
           হৃদয়সভা  জুড়িয়া তারা  বসিবে নানা  সাজে॥
           নয়ন  দুটি মেলিলে  কবে পরান হবে  খুশি,
           যে পথ  দিয়া চলিয়া  যাব সবারে যাব  তুষি।
           রয়েছ  তুমি এ কথা  কবে   জীবনমাঝে  সহজ হবে,
           আপনি  কবে তোমারি  নাম ধ্বনিবে  সব কাজে॥

১৪৫ :: কোন্‌ শুভখনে উদিবে নয়নে অপরূপ রূপ-ইন্দু

 কোন্‌  শুভখনে উদিবে  নয়নে   অপরূপ রূপ-ইন্দু
 চিত্তকুসুমে  ভরিয়া উঠিবে  মধুময়  রসবিন্দু॥
 নব  নন্দনতানে    চিরবন্দনগানে
 উৎসববীণা  মন্দমধুর   ঝঙ্কৃত  হবে প্রাণে—
 নিখিলের  পানে উথলি  উঠিবে    উতলা চেতনাসিন্ধু।
 জাগিয়া  রহিবে  রাত্রি    নিবিড়মিলনদাত্রী,
 মুখরিয়া  দিক চলিবে  পথিক  অমৃতসভার  যাত্রী—
 গগনে  ধ্বনিবে ‘নাথ  নাথ বন্ধু  বন্ধু  বন্ধু’॥

১৪৬ :: আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

 আজ    জ্যোৎস্নারাতে  সবাই গেছে বনে
             বসন্তের  এই মাতাল  সমীরণে॥
 যাব না  গো যাব না যে,   রইনু  পড়ে ঘরের  মাঝে—
             এই  নিরালায় রব  আপন কোণে।
                   যাব না এই মাতাল সমীরণে॥
             আমার  এ ঘর বহু যতন  ক’রে
                   ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
 আমারে  যে জাগতে হবে,   কী জানি  সে আসবে কবে
              যদি  আমায় পড়ে  তাহার মনে
                   বসন্তের এই মাতাল সমীরণে॥

১৪৭ :: তুমি এ-পার ও-পার কর কে গো ওগো খেয়ার নেয়ে

 তুমি     এ-পার ও-পার  কর কে গো ওগো  খেয়ার নেয়ে?
 আমি    ঘরের  দ্বারে বসে  বসে দেখি যে  সব চেয়ে॥
            ভাঙিলে  হাট দলে দলে   সবাই  যাবে ঘরে চলে
            আমি  তখন মনে ভাবি, আমিও  যাই ধেয়ে॥
 দেখি    সন্ধ্যাবেলা  ও পার-পানে  তরণী যাও  বেয়ে।
 দেখে    মন আমার  কেমন করে,   ওঠে যে  গান গেয়ে
                 ওগো  খেয়ার নেয়ে॥
            কালো  জলের কলকলে   আঁখি  আমার ছলছলে,
            ও পার  হতে সোনার আভা  পরান ফেলে  ছেয়ে।
 দেখি    তোমার  মুখে কথাটি  নাই ওগো খেয়ার  নেয়ে—
 কী যে  তোমার  চোখে লেখা আছে  দেখি যে সব চেয়ে
                 ওগো  খেয়ার নেয়ে।
            আমার  মুখে  ক্ষণতরে   যদি  তোমার আঁখি পড়ে
            আমি  তখন মনে ভাবি  আমিও  যাই ধেয়ে
                 ওগো  খেয়ার নেয়ে॥

১৪৮ :: বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে

         বেলা গেল  তোমার পথ  চেয়ে।
 শূন্য  ঘাটে একা আমি, পার  ক’রে লও খেয়ার  নেয়ে॥
 ভেঙে  এলেম খেলার  বাঁশি,   চুকিয়ে  এলেম কান্না  হাসি,
         সন্ধ্যাবায়ে  শ্রান্তকায়ে  ঘুমে নয়ন আসে  ছেয়ে॥
 ও  পারেতে ঘরে  ঘরে    সন্ধ্যাদীপ  জ্বলিল রে,
         আরতির  শঙ্খ বাজে  সুদূর মন্দির-’পরে।
 এসো  এসো  শ্রান্তিহরা,   এসো  শান্তি-সুপ্তি-ভরা,
         এসো  এসো তুমি এসো, এসো  তোমার তরী  বেয়ে॥

১৪৯ :: তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে

 তোর     ভিতরে  জাগিয়া কে যে,
 তারে     বাঁধনে  রাখিলি  বাঁধি।
 হায়       আলোর  পিয়াসী সে যে
 তাই      গুমরি  উঠিছে  কাঁদি॥
 যদি       বাতাসে বহিল  প্রাণ
 কেন      বীণায়  বাজে না গান,
 যদি       গগনে  জাগিল আলো
 কেন      নয়নে  লাগিল আঁধি?।
 পাখি     নবপ্রভাতের  বাণী
 দিল      কাননে  কাননে আনি,
 ফুলে     নবজীবনের  আশা
 কত      রঙে  রঙে পায় ভাষা।
 হোথা     ফুরায়ে  গিয়েছে রাতি,
 হেথা      জ্বলে  নিশীথের বাতি—
 তোর      ভবনে  ভুবনে কেন
 হেন       হয়ে  গেল আধা-আধি?।

১৫০ :: তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া

 তুমি     বাহির  থেকে দিলে  বিষম তাড়া।
 তাই     ভয়ে  ঘোরায় দিক্‌বিদিকে,
               শেষে অন্তরে পাই সাড়া॥
 যখন    হারাই  বন্ধ ঘরের  তালা—
 যখন    অন্ধ  নয়ন, শ্রবণ  কালা,
 তখন    অন্ধকারে  লুকিয়ে  দ্বারে
                শিকলে দাও নাড়া॥
 যত      দুঃখ  আমার দুঃস্বপনে,
 সে যে   ঘুমের  ঘোরেই আসে  মনে—
            ঠেলা দিয়ে মায়ার আবেশ
                কর গো দেশছাড়া।
 আমি    আপন  মনের মারেই  মরি,
 শেষে    দশ  জনারে দোষী  করি—
 আমি    চোখ  বুজে পথ পাই  নে ব’লে
                কেঁদে ভাসাই পাড়া॥

১৫১ :: এখনো গেল না আঁধার এখনো রহিল বাধা

 এখনো  গেল না আঁধার, এখনো  রহিল বাধা।
 এখনো  মরণব্রত  জীবনে হল না  সাধা॥
 কবে যে  দুঃখজ্বালা   হবে রে  বিজয়মালা,
 ঝলিবে  অরুণরাগে  নিশীথ রাতের  কাঁদা॥
 এখনো  নিজেরই ছায়া   রচিছে  কত যে মায়া।
 এখনো  কেন-যে মিছে   চাহিছে  কেবলই পিছে,
 চকিতে  বিজলি-আলো  চোখেতে  লাগালো  ধাঁদা॥

১৫২ :: লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই

        লক্ষ্মী  যখন আসবে তখন  কোথায় তারে  দিবি রে ঠাঁই?
        দেখ্‌  রে চেয়ে আপন-পানে,  পদ্মটি নাই, পদ্মটি  নাই॥
 ফিরছে  কেঁদে  প্রভাতবাতাস,     আলোক  যে তার ম্লান  হতাশ,
        মুখে  চেয়ে আকাশ  তোরে শুধায়  আজি নীরবে  তাই॥
        কত  গোপন আশা নিয়ে  কোন্‌ সে গহন  রাত্রি শেষে
        অগাধ  জলের তলা হতে  অমল কুঁড়ি উঠল  ভেসে।
 হল না  তার ফুটে ওঠা,   কখন  ভেঙে পড়ল  বোঁটা—
        মর্ত-কাছে  স্বর্গ যা চায়  সেই মাধুরী  কোথা রে পাই॥

১৫৩ :: যেতে যেতে চায় না যেতে ফিরে ফিরে চায়

         যেতে  যেতে চায় না  যেতে, ফিরে  ফিরে চায়—
         সবাই  মিলে পথে চলা  হল আমার দায়  গো॥
 দুয়ার  ধরে দাঁড়িয়ে  থাকে—      দেয় না সাড়া  হাজার ডাকে—
         বাঁধন  এদের সাধনধন, ছিঁড়তে  যে ভয় পায়॥
         আবেশভরে  ধুলায় প’ড়ে  কতই করে ছল,
         যখন  বেলা যাবে চলে  ফেলবে  আঁখিজল।
 নাই  ভরসা, নাই যে  সাহস,     চিত্ত  অবশ, চরণ অলস—
         লতার  মতো জড়িয়ে ধরে  আপন বেদনায়॥

১৫৪ :: বেসুর বাজে রে

                  বেসুর  বাজে রে,
 আর  কোথা নয়, কেবল  তোরই আপন-মাঝে  রে॥
 মেলে  না সুর এই  প্রভাতে    আনন্দিত  আলোর সাথে,
 সবারে  সে আড়াল করে, মরি  লাজে রে॥
               ওরে  থামা রে  ঝঙ্কার।
 নীরব  হয়ে দেখ্‌ রে  চেয়ে, দেখ্ রে  চারি ধার।
 তোরি  হৃদয় ফুটে  আছে   মধুর হয়ে  ফুলের গাছে,
 নদীর  ধারা ছুটেছে  ওই তোরই কাজে  রে॥

১৫৫ :: আমার কণ্ঠ তাঁরে ডাকে

            আমার   কণ্ঠ  তাঁরে ডাকে,
            তখন   হৃদয়  কোথায় থাকে॥
 যখন      হৃদয়  আসে ফিরে   আপন  নীরব নীড়ে
 আমার   জীবন  তখন কোন্‌  গহনে বেড়ায়  কিসের পাকে॥
            যখন   মোহ  আমায় ডাকে
            তখন   লজ্জা  কোথায় থাকে!
 যখন      আনেন  তমোহারী   আলোক-তরবারি
 তখন     পরান আমার  কোন্‌ কোণে যে
                    লজ্জাতে  মুখ ঢাকে॥

১৫৬ :: দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে

            দেবতা  জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
                   আপন জেনে আদর করি নে।
            পিতা  ব’লে প্রণাম  করি পায়ে,
                   বন্ধু ব’লে দু হাত ধরি নে॥
            আপনি  তুমি অতি সহজ প্রেমে
            আমার  হয়ে যেথায় এলে নেমে
 সেথায়  সুখে বুকের  মধ্যে ধ’রে  সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে॥
            ভাই  তুমি যে ভাইয়ের মাঝে, প্রভু ,
            তাদের  পানে তাকাই না যে তবু—
 ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে  মোর ধন তোমার মুঠো কেন ভরি নে॥
            ছুটে এসে সবার সুখে  দুখে
            দাঁড়াই নে তো তোমারি  সম্মুখে,
 সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন  কাজে প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে॥

১৫৭ :: ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু

          ক্লান্তি  আমার ক্ষমা  করো প্রভু,
          পথে  যদি পিছিয়ে পড়ি  কভু॥
 এই-যে  হিয়া থরোথরো   কাঁপে  আজি এমনতরো
 এই  বেদনা ক্ষমা  করো, ক্ষমা  করো, ক্ষমা করো  প্রভু॥
          এই  দীনতা ক্ষমা  করো প্রভু,
          পিছন-পানে  তাকাই যদি  কভু।
 দিনের  তাপে  রৌদ্রজ্বালায়   শুকায়  মালা পূজার  থালায়,
 সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥             

১৫৮ :: অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন ক’রে

             অগ্নিবীণা  বাজাও তুমি  কেমন ক’রে!
       আকাশ  কাঁপে তারার  আলোর গানের  ঘোরে॥
 তেমনি  ক’রে আপন হাতে   ছুঁলে  আমার বেদনাতে,
       নূতন  সৃষ্টি জাগল  বুঝি জীবন-’পরে॥
       বাজে  ব’লেই বাজাও  তুমি সেই গরবে,
       ওগো  প্রভু, আমার  প্রাণে সকল  সবে।
 বিষম  তোমার  বহ্নিঘাতে   বারে  বারে আমার  রাতে
       জ্বালিয়ে  দিলে নূতন  তারা ব্যথায়  ভ’রে॥

১৫৯ :: পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে

         পথ  চেয়ে যে কেটে  গেল কত দিনে  রাতে,
 আজ  তোমায়  আমায় প্রাণের  বঁধু মিলব গো  এক সাথে॥
     রচবে  তোমার মুখের  ছায়া    চোখের জলে  মধুর মায়া,
           নীরব  হয়ে তোমার  পানে চাইব গো  জোড় হাতে॥
           এরা  সবাই কী বলে  গো লাগে না মন  আর,
           আমার  হৃদয় ভেঙে  দিল   তোমার    কী মাধুরীর  ভার!
 বাহুর  ঘেরে তুমি  মোরে    রাখবে না কি  আড়াল করে,
           তোমার  আঁখি চাইবে না  কি আমার  বেদনাতে?।

১৬০ :: সন্ধ্যা হল গো ও মা সন্ধ্যা হল বুকে ধরো

 সন্ধ্যা  হল গো—ও মা,   সন্ধ্যা  হল, বুকে ধরো।
 অতল  কালো স্নেহের  মাঝে ডুবিয়ে  আমায় স্নিগ্ধ করো॥
 ফিরিয়ে  নে মা, ফিরিয়ে  নে গো—সব যে  কোথায়  হারিয়েছে গো
      ছড়ানো  এই জীবন, তোমার  আঁধার-মাঝে  হোক-না জড়ো॥
      আর  আমারে বাইরে  তোমার কোথাও  যেন না যায়  দেখা।
      তোমার  রাতে মিলাক  আমার  জীবনসাঁজের  রশ্মিরেখা।
      আমায়  ঘিরি আমায়  চুমি    কেবল তুমি, কেবল  তুমি—
      আমার  ব’লে যা আছে, মা, তোমার  ক’রে সকল  হরো॥

১৬১ :: তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে কেউ তা জানে না

 তুমি       ডাক  দিয়েছ কোন্‌  সকালে কেউ তা  জানে না,
 আমার    মন যে  কাঁদে আপন-মনে  কেউ তা মানে  না॥
       ফিরি  আমি উদাস  প্রাণে,    তাকাই সবার  মুখের পানে,
           তোমার  মতো এমন টানে   কেউ তো  টানে না॥
           বেজে  ওঠে পঞ্চমে  স্বর,   কেঁপে  ওঠে বন্ধ এ ঘর,
           বাহির  হতে দুয়ারে  কর   কেউ  তো হানে না।
       আকাশে  কার  ব্যাকুলতা,   বাতাস  বহে কার বারতা,
           এ পথে  সেই গোপন   কথা কেউ  তো আনে না॥

১৬২ :: এ যে মোর আবরণ

              এ যে  মোর আবরণ
              ঘুচাতে  কতক্ষণ!
 নিশ্বাসবায়                  উড়ে  চলে যায়
              তুমি  কর যদি মন॥
              যদি  পড়ে থাকি ভূমে
              ধুলার  ধরণী চুমে
 তুমি  তারি লাগি        দ্বারে  রবে জাগি
              এ  কেমন তব পণ॥
              রথের  চাকার রবে
              জাগাও  জাগাও সবে,
 আপনার  ঘরে              এসো বলভরে
              এসো  এসো গৌরবে।
              ঘুম  টুটে যাক চলে,
              চিনি  যেন প্রভু  ব’লে—
 ছুটে  এসে দ্বারে          করি  আপনারে
              চরণে  সমর্পণ॥

১৬৩ :: সকল জনম ভ’রে ও মোর দরদিয়া

 সকল    জনম ভ’রে      ও মোর দরদিয়া,
 কাঁদি     কাঁদাই তোরে    ও মোর  দরদিয়া॥
             আছ  হৃদয়-মাঝে
 সেথা     কতই  ব্যথা বাজে,
 ওগো     এ কি  তোমায় সাজে
                       ও মোর দরদিয়া?।
 এই       দুয়ার-দেওয়া  ঘরে
 কভু      আঁধার  নাহি সরে,
 তবু       আছ  তারি ’পরে
                       ও মোর দরদিয়া।
 সেথা     আসন হয়  নি পাতা,
 সেথা     মালা হয়  নি গাঁথা,
 আমার   লজ্জাতে  হেঁট মাথা
                       ও মোর দরদিয়া॥

১৬৪ :: আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে

 আমার     ব্যথা  যখন আনে আমায়  তোমার দ্বারে
 তখন       আপনি  এসে দ্বার  খুলে দাও, ডাকো  তারে॥
          বাহুপাশের  কাঙাল সে যে,   চলেছে  তাই সকল  ত্যেজে,
               কাঁটার  পথে ধায় সে  তোমার  অভিসারে॥
 আমার     ব্যথা  যখন বাজায়  আমায় বাজি  সুরে—
 সেই         গানের  টানে পারো না  আর রইতে দূরে।
          লুটিয়ে  পড়ে সে গান মম   ঝড়ের  রাতের পাখি-সম,
                বাহির  হয়ে এসো তুমি  অন্ধকারে॥

১৬৫ :: যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারে বারে

 যতবার  আলো জ্বালাতে  চাই, নিবে যায়  বারে বারে।
 আমার  জীবনে তোমার  আসন গভীর  অন্ধকারে॥
 যে  লতাটি আছে  শুকায়েছে  মূল—কুঁড়ি ধরে  শুধু, নাহি  ফোটে ফুল,
         আমার  জীবনে তব সেবা  তাই বেদনার  উপহারে॥
         পূজাগৌরব  পুণ্যবিভব  কিছু নাহি, নাহি  লেশ—
         এ তব  পূজারী পরিয়া  এসেছে লজ্জার  দীন বেশ।
 উৎসবে  তার আসে নাই  কেহ,  বাজে  নাই বাঁশি, সাজে  নাই গেহ—
         কাঁদিয়া  তোমায় এনেছে  ডাকিয়া  ভাঙামন্দির-দ্বারে॥

১৬৬ :: আবার এরা ঘিরেছে মোর মন

            আবার  এরা ঘিরেছে  মোর মন।
             আবার  চোখে নামে যে  আবরণ॥
 আবার এ  যে নানা কথাই  জমে,   চিত্ত  আমার নানা  দিকে ভ্রমে,
 দাহ  আবার বেড়ে ওঠে  ক্রমে,   আবার  এ যে হারাই  শ্রীচরণ॥
             তব  নীরব বাণী  হৃদয়তলে
             ডোবে  না যেন লোকের  কোলাহলে।
 সবার  মাঝে আমার  সাথে থাকো,   আমায়  সদা তোমার  মাঝে ঢাকো,
 নিয়ত  মোর চেতনা-’পরে  রাখো    আলোকে-ভরা  উদার  ত্রিভুবন॥

১৬৭ :: তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে

 তুমি   নব নব  রূপে এসো  প্রাণে
 এসো  গন্ধে  বরনে এসো  গানে॥
             এসো   অঙ্গে পুলকময় পরশে,
             এসো   চিত্তে সুধাময় হরষে,
             এসো   মুগ্ধ মুদিত দু’নয়ানে॥
 এসো  নির্মল  উজ্জ্বল  কান্ত,
 এসো  সুন্দর  স্নিগ্ধ  প্রশান্ত,
 এসো  এসো হে  বিচিত্র  বিধানে।
             এসো   দুঃখে সুখে, এসো মর্মে,
             এসো   নিত্য নিত্য সব কর্মে,
             এসো   সকল কর্ম-অবসানে॥

১৬৮ :: হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে

 হৃদয়নন্দনবনে  নিভৃত এ  নিকেতনে
 এসো  হে আনন্দময়, এসো  চিরসুন্দর॥
 দেখাও  তব প্রেমমুখ, পাসরি  সর্ব দুখ,
 বিরহকাতর  তপ্ত চিত্ত-মাঝে  বিহরো॥
 শুভদিন  শুভরজনী আনো  আনো এ জীবনে,
 ব্যর্থ  এ নরজনম সফল  করো প্রিয়তম।
 মধুর  চিরসঙ্গীতে  ধ্বনিত করো  অন্তর,
 ঝরিবে  জীবনে মনে  দিবানিশা  সুধানিঝর॥

১৬৯ :: বসে আছি হে কবে শুনিব তোমার বাণী

 বসে  আছি হে    কবে    শুনিব তোমার  বাণী।
 কবে   বাহির  হইব জগতে  মম   জীবন  ধন্য মানি॥
 কবে   প্রাণ  জাগিবে, তব   প্রেম  গাহিবে,
 দ্বারে  দ্বারে ফিরি  সবার    হৃদয় চাহিবে,
 নরনারীমন  করিয়া হরণ   চরণে  দিবে আনি॥
 কেহ   শুনে না  গান,   জাগে  না প্রাণ,
 বিফলে  গীত-অবসান—
 তোমার  বচন করিব রচন   সাধ্য  নাহি নাহি।
 তুমি  না কহিলে  কেমনে কব   প্রবল  অজেয় বাণী তব,
 তুমি  যা বলিবে তাই  বলিব,   আমি  কিছুই না  জানি।
 তব  নামে আমি  সবারে ডাকিব,   হৃদয়ে  লইব টানি॥

১৭০ :: ডাকিছ শুনি জাগিনু প্রভু আসিনু তব পাশে

 ডাকিছ  শুনি জাগিনু  প্রভু, আসিনু  তব পাশে।
 আঁখি  ফুটিল, চাহি  উঠিল চরণদরশ-আশে॥
 খুলিল  দ্বার, তিমিরভার  দূর হইল  ত্রাসে।
 হেরিল  পথ বিশ্বজগত, ধাইল  নিজ বাসে॥
 বিমলকিরণ  প্রেম-আঁখি  সুন্দর  পরকাশে।
 নিখিল  তায় অভয় পায়, সকল  জগত হাসে॥
 কানন  সব ফুল্ল আজি, সৌরভ  তব ভাসে।
 মুগ্ধ  হৃদয় মত্ত  মধুপ  প্রেমকুসুমবাসে॥
 উজ্জ্বল  যত ভকতহৃদয়, মোহতিমির  নাশে।
 দাও, নাথ,  প্রেম-অমৃত  বঞ্চিত তব  দাসে॥

১৭১ :: আমি কারে ডাকি গো

 আমি      কারে  ডাকি গো,
 আমার    বাঁধন  দাও গো টুটে।
 আমি      হাত  বাড়িয়ে আছি,
 আমায়    লও কেড়ে  লও লুটে॥
 তুমি        ডাকো  এমনি ডাকে
 যেন        লজ্জাভয় না  থাকে,
 যেন        সব  ফেলে যাই, সব  ঠেলে যাই,
                          যাই ধেয়ে যাই ছুটে॥
 আমি      স্বপন  দিয়ে বাঁধা—
 কেবল    ঘুমের  ঘোরের বাধা,
 সে যে     জড়িয়ে  আছে প্রাণের  কাছে
                           মুদিয়ে আঁখিপুটে।
 ওগো,     দিনের  পরে দিন
 আমার    কোথায়  হল লীন,
 কেবল     ভাষাহারা  অশ্রুধারায়
                           পরান কেঁদে উঠে॥

১৭২ :: আজি মন চাহে জীবনবন্ধুরে

 আজি মন  চাহে  জীবনবন্ধুরে,
 সেই  জনমে মরণে  নিত্যসঙ্গী
      নিশিদিন  সুখে শোকে—
            সেই  চির-আনন্দ, বিমল  চিরসুধা,
            যুগে  যুগে কত নব নব  লোকে  নিয়তশরণ।
 পরাশান্তি, পরমপ্রেম,          পরামুক্তি, পরমক্ষেম,
      সেই  অন্তরতম  চিরসুন্দর  প্রভু, চিত্তসখা,
            ধর্ম-অর্থ-কাম-ভরণ রাজা হৃদয়হরণ॥

১৭৩ :: আমার মন তুমি নাথ লবে হ’রে

           আমার   মন তুমি,  নাথ, লবে হ’রে
           আমি    আছি বসে  সেই আশা ধরে॥
 নীলাকাশে  ওই তারা ভাসে,     নীরব  নিশীথে শশী  হাসে,
 আমার   দু নয়নে  বারি আসে ভরে—  আছি আশা ধরে॥
 স্থলে  জলে তব  ধূলিতলে, তরুলতা  তব ফুলে ফলে,
               নরনারীদের  প্রেমডোরে,
 নানা  দিকে দিকে  নানা কালে,   নানা  সুরে সুরে  নানা তালে
             নানা  মতে তুমি লবে  মোরে— আছি আশা  ধরে॥

১৭৪ :: ঘাটে বসে আছি আনমনা যেতেছে বহিয়া সুসময়

   ঘাটে  বসে আছি আনমনা,    যেতেছে  বহিয়া সুসময়—
   সে  বাতাসে তরী  ভাসাব না    যাহা  তোমা পানে  নাহি বয়॥
   দিন যায়  ওগো দিন যায়,     দিনমণি  যায় অস্তে—
   নিশার  তিমিরে দশদিক  ঘিরে    জাগিয়া  উঠিছে শত ভয়॥
   ঘরের  ঠিকানা হল না  গো,    মন  করে তবু যাই-যাই—
   ধ্রুবতারা  তুমি যেথা  জাগ     সে  দিকের পথ চিনি  নাই॥
   এত দিন  তরী বাহিলাম     যে  সুদূরে পথ  বাহিয়া—
   শত বার  তরী ডুবুডুবু  করি   সে  পথে ভরসা নাহি  পাই॥
   তীর-সাথে  হেরো শত ডোরে  বাঁধা  আছে মোর  তরীখান—
   রশি  খুলে দেবে কবে  মোরে,   ভাসিতে  পারিলে বাঁচে  প্রাণ।
   কবে  অকূলের খোলা  হাওয়া    দিবে সব  জ্বালা  জুড়ায়ে,
   শুনা  যাবে কবে  ঘনঘোর রবে    মহাসাগরের কলগান॥

১৭৫ :: এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার

      এই   মলিন  বস্ত্র ছাড়তে  হবে, হবে গো  এইবার—
             আমার  এই    মলিন  অহঙ্কার॥
 দিনের  কাজে ধুলা  লাগি    অনেক দাগে হল  দাগি,
            এমনি  তপ্ত হয়ে আছে  সহ্য করা ভার
               আমার  এই    মলিন  অহঙ্কার॥
 এখন তো  কাজ সাঙ্গ হল  দিনের অবসানে—
 হল রে  তাঁর আসার সময়,  আশা এল  প্রাণে।
 স্নান  ক’রে আয় এখন  তবে,   প্রেমের  বসন পরতে হবে,
            সন্ধ্যাবনে  কুসুম তুলে  গাঁথতে হবে  হার।
               ওরে  আয়, সময় নেই যে  আর॥

১৭৬ :: নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা

 নিবিড়  ঘন আঁধারে   জ্বলিছে  ধ্রুবতারা।
 মন রে  মোর, পাথারে  হোস নে  দিশেহারা॥
 বিষাদে  হয়ে  ম্রিয়মাণ  বন্ধ না  করিয়ো গান,
 সফল  করি তোলো  প্রাণ   টুটিয়া  মোহকারা॥
 রাখিয়ো  বল জীবনে,  রাখিয়ো  চির-আশা,
 শোভন  এই ভুবনে  রাখিয়ো  ভালোবাসা।
 সংসারের  সুখে দুখে  চলিয়া  যেয়ো হাসিমুখে,
 ভরিয়া  সদা রেখো বুকে   তাঁহারি  সুধাধারা॥

১৭৭ :: প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর

 প্রতিদিন  তব গাথা গাব  আমি সুমধুর—
 তুমি  দেহো মোরে কথা,  তুমি দেহো  মোরে সুর—
 তুমি  থাক যদি মনে   বিকচ  কমলাসনে,
 তুমি  কর যদি প্রাণ  তব প্রেমে  পরিপূর,
 প্রতিদিন  তব গাথা গাব  আমি সুমধুর॥
 তুমি  শোন যদি গান  আমার সমুখে  থাকি,
 সুধা  যদি করে দান  তোমার উদার  আঁখি,
 তুমি  যদি দুখ’পরে  রাখ কর  স্নেহভরে,
 তুমি  যদি সুখ হতে  দম্ভ করহ দূর
 প্রতিদিন  তব গাথা গাব  আমি সুমধুর॥

১৭৮ :: নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে ওগো অন্তরযামী

 নিশীথশয়নে  ভেবে রাখি মনে,  ওগো  অন্তরযামী,
 প্রভাতে  প্রথম নয়ন  মেলিয়া  তোমারে হেরিব  আমি
                 ওগো  অন্তরযামী॥
 জাগিয়া  বসিয়া শুভ্র  আলোকে তোমার  চরণে নমিয়া পুলকে
 মনে  ভেবে রাখি  দিনের কর্ম  তোমারে সঁপিব  স্বামী
                 ওগো  অন্তরযামী॥
 দিনের  কর্ম সাধিতে  সাধিতে    ভেবে রাখি মনে  মনে
 কর্ম-অন্তে  সন্ধ্যাবেলায়  বসিব তোমারি  সনে।
 দিন-অবসানে  ভাবি ব’সে ঘরে   তোমার  নিশীথবিরামসাগরে
 শ্রান্ত  প্রাণের  ভাবনা বেদনা  নীরবে যাইবে নামি
                 ওগো  অন্তরযামী॥

১৭৯ :: প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে

 প্রতিদিন  আমি, হে  জীবনস্বামী, দাঁড়াব  তোমারি  সম্মুখে।
 করি  জোড়কর, হে  ভুবনেশ্বর, দাঁড়াব  তোমারি  সম্মুখে॥
         তোমার  অপার আকাশের  তলে বিজনে  বিরলে হে—
         নম্র  হৃদয়ে নয়নের  জলে দাঁড়াব  তোমারি সম্মুখে॥
 তোমার  বিচিত্র এ  ভবসংসারে  কর্মপারাবারপারে  হে—
 নিখিল  ভুবনলোকের  মাঝারে  দাঁড়াব  তোমারি সম্মুখে॥
         তোমার  এ ভবে মম কর্ম  যবে সমাপন হবে  হে—
         ওগো  রাজরাজ, একাকী  নীরবে দাঁড়াব  তোমারি  সম্মুখে॥

১৮০ :: জাগিতে হবে রে

            জাগিতে  হবে রে—
      মোহনিদ্রা  কভু না রবে  চিরদিন,
 ত্যজিতে  হইবে সুখশয়ন  অশনিঘোষণে॥
      জাগে  তাঁর  ন্যায়দণ্ড  সর্বভুবনে,
      ফিরে  তাঁর কালচক্র  অসীম গগনে,
      জ্বলে  তাঁর  রুদ্রনেত্র  পাপতিমিরে॥

১৮১ :: আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারি নি তোমারে নাথ

 আমার  যা আছে আমি  সকল দিতে পারি  নি তোমারে  নাথ—
 আমার  লাজ ভয়, আমার  মান অপমান, সুখ  দুখ ভাবনা।
         মাঝে  রয়েছে আবরণ কত  শত, কতমতো—
         তাই  কেঁদে ফিরি, তাই  তোমারে না পাই,
         মনে  থেকে যায় তাই  হে মনের  বেদনা॥
         যাহা  রেখেছি তাহে  কী সুখ—
         তাহে  কেঁদে মরি, তাহে  ভেবে মরি।
 তাই  দিয়ে যদি  তোমারে পাই  কেন তা দিতে  পারি না?
 আমার  জগতের সব  তোমারে দেব, দিয়ে  তোমারে নেব—  বাসনা॥

১৮২ :: জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই

 জড়ায়ে  আছে বাধা, ছাড়ায়ে  যেতে চাই—
           ছাড়াতে  গেলে ব্যথা  বাজে।
 মুক্তি  চাহিবারে  তোমার কাছে  যাই,
           চাহিতে  গেলে মরি  লাজে॥
 জানি  হে তুমি মম  জীবনে  শ্রেয়তম,
 এমন  ধন আর নাহি যে  তোমা-সম,
 তবু  যা ভাঙাচোরা  ঘরেতে আছে  পোরা
           ফেলিয়া  দিতে পারি না  যে॥
 তোমারে  আবরিয়া  ধুলাতে ঢাকে  হিয়া,
           মরণ  আনে রাশি  রাশি—
 আমি  যে প্রাণভরি  তাদের ঘৃণা  করি
           তবুও  তাই  ভালোবাসি।
 এতই  আছে বাকি, জমেছে  এত ফাঁকি,
 কত যে  বিফলতা, কত যে  ঢাকাঢাকি,
 আমার  ভালো তাই  চাহিতে যবে  যাই
           ভয় যে  আসে  মনোমাঝে॥

১৮৩ :: উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে

                উড়িয়ে  ধ্বজা  অভ্রভেদী রথে
                ওই-যে  তিনি, ওই-যে  বাহির পথে॥
 আয় রে  ছুটে, টানতে  হবে রশি—
 ঘরের  কোণে রইলি  কোথায় বসি!
 ভিড়ের  মধ্যে  ঝাঁপিয়ে পড়ে  গিয়ে
                ঠাঁই  ক’রে তুই নে রে  কোনোমতে॥
       কোথায়  কী তোর আছে  ঘরের কাজ
       সে-সব  কথা ভুলতে হবে  আজ।
 টান্‌  রে দিয়ে সকল  চিত্তকায়া,
 টান্‌  রে ছেড়ে তুচ্ছ  প্রাণের মায়া,
 চল্‌  রে টেনে আলোয়  অন্ধকারে
                নগর-গ্রামে  অরণ্যে  পর্বতে॥
       ওই-যে  চাকা ঘুরছে রে  ঝন্‌ঝনি,
       বুকের  মাঝে শুনছ কি  সেই ধ্বনি?
 রক্তে  তোমার দুলছে  না কি প্রাণ ?
 গাইছে  না মন মরণজয়ী  গান?
 আকাঙক্ষা  তোর  বন্যাবেগের  মতো
                ছুটছে না কি বিপুল ভবিষ্যতে॥

১৮৪ :: আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ

        আপনারে  দিয়ে রচিলি রে  কি এ আপনারই আবরণ!
        খুলে  দেখ্‌ দ্বার, অন্তরে  তার  আনন্দনিকেতন॥
 মুক্তি  আজিকে নাই  কোনো ধারে,   আকাশে  সেও যে বাঁধে  কারাগারে,
        বিষনিশ্বাসে  তাই ভরে আসে  নিরুদ্ধ  সমীরণ॥
        ঠেলে  দে আড়াল; ঘুচিবে  আঁধার— আপনারে  ফেল্‌ দূরে—
        সহজে  তখনি জীবন  তোমার অমৃতে  উঠিবে পূরে।
 শূন্য  করিয়া রাখ্‌  তোর বাঁশি,   বাজাবার  যিনি বাজাবেন  আসি—
        ভিক্ষা  না নিবি, তখনি  জানিবি    ভরা আছে তোর  ধন॥

১৮৫ :: বাঁধন-ছেঁড়ার সাধন হবে

 বাঁধন-ছেঁড়ার  সাধন হবে,
 ছেড়ে  যাব তীর মাভৈ-রবে॥
     যাঁহার হাতের বিজয়মালা
     রুদ্রদাহের বহ্নিজ্বালা
             নমি নমি নমি সে ভৈরবে॥
 কালসমুদ্রে  আলোর যাত্রী
 শূন্যে  যে ধায় দিবস-রাত্রি।
     ডাক  এল তার  তরঙ্গেরই,
     বাজুক  বক্ষে  বজ্রভেরী
             অকূল প্রাণের সে উৎসবে॥

১৮৬ :: আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে

             আমায়   মুক্তি  যদি দাও বাঁধন  খুলে
             আমি    তোমার  বাঁধন নেব  তুলে॥
    যে পথে  ধাই নিরবধি   সে পথ  আমার ঘোচে যদি
             যাব   তোমার  মাঝে পথের  ভুলে॥
                   যদি   নেবাও ঘরের আলো
             তোমার   কালো  আঁধার বাসব  ভালো।
 তীর  যদি আর না যায়  দেখা    তোমার আমি হব  একা
               দিশাহারা  সেই অকূলে॥

১৮৭ :: বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ কেমনে দিই ফাঁকি

         বিশ্বজোড়া  ফাঁদ পেতেছ, কেমনে  দিই ফাঁকি!
         আধেক  ধরা পড়েছি গো, আধেক  আছে বাকি॥
 কেন  জানি আপনা  ভুলে    বারেক হৃদয়  যায় যে খুলে,
                      বারেক  তারে ঢাকি॥
         বাহির  আমার শুক্তি  যেন কঠিন  আবরণ—
         অন্তরে  মোর তোমার  লাগি একটি  কান্না-ধন।
 হৃদয়  বলে তোমার  দিকে    রইবে চেয়ে  অনিমিখে,
                     চায়  না কেন আঁখি ?।

১৮৮ :: এ আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে

          এ  আবরণ ক্ষয় হবে  গো ক্ষয় হবে,
          এ  দেহমন  ভূমানন্দময়  হবে॥
 চোখে আমার মায়ার  ছায়া টুটবে গো,
 বিশ্বকমল  প্রাণে আমার  ফুটবে গো,
          এ  জীবনে তোমারি,  নাথ, জয় হবে॥
 রক্ত  আমার  বিশ্বতালে  নাচবে যে,
 হৃদয়  আমার বিপুল  প্রাণে  বাঁচবে যে।
          কাঁপবে  তোমার আলো-বীণার  তারে সে,
          দুলবে  তোমার  তারামণির  হারে সে,
                   বাসনা তার ছড়িয়ে গিয়ে লয় হবে॥

১৮৯ :: সহজ হবি সহজ হবি ওরে মন সহজ হবি

 সহজ  হবি, সহজ হবি, ওরে  মন, সহজ হবি—
 কাছের  জিনিস দূরে  রাখে    তার থেকে তুই  দূরে র’বি॥
 কেন রে  তোর দু হাত  পাতা—    দান তো না  চাই, চাই যে  দাতা—
          সহজে  তুই দিবি যখন  সহজে তুই সকল  লবি॥
          সহজ  হবি, সহজ হবি, ওরে  মন, সহজ হবি—
          আপন  বচন-রচন হতে  বাহির হয়ে আয়  রে কবি।
 সকল  কথার  বাহিরেতে     ভুবন  আছে হৃদয় পেতে,
          নীরব  ফুলের নয়ন-পানে  চেয়ে আছে  প্রভাত-রবি॥

১৯০ :: এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোরে পেতেই হবে

 এই  কথাটা ধরে  রাখিস— মুক্তি  তোরে পেতেই  হবে।
 যে পথ  গেছে পারের  পানে সে পথে  তোর যেতেই  হবে॥
          অভয়  মনে কণ্ঠ ছাড়ি     গান গেয়ে তুই  দিবি পাড়ি,
          খুশি  হয়ে ঝড়ের  হাওয়ায় ঢেউ যে  তোরে খেতেই  হবে॥
 পাকের  ঘোরে ঘোরায়  যদি, ছুটি  তোরে পেতেই  হবে।
 চলার  পথে কাঁটা  থাকে, দ’লে  তোমায় যেতেই  হবে।
          সুখের  আশা আঁকড়ে  লয়ে    মরিস নে তুই  ভয়ে ভয়ে,
          জীবনকে  তোর ভ’রে নিতে  মরণ-আঘাত  খেতেই হবে॥

১৯১ :: সেই তো আমি চাই

               সেই  তো আমি চাই—
      সাধনা  যে শেষ হবে  মোর সে ভাবনা  তো নাই॥
 ফলের  তরে নয় তো  খোঁজা,   কে  বইবে সেই বিষম  বোঝা—
      যেই  ফলে ফল ধুলায়  ফেলে আবার ফুল  ফুটাই॥
      এমনি  ক’রে মোর  জীবনে অসীম  ব্যাকুলতা,
      নিত্য  নূতন সাধনাতে  নিত্যনূতন  ব্যথা!
 পেলেই  সে তো ফুরিয়ে  ফেলি,   আবার  আমি দু হাত  মেলি—
      নিত্য  দেওয়া ফুরায়  না যে, নিত্য  নেওয়া তাই॥

১৯২ :: আর রেখো না আঁধারে আমায় দেখতে দাও

       আর   রেখো না  আঁধারে,   আমায়    দেখতে দাও।
 তোমার  মাঝে আমার  আপনারে    দেখতে দাও॥
 কাঁদাও  যদি কাঁদাও  এবার,   সুখের  গ্লানি সয় না  যে আর,
        নয়ন  আমার যাক-না  ধুয়ে  অশ্রুধারে—
              আমায়   দেখতে  দাও॥
        জানি  না তো কোন্‌  কালো এই ছায়া,
        আপন  ব’লে ভুলায়  যখন ঘনায় বিষম  মায়া।
 স্বপ্নভারে  জমল বোঝা,       চিরজীবন শূন্য খোঁজা—
        যে মোর  আলো লুকিয়ে  আছে রাতের  পারে
              আমায়   দেখতে  দাও॥

১৯৩ :: দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক

 দুঃখের  তিমিরে যদি  জ্বলে তব  মঙ্গল-আলোক
                  তবে  তাই হোক।
 মৃত্যু  যদি কাছে আনে  তোমার অমৃতময়  লোক
                  তবে  তাই হোক॥
 পূজার  প্রদীপে তব  জ্বলে যদি মম  দীপ্ত শোক
                  তবে  তাই হোক।
 অশ্রু-আঁখি-’পরে  যদি ফুটে ওঠে  তব স্নেহচোখ
                  তবে  তাই হোক॥

১৯৪ :: আমার আঁধার ভালো আলোর কাছে বিকিয়ে দেবে আপনাকে সে

 আমার    আঁধার  ভালো, আলোর  কাছে বিকিয়ে  দেবে আপনাকে  সে।
               আলোরে  যে লোপ ক’রে  খায় সেই  কুয়াশা  সর্বনেশে॥
               অবুঝ  শিশু মায়ের  ঘরে    সহজ মনে  বিহার করে,
               অভিমানী  জ্ঞানী তোমার  বাহির দ্বারে  ঠেকে এসে॥
 তোমার   পথ  আপনায় আপনি  দেখায়, তাই  বেয়ে, মা, চলব  সোজা।
 যারা       পথ  দেখাবার ভিড়  করে গো তারা  কেবল বাড়ায়  খোঁজা।
 ওরা        ডাকে  আমায় পূজার  ছলে, এসে দেখি  দেউল-তলে—
               আপন  মনের  বিকারটারে  সাজিয়ে রাখে  ছদ্মবেশে॥

১৯৫ :: এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে পার হল

 এবার      দুঃখ  আমার অসীম  পাথার    পার হল যে, পার  হল।
 তোমার   পায়ে  এসে ঠেকল শেষে,   সকল  সুখের সার  হল॥
               এত দিন  নয়নধারা    বয়েছে    বাঁধনহারা,
               কেন  বয়   পাই  নি যে তার  কূলকিনারা—
 আজ      গাঁথল  কে সেই  অশ্রুমালা,   তোমার  গলার হার হল॥
 তোমার    সাঁঝের  তারা ডাকল  আমায়    যখন অন্ধকার  হল।
               বিরহের    ব্যথাখানি  খুঁজে তো   পায় নি  বাণী,
               এত দিন  নীরব  ছিল শরম মানি—
 আজ      পরশ  পেয়ে উঠল গেয়ে,  তোমার  বীণার তার  হল॥

১৯৬ :: যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে দুঃখধারার ভরা স্রোতে

 যারে   নিজে  তুমি  ভাসিয়েছিলে  দুঃখধারার ভরা  স্রোতে
 তারে   ডাক  দিলে আজ কোন্‌  খেয়ালে
                 আবার  তোমার ও পার  হতে॥
           শ্রাবণ-রাতে  বাদল-ধারে   উদাস  ক’রে কাঁদাও  যারে
           আবার  তারে ফিরিয়ে  আনো ফুল-ফোটানো  ফাগুন-রাতে॥
           এ পার  হতে ও পার ক’রে  বাটে  বাটে ঘোরাও  মোরে।
           কুড়িয়ে  আনা, ছড়িয়ে  ফেলা,  এই  কি তোমার একই  খেলা—
           লাগাও  ধাঁধা বারে  বারে এই  আঁধারে এই  আলোতে॥

১৯৭ :: আমায় দাও গো বলে

            আমায়   দাও গো  বলে
 সে কি   তুমি  আমায় দাও দোলা  অশান্তিদোলে।
 দেখতে  না পাই পিছে  থেকে    আঘাত দিয়ে  হৃদয়ে কে
             ঢেউ  যে তোলে॥
 মুখ  দেখি নে তাই  লাগে ভয়— জানি  না যে, এ কিছু  নয়।
 মুছব  আঁখি, উঠব  হেসে— দোলা যে  দেয় যখন এসে
             ধরবে  কোলে॥

১৯৮ :: তোর শিকল আমায় বিকল করবে না

 তোর        শিকল  আমায় বিকল  করবে না।
 তোর        মারে  মরম মরবে না॥
 তাঁর         আপন  হাতের  ছাড়াচিঠি সেই  যে
 আমার     মনের  ভিতর রয়েছে এই  যে,
 তোদের    ধরা  আমায় ধরবে  না॥
                যে পথ  দিয়ে আমার  চলাচল
 তোর        প্রহরী তার  খোঁজ পাবে কি  বল্‌।
 আমি        তাঁর  দুয়ারে পৌঁছে  গেছি রে,
 মোরে       তোর  দুয়ারে  ঠেকাবে কি রে?
 তোর        ডরে  পরান ডরবে  না॥

১৯৯ :: আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে

 আমি     মারের  সাগর পাড়ি দেব  বিষম ঝড়ের  বায়ে
 আমার   ভয়ভাঙা  এই নায়ে॥
              মাভৈঃ বাণীর  ভরসা নিয়ে  ছেঁড়া  পালে বুক  ফুলিয়ে
 তোমার  ওই  পারেতেই যাবে  তরী ছায়াবটের ছায়ে॥
             পথ  আমারে সেই  দেখাবে যে  আমারে চায়—
 আমি     অভয় মনে  ছাড়ব তরী, এই  শুধু মোর দায়।
             দিন  ফুরালে, জানি  জানি,  পৌঁছে  ঘাটে দেব আনি
 আমার  দুঃখদিনের  রক্তকমল  তোমার করুণ  পায়॥

২০০ :: বাহিরে ভুল হানবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙবে কি

 বাহিরে  ভুল হানবে যখন  অন্তরে ভুল  ভাঙবে কি?
 বিষাদবিষে  জ্বলে শেষে  তোমার প্রসাদ  মাঙবে কি?।
 রৌদ্রদাহ  হলে সারা  নামবে  কি ওর বর্ষাধারা ?
 লাজের  রাঙা মিটলে  হৃদয় প্রেমের  রঙে রাঙবে কি?।
               যতই  যাবে দূরের  পানে
 বাঁধন  ততই কঠিন হয়ে  টানবে না কি  ব্যথার টানে!
 অভিমানের  কালো মেঘে   বাদল-হাওয়া  লাগবে বেগে,
 নয়নজলের  আবেগ তখন  কোনোই বাধা  মানবে কি॥

২০১ :: আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন

 আমার   সকল  দুখের প্রদীপ  জ্বেলে দিবস গেলে  করব নিবেদন—
                       আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমপন॥
            যখন  বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা  যায় আপন কুলায়-মাঝে,
                      সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে,
            তখন  আপন শেষ শিখাটি  জ্বালবে এ  জীবন—
                      আমার   ব্যথার পূজা হবে সমাপন॥
            অনেক  দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা,  বাঁধা বেদন-ডোরে,
                      মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ’রে।
            যখন  পূজার  হোমানলে উঠবে  জ্বলে একে একে  তারা,
                      আকাশ-পানে ছুটবে বাঁধন-হারা,
            অস্তরবির  ছবির সাথে মিলবে আয়োজন—
                      আমার   ব্যথার পূজা হবে সমাপন॥

২০২ :: আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে

 আজি   বিজন  ঘরে  নিশীথরাতে   আসবে যদি  শূন্য হাতে—
                 আমি    তাইতে  কি ভয় মানি!
                 জানি    জানি, বন্ধু, জানি—
                 তোমার   আছে তো  হাতখানি॥
           চাওয়া-পাওয়ার  পথে পথে    দিন কেটেছে  কোনোমতে,
 এখন   সময় হল  তোমার কাছে  আপনাকে দিই  আনি॥
                 আঁধার থাকুক দিকে  দিকে আকাশ-অন্ধ-করা,
                 তোমার   পরশ  থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।
                জীবনদোলায়  দুলে দুলে     আপনারে  ছিলেম ভুলে,
 এখন   জীবন  মরণ দু দিক  দিয়ে নেবে  আমায় টানি॥

২০৩ :: যখন তোমায় আঘাত করি তখন চিনি

           যখন  তোমায় আঘাত  করি তখন চিনি।
           শত্রু  হয়ে দাঁড়াই  যখন লও যে  জিনি॥
 এ  প্রাণ যত  নিজের তরে   তোমারি  ধন হরণ করে
           ততই  শুধু তোমার  কাছে হয় যে  ঋণী॥
           উজিয়ে  যেতে চাই  যতবার  গর্বসুখে
           তোমার  স্রোতের  প্রবল পরশ পাই  যে বুকে।
 আলো যখন আলস-ভরে   নিবিয়ে  ফেলি আপন ঘরে
           লক্ষ  তারা জ্বালায়  তোমার  নিশীথিনী॥

২০৪ :: দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে

 দুঃখ  যদি না পাবে  তো   দুঃখ  তোমার ঘুচবে  কবে?
          বিষকে  বিষের দাহ  দিয়ে    দহন করে  মারতে হবে॥
 জ্বলতে  দে তোর  আগুনটারে,   ভয় কিছু  না করিস তারে,
          ছাই  হয়ে সে নিভবে  যখন জ্বলবে না  আর কভু তবে॥
 এড়িয়ে  তাঁরে পালাস  না রে,   ধরা  দিতে হোস না  কাতর।
          দীর্ঘ  পথে ছুটে ছুটে  দীর্ঘ করিস দুঃখটা  তোর।
 মরতে  মরতে  মরণটারে   শেষ ক’রে  দে একেবারে,
          তার  পরে সেই জীবন  এসে    আপন আসন আপনি  লবে॥

২০৫ :: যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি

 যেতে  যেতে একলা পথে  নিবেছে মোর  বাতি।
 ঝড়  এসেছে, ওরে, এবার  ঝড়কে পেলেম  সাথি॥
 আকাশকোণে  সর্বনেশে   ক্ষণে  ক্ষণে উঠছে  হেসে,
         প্রলয়  আমার কেশে  বেশে করছে  মাতামাতি॥
 যে পথ  দিয়ে  যেতেছিলেম  ভুলিয়ে দিল  তারে,
 আবার  কোথা চলতে হবে  গভীর  অন্ধকারে।
 বুঝি  বা এই  বজ্ররবে   নূতন  পথের বার্তা কবে—
         কোন্‌  পুরীতে গিয়ে  তবে প্রভাত  হবে রাতি॥

২০৬ :: না বাঁচাবে আমায় যদি মারবে কেন তবে

           না  বাঁচাবে আমায়  যদি মারবে কেন  তবে?
           কিসের  তরে এই আয়োজন  এমন কলরবে?।
     অগ্নিবাণে  তূণ যে ভরা,         চরণভরে  কাঁপে ধরা,
           জীবনদাতা  মেতেছে যে মরণ-মহোৎসবে॥
     বক্ষ  আমার এমন ক’রে  বিদীর্ণ যে  করো
           উৎস  যদি না  বাহিরায় হবে  কেমনতরো?
     এই-যে  আমার ব্যথার  খনি     জোগাবে ওই  মুকুট-মণি—
           মরণদুখে  জাগাবে মোর  জীবনবল্লভে॥

২০৭ :: মোর মরণে তোমার হবে জয়

  মোর        মরণে  তোমার হবে জয়।
  মোর        জীবনে  তোমার  পরিচয়॥
  মোর        দুঃখ যে  রাঙা শতদল
  আজি     ঘিরিল  তোমার পদতল,
  মোর        আনন্দ  সে যে মণিহার   মুকুটে  তোমার বাঁধা  রয়॥
  মোর        ত্যাগে  যে তোমার হবে  জয়।
  মোর        প্রেমে  যে তোমার  পরিচয়।
  মোর        ধৈর্য  তোমার রাজপথ
  সে যে     লঙ্ঘিবে  বনপর্বত,
  মোর        বীর্য  তোমার জয়রথ   তোমারি  পতাকা শিরে  বয়॥

২০৮ :: হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে

          হৃদয়  আমার প্রকাশ  হল অনন্ত  আকাশে।
          বেদন-বাঁশি  উঠল বেজে  বাতাসে  বাতাসে॥
 এই-যে  আলোর আকুলতা   আমারি এ  আপন কথা,
          ফিরে এসে  আমার প্রাণে  আমারে  উদাসে॥
          বাইরে  তুমি নানা  বেশে ফের নানা  ছলে;
          জানি  নে তো আমার  মালা দিয়েছি  কার গলে।
 আজ কী  দেখি পরান-মাঝে,   তোমার  গলায় সব মালা  যে—
          সব  নিয়ে শেষ ধরা  দিলে গভীর  সর্বনাশে॥

২০৯ :: যখন তুমি বাঁধছিলে তার সে যে বিষম ব্যথা

 যখন  তুমি  বাঁধছিলে তার  সে যে বিষম  ব্যথা—
 বাজাও  বীণা, ভুলাও  ভুলাও সকল  দুখের কথা॥
          এতদিন  যা সঙ্গোপনে   ছিল  তোমার মনে মনে
          আজকে  আমার তারে  তারে শুনাও সে  বারতা॥
 আর  বিলম্ব কোরো  না গো, ওই-যে  নেবে বাতি।
 দুয়ারে  মোর নিশীথিনী  রয়েছে কান  পাতি।
          বাঁধলে  যে সুর তারায়  তারায়    অন্তবিহীন  অগ্নিধারায়,
          সেই  সুরে মোর  বাজাও প্রাণে  তোমার  ব্যাকুলতা॥

২১০ :: এই-যে কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা

 এই-যে  কালো মাটির  বাসা শ্যামল  সুখের ধরা—
 এইখানেতে  আঁধার-আলোয়  স্বপন-মাঝে  চরা॥
 এরই  গোপন হৃদয়-’পরে   ব্যথার স্বর্গ বিরাজ  করে
                   দুঃখে-আলো-করা॥
 বিরহী  তোর সেইখানে  যে একলা বসে  থাকে—
 হৃদয়  তাহার ক্ষণে  ক্ষণে নামটি  তোমার ডাকে।
 দুঃখে  যখন মিলন হবে  আনন্দলোক  মিলবে তবে
                   সুধায়-সুধায়-ভরা॥

২১১ :: এক হাতে ওর কৃপাণ আছে আর-এক হাতে হার

                   এক হাতে  ওর কৃপাণ আছে, আর-এক  হাতে হার।
                        ও যে         ভেঙেছে  তোর দ্বার॥
 আসে নি ও  ভিক্ষা নিতে,   না না  না—        লড়াই করে  নেবে জিতে
                               পরানটি  তোমার॥
                   মরণেরই  পথ দিয়ে ওই  আসছে জীবন-মাঝে
                        ও যে     আসছে  বীরের সাজে।
 আধেক  নিয়ে ফিরবে না  রে,   না  না না—  যা আছে  সব একেবারে
                           করবে  অধিকার॥

২১২ :: আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে

    আগুনের         পরশমণি  ছোঁয়াও  প্রাণে।
    এ জীবন         পুণ্য  করো    দহন-দানে॥
    আমার এই       দেহখানি   তুলে  ধরো,
    তোমার  ওই       দেবালয়ের   প্রদীপ  করো—
    নিশিদিন          আলোক-শিখা   জ্বলুক  গানে॥
    আঁধারের         গায়ে  গায়ে    পরশ তব
    সারা  রাত        ফোটাক তারা   নব নব।
    নয়নের            দৃষ্টি হতে   ঘুচবে  কালো,
    যেখানে           পড়বে  সেথায়    দেখবে আলো—
    ব্যথা  মোর         উঠবে জ্বলে  ঊধর্ব-পানে॥

২১৩ :: ওরে কে রে এমন জাগায় তোকে

      ওরে,      কে রে  এমন জাগায়  তোকে?
                    ঘুম কেন নেই তোরই চোখে?
  চেয়ে  আছিস আপন-মনে—   ওই যে  দূরে গগন-কোণে
  রাত্রি  মেলে রাঙা  নয়ন    রুদ্রদেবের  দীপ্তালোকে॥
                     রক্তশতদলের  সাজি
                     সাজিয়ে  কেন রাখিস আজি ?
  কোন্‌  সাহসে  একেবারে   শিকল  খুলে দিলি  দ্বারে—
  জোড়হাতে  তুই ডাকিস  কারে,   প্রলয়  যে তোর ঘরে  ঢোকে॥

২১৪ :: আঘত করে নিলে জিনে

               আঘত করে  নিলে জিনে,
               কাড়িলে  মন দিনে  দিনে॥
 সুখের  বাধা ভেঙে  ফেলে    তবে আমার  প্রাণে এলে—
 বারে  বারে মরার  মুখে অনেক  দুখে নিলেম  চিনে॥
               তুফান  দেখে ঝড়ের  রাতে
               ছেড়েছি  হাল তোমার  হাতে।
 বাটের  মাঝে, হাটের  মাঝে, কোথাও  আমায় ছাড়লে না-যে—
 যখন  আমার সব  বিকালো তখন  আমায় নিলে  কিনে॥

২১৫ :: ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর

                 ওগো  আমার প্রাণের  ঠাকুর,
 তোমার    প্রেম  তোমারে এমন  ক’রে করেছে নিষ্ঠুর॥
 তুমি    বসে  থাকতে দেবে না  যে,   দিবানিশি  তাই তো বাজে
                 পরান-মাঝে  এমন কঠিন  সুর॥
                 ওগো  আমার প্রাণের  ঠাকুর,
                 তোমার  লাগি দুঃখ  আমার হয় যেন  মধুর।
 তোমার  খোঁজা খোঁজায়  মোরে,   তোমার  বেদন কাঁদায়  ওরে,
                 আরাম  যত করে কোথায়  দূর॥

২১৬ :: সুখে আমায় রাখবে কেন রাখো তোমার কোলে

  সুখে  আমায় রাখবে  কেন, রাখো  তোমার কোলে।
                যাক-না  গো সুখ  জ্বলে॥
   যাক-না  পায়ের তলার  মাটি,   তুমি  তখন ধরবে  আঁটি—
           তুলে  নিয়ে দুলাবে  ওই বাহুদোলার  দোলে॥
           যেখানে  ঘর বাঁধব আমি  আসে আসুক বান—
           তুমি  যদি ভাসাও  মোরে চাই নে  পরিত্রাণ।
  হার  মেনেছি, মিটেছে  ভয়— তোমার জয়  তো আমারি জয়
           ধরা  দেব, তোমায়  আমি ধরব যে  তাই হলে॥

২১৭ :: ও নিঠুর আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে

     ও নিঠুর,      আরো কি  বাণ তোমার  তূণে আছে?
         তুমি         মর্মে  আমায় মারবে  হিয়ার কাছে॥
 আমি    পালিয়ে  থাকি, মুদি  আঁখি,   আঁচল  দিয়ে মুখ যে  ঢাকি গো—
                        কোথাও  কিছু আঘাত  লাগে পাছে॥
      আমি          মারকে  তোমার ভয়  করেছি ব’লে।
                        তাই  তো এমন হৃদয়  ওঠে জ্বলে।
      যে দিন  সে ভয় ঘুচে  যাবে    সে দিন তোমার  বাণ ফুরাবে  গো—
                       মরণকে  প্রাণ বরণ করে  বাঁচে॥

২১৮ :: আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি সেথায় চরণ পড়ে

 আমি    হৃদয়েতে পথ  কেটেছি, সেথায়  চরণ পড়ে,
               তোমার   সেথায়  চরণ পড়ে।
       তাই তো  আমার সকল পরান  কাঁপছে  ব্যথার ভরে গো,
                   কাঁপছে  থরোথরে॥
       ব্যথাপথের  পথিক তুমি,   চরণ চলে  ব্যথা চুমি—
       কাঁদন  দিয়ে সাধন  আমার  চিরদিনের তরে  গো
                   চিরজীবন  ধ’রে॥
       নয়নজলের  বন্যা দেখে ভয়  করি নে আর,
          আমি    ভয় করি  নে আর।
       মরণ-টানে  টেনে আমায়  করিয়ে দেবে  পার,
           আমি    তরব  পারাবার।
       ঝড়ের  হাওয়া আকুল  গানে    বইছে আজি  তোমার পানে—
           ডুবিয়ে  তরী ঝাঁপিয়ে  পড়ি ঠেকব চরণ-’পরে,
                  আমি   বাঁচব  চরণ ধরে॥

২১৯ :: তোমার কাছে শান্তি চাব না

             তোমার  কাছে শান্তি  চাব না,
             থাক্‌-না  আমার দুঃখ  ভাবনা॥
 অশান্তির  এই দোলার ’পরে   বোসো  বোসো লীলার  ভরে,
             দোলা  দিব এ মোর  কামনা॥
             নেবে  নিবুক প্রদীপ  বাতাসে,
             ঝড়ের  কেতন উড়ুক  আকাশে—
 বুকের  কাছে ক্ষণে  ক্ষণে     তোমার চরণ-পরশনে
             অন্ধকারে  আমার সাধনা॥

২২০ :: যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে

          যে রাতে  মোর  দুয়ারগুলি  ভাঙল ঝড়ে
          জানি  নাই তো তুমি  এলে আমার  ঘরে॥
  সব যে  হয়ে গেল কালো,   নিবে  গেল দীপের আলো,
          আকাশ-পানে  হাত বাড়ালেম  কাহার তরে?।
          অন্ধকারে  রইনু পড়ে  স্বপন মানি।
          ঝড় তে  তোমার  জয়ধ্বজা তাই  কি জানি!
  সকাল  বেলায় চেয়ে  দেখি,   দাঁড়িয়ে  আছ তুমি এ কি
          ঘর-ভরা  মোর  শূন্যতারই  বুকের ’পরে॥

২২১ :: ভয়েরে মোর আঘাত করো ভীষণ হে ভীষণ

          ভয়েরে  মোর আঘাত করো  ভীষণ, হে ভীষণ!
          কঠিন  করে চরণ-’পরে  প্রণত করো  মন॥
 বেঁধেছে  মোরে নিত্য  কাজে    প্রাচীরে-ঘেরা  ঘরের মাঝে,
          নিত্য  মোরে বেঁধেছে  সাজে সাজের  আভরণ॥
 এসো হে, ওহে  আকস্মিক,   ঘিরিয়া  ফেলো সকল দিক,
          মুক্ত  পথে উড়ায়ে নিক  নিমেষে এ  জীবন।
 তাহার  ’পরে প্রকাশ  হোক    উদার তব সাহস  চোখ—
          তব অভয়  শান্তিময়  স্বরূপ  পুরাতন॥

২২২ :: বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি সে কি সহজ গান

              বজ্রে  তোমার বাজে  বাঁশি, সে কি  সহজ গান!
              সেই  সুরেতে জাগব  আমি, দাও মোরে  সেই কান॥
 আমি   ভুলব না  আর সহজেতে,   সেই  প্রাণে মন  উঠবে মেতে
              মৃত্যু-মাঝে  ঢাকা আছে যে  অন্তহীন  প্রাণ॥
              সে ঝড়  যেন সই আনন্দে  চিত্তবীণার তারে
              সপ্তসিন্ধু  দশদিগন্ত  নাচাও যে  ঝঙ্কারে।
    আরাম  হতে ছিন্ন  ক’রে    সেই গভীরে লও  গো মোরে
              অশান্তির  অন্তরে যেথায়  শান্তি  সুমহান॥

২২৩ :: এই করেছ ভালো নিঠুর হে নিঠুর হে এই করেছ ভালো

 এই করেছ  ভালো নিঠুর হে,   নিঠুর  হে,   এই  করেছ ভালো।
 এমনি  ক’রে হৃদয়ে  মোর তীব্র দহন  জ্বালো॥
       আমার এ  ধূপ না  পোড়ালে    গন্ধ কিছুই  নাহি ঢালে,
       আমার এ  দীপ না  জ্বালালে দেয়  না কিছুই  আলো॥
 যখন  থাকে অচেতনে এ  চিত্ত আমার
 আঘাত সে  যে পরশ তব, সেই  তো পুরস্কার।
       অন্ধকারে  মোহে লাজে   চোখে  তোমায় দেখি না  যে,
        বজ্রে  তোলো আগুন  ক’রে আমার যত  কালো॥

২২৪ :: আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারো

          আরো  আঘাত সইবে  আমার, সইবে  আমারো।
          আরো  কঠিন সুরে  জীবন-তারে  ঝঙ্কারো॥
 যে রাগ  জাগাও আমার  প্রাণে    বাজে নি তা চরম  তানে,
          নিঠুর  মূর্ছনায় সে  গানে মূর্তি  সঞ্চারো॥
          লাগে  না গো কেবল  যেন কোমল  করুণা,
          মৃদু  সুরের খেলায় এ  প্রাণ ব্যর্থ  কোরো না।
 জ্ব’লে  উঠুক সকল  হুতাশ,   গর্জি  উঠুক সকল  বাতাস,
          জাগিয়ে  দিয়ে সকল আকাশ  পূর্ণতা  বিস্তারো॥

২২৫ :: আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে

 আমি   বহু  বাসনায়  প্রাণপণে চাই,  বঞ্চিত করে  বাঁচালে  মোরে।
               এ কৃপা  কঠোর সঞ্চিত  মোর জীবন  ভ’রে॥
 না  চাহিতে মোরে  যা করেছ  দান—আকাশ আলোক  তনু মন প্রাণ,
             দিনে  দিনে তুমি  নিতেছ আমায় সে  মহা দানেরই  যোগ্য ক’রে
                অতি-ইচ্ছার  সঙ্কট হতে  বাঁচায়ে  মোরে॥
 আমি   কখনো বা  ভুলি কখনো বা  চলি তোমার  পথের লক্ষ্য  ধরে;
                তুমি  নিষ্ঠুর  সম্মুখ হতে  যাও যে সরে।
 এ যে তব  দয়া, জানি  জানি হায়,   নিতে  চাও ব’লে  ফিরাও আমায়—
        পূর্ণ  করিয়া লবে এ  জীবন তব  মিলনেরই  যোগ্য ক’রে
               আধা  ইচ্ছার সঙ্কট  হতে বাঁচায়ে  মোরে॥

২২৬ :: প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন

 প্রচণ্ড  গর্জনে আসিল  একি দুর্দিন—
 দারুণ  ঘনঘটা, অবিরল  অশনিতর্জন॥
 ঘন ঘন  দামিনী-ভুজঙ্গ-ক্ষত  যামিনী,
 অম্বর  করিছে  অন্ধনয়নে  অশ্রু-বরিষন॥
 ছাড়ো  রে শঙ্কা, জাগো  ভীরু অলস,
 আনন্দে  জাগাও অন্তরে  শকতি।
 অকুণ্ঠ  আঁখি মেলে  হেরো  প্রশান্ত  বিরাজিত
 মহাভয়-মহাসনে  অপরূপ  মৃত্যুঞ্জয়রূপে  ভয়হরণ॥

২২৭ :: বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা

 বিপদে  মোরে রক্ষা  করো এ নহে মোর  প্রার্থনা—
          বিপদে  আমি না যেন  করি ভয়।
 দুঃখতাপে  ব্যথিত চিতে  নাই বা দিলে  সান্ত্বনা,
          দুঃখে  যেন করিতে  পারি জয়॥
 সহায়  মোর না যদি  জুটে    নিজের বল না  যেন টুটে—
          সংসারেতে  ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে  শুধু বঞ্চনা
               নিজের  মনে না যেন  মানি ক্ষয়॥
 আমারে  তুমি করিবে  ত্রাণ এ নহে  মোর  প্রার্থনা—
               তরিতে  পারি শকতি যেন  রয়।
 আমার  ভার লাঘব করি  নাই বা দিলে  সান্ত্বনা,
               বহিতে  পারি এমনি যেন  হয়॥
 নম্রশিরে  সুখের দিনে   তোমারি  মুখ লইব চিনে—
          দুখের  রাতে নিখিল  ধরা যেদিন করে  বঞ্চনা
               তোমারে  যেন না করি  সংশয়॥

২২৮ :: আরো আরো প্রভু আরো আরো

 আরো  আরো, প্রভু, আরো  আরো
 এমনি  ক’রে আমায়  মারো॥
 লুকিয়ে  থাকি, আমি  পালিয়ে বেড়াই—
 ধরা  পড়ে গেছি, আর  কি এড়াই!
 যা-কিছু  আছে সব কাড়ো  কাড়ো॥
 এবার  যা করবার তা  সারো সারো,
 আমি  হারি কিম্বা  তুমিই হারো।
 হাটে  ঘাটে বাটে করি  মেলা,
 কেবল  হেসে খেলে  গেছে বেলা—
 দেখি  কেমনে  কাঁদাতে  পারো॥

২২৯ :: তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার

 তোমার   সোনার  থালায় সাজাব  আজ দুখের অশ্রুধার।
        জননী  গো, গাঁথব  তোমার গলার  মুক্তাহার॥
            চন্দ্র  সূর্য পায়ের  কাছে   মালা হয়ে জড়িয়ে  আছে,
 তোমার   বুকে  শোভা পাবে  আমার দুখের  অলঙ্কার॥
            ধন  ধান্য তোমারি  ধন কী করবে তা  কও।
            দিতে  চাও তো দিয়ো  আমায়, নিতে  চাও তো লও।
        দুঃখ  আমার ঘরের  জিনিস,   খাঁটি  রতন তুই তো  চিনিস—
 তোর     প্রসাদ  দিয়ে তারে  কিনিস এ মোর  অহঙ্কার॥

২৩০ :: দুখের বেশে এসেছ ব’লে তোমারে নাহি ডরিব হে

          দুখের  বেশে এসেছ  ব’লে তোমারে  নাহি ডরিব হে।
          যেখানে  ব্যথা তোমারে  সেথা নিবিড়  ক’রে ধরিব হে॥
  আঁধারে  মুখ ঢাকিলে, স্বামী,   তোমারে  তবু চিনিব আমি—
          মরণরূপে  আসিলে, প্রভু, চরণ  ধরি মরিব হে।
          যেমন  করে দাও-না  দেখা তোমারে  নাহি ডরিব  হে॥
          নয়নে  আজি ঝরিছে জল, ঝরুক  জল নয়নে হে।
          বাজিছে  বুকে বাজুক তব  কঠিন বাহু-বাঁধন  হে।
 তুমি  যে আছ বক্ষে  ধরে    বেদনা তাহা  জানাক মোরে—
          চাব না  কিছু, কব না  কথা, চাহিয়া  রব বদনে হে॥

২৩১ :: তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি

     তোমার  পতাকা যারে  দাও তারে  বহিবারে দাও  শকতি।
     তোমার  সেবার মহান দুঃখ  সহিবারে দাও  ভকতি॥
 আমি তাই  চাই ভরিয়া  পরান    দুঃখের সাথে  দুঃখের ত্রাণ,
     তোমার  হাতের বেদনার  দান এড়ায়ে  চাহি না মুকতি।
     দুখ  হবে মম মাথার  ভূষণ সাথে যদি  দাও ভকতি॥
     যত  দিতে চাও কাজ  দিয়ো যদি  তোমারে না দাও  ভুলিতে,
     অন্তর  যদি জড়াতে না  দাও  জালজঞ্জালগুলিতে।
 বাঁধিয়ো  আমারে যত খুশি  ডোরে    মুক্ত রাখিয়ো  তোমা-পানে  মোরে,
     ধুলায়  রাখিয়ো  পবিত্র ক’রে  তোমার  চরণধূলিতে—
     ভুলায়ে  রাখিয়ো  সংসারতলে, তোমারে  দিয়ো না  ভুলিতে॥
     যে পথে  ঘুরিতে দিয়েছ  ঘুরিব    যাই যেন তব চরণে,
     সব  শ্রম যেন বহি  লয় মোরে  সকলশ্রান্তিহরণে।
 দুর্গম  পথ এ ভবগহন—    কত  ত্যাগ শোক  বিরহদহন—
     জীবনে  মৃত্যু করিয়া  বহন প্রাণ পাই  যেন মরণে—
     সন্ধ্যাবেলায়  লভি গো কুলায়  নিখিলশরণ  চরণে॥

২৩২ :: দুখ দিয়েছ দিয়েছ ক্ষতি নাই কেন গো একেলা ফেলে রাখ

         দুখ  দিয়েছ, দিয়েছ  ক্ষতি নাই, কেন  গো একেলা ফেলে  রাখ?
         ডেকে  নিলে ছিল যারা  কাছে, তুমি  তবে কাছে কাছে  থাকো॥
 প্রাণ  কারো সাড়া  নাহি পায়,    রবি শশী  দেখা নাহি যায়,
         এ পথে  চলে যে অসহায়—  তারে তুমি  ডাকো, প্রভু, ডাকো॥
         সংসারের  আলো নিভাইলে, বিষাদের  আঁধার ঘনায়,
         দেখাও  তোমার  বাতায়নে চির-আলো  জ্বলিছে  কোথায়।
 শুষ্ক  নির্ঝরের  ধারে রই,      পিপাসিত  প্রাণ কাঁদে  ওই—
         অসীম  প্রেমের উৎস  কই, আমারে  তৃষিত রেখো  নাকো॥
         কে  আমার আত্মীয়  স্বজন— আজ আসে, কাল  চলে যায়।
         চরাচর  ঘুরিছে কেবল, জগতের  বিশ্রাম  কোথায়।
 সবাই  আপনা নিয়ে রয়   কে  কাহারে দিবে  গো আশ্রয়—
         সংসারের  নিরাশ্রয় জনে  তোমার  স্নেহেতে, নাথ,  ঢাকো॥

২৩৩ :: হে মহাদুঃখ হে রুদ্র হে ভয়ঙ্কর ওহে শঙ্কর হে প্রলয়ঙ্কর

  হে  মহাদুঃখ, হে  রুদ্র, হে  ভয়ঙ্কর, ওহে  শঙ্কর, হে  প্রলয়ঙ্কর।
  হোক  জটানিঃসৃত  অগ্নিভুজঙ্গম   -দংশনে  জর্জর স্থাবর  জঙ্গম,
        ঘন ঘন  ঝন ঝন ঝননন   ঝননন  পিনাক  টঙ্করো॥

২৩৪ :: সর্ব খর্বতারে দহে তব ত্রোধদাহ

           সর্ব  খর্বতারে দহে  তব ত্রোধদাহ—
           হে  ভৈরব, শক্তি  দাও, ভক্ত-পানে  চাহো॥
    দূর করো মহারুদ্র    যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র—
           মৃত্যুরে  করিবে তুচ্ছ  প্রাণের  উৎসাহ॥
                দুঃখের  মন্থনবেগে  উঠিবে অমৃত,
                 শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।
           তব  দীপ্ত রৌদ্র  তেজে    নির্ঝরিয়া  গলিবে যে
                 প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত  ত্যাগের  প্রবাহ॥

২৩৫ :: নয় এ মধুর খেলা

                                    নয় এ  মধুর খেলা—
  তোমায়  আমায়  সারাজীবন  সকাল-সন্ধ্যাবেলা    নয় এ  মধুর খেলা॥
          কতবার  যে নিবল বাতি,   গর্জে  এল ঝড়ের রাতি—
            সংসারের  এই দোলায় দিলে  সংশয়েরই  ঠেলা॥
              বারে  বারে বাঁধ  ভাঙিয়া বন্যা  ছুটেছে।
              দারুণ  দিনে দিকে  দিকে কান্না  উঠেছে।
          ওগো  রুদ্র, দুঃখে  সুখে    এই কথাটি  বাজল বুকে—
             তোমার  প্রেমে আঘাত  আছে, নাইকো  অবহেলা॥

২৩৬ :: জাগো হে রুদ্র জাগো

                জাগো  হে রুদ্র, জাগো—
    সুপ্তিজড়িত  তিমিরজাল সহে  না, সহে না  গো॥
           এসো  নিরুদ্ধ  দ্বারে,      বিমুক্ত করো  তারে,
    তনুমনপ্রাণ  ধনজনমান, হে  মহাভিক্ষু, মাগো॥

২৩৭ :: পিনাকেতে লাগে টঙ্কার

               পিনাকেতে  লাগে টঙ্কার—
         বসুন্ধরার  পঞ্জরতলে  কম্পন লাগে  শঙ্কার॥
  আকাশেতে  লাগে ঘুর্ণি      সৃষ্টির  বাঁধ চুর্ণি,
         বজ্রভীষণ  গর্জনরব  প্রলয়ের  জয়ডঙ্কার॥
               স্বর্গ উঠিছে ক্রন্দি,    সুরপরিষদ বন্দী—
           তিমিরগহন  দুঃসহ রাতে  উঠে শৃঙ্খলঝঙ্কার।
         দানবদম্ভ  তর্জি      রুদ্র উঠিল  গর্জি—
            লণ্ডভণ্ড  লুটিল ধুলায়  অভ্রভেদী  অহঙ্কার॥

২৩৮ :: প্রাণে গান নাই মিছে তাই ফিরিনু যে

 প্রাণে  গান    নাই, মিছে  তাই    ফিরিনু যে
             বাঁশিতে  সে গান  খুঁজে।
 প্রেমেরে  বিদায়  ক’রে  দেশান্তরে
             বেলা  যায় কারে  পূজে॥
 বনে  তোর লাগাস  আগুন,  তবে  ফাগুন    কিসের তরে—
             বৃথা  তোর   ভস্ম-’পরে   মরিস  যুঝে॥
       ওরে, তোর    নিবিয়ে দিয়ে     ঘরের বাতি
            কী লাগি     ফিরিস পথে    দিবারাতি—
 যে আলো   শতধারায়    আঁখিতারায়    পড়ে  ঝ’রে
             তাহারে  কে পায়  ওরে   নয়ন বুজে?।

২৩৯ :: যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব’সে রইব কত আর

    যা     হারিয়ে  যায় তা আগলে  ব’সে রইব কত আর?
 আর    পারি নে  রাত জাগতে, হে  নাথ, ভাবেত  অনিবার॥
                আছি রাত্রি দিবস ধ’রে  দুয়ার আমার বন্ধ ক’রে,
                আসতে  যে চায়  সন্দেহে তায়  তাড়াই বারে  বার॥
            তাই তো  কারো হয় না  আসা আমার একা  ঘরে।
            আনন্দময়  ভুবন তোমার  বাইরে খেলা  করে॥
     তুমিও  বুঝি পথ নাহি  পাও, এসে এসে  ফিরিয়া যাও—
     রাখতে  যা চাই রয় না  তাও, ধুলায়  একাকার॥

২৪০ :: আনন্দ তুমি স্বামি মঙ্গল তুমি

              আনন্দ  তুমি স্বামি, মঙ্গল  তুমি,
              তুমি  হে   মহাসুন্দর, জীবননাথ॥
  শোকে  দুখে তোমারি  বাণী    জাগরণ দিবে  আনি,
                     নাশিবে  দারুণ  অবসাদ॥
              চিত  মন অর্পিনু তব  পদপ্রান্তে—
              শুভ্রশান্তিশতদল-পুণ্যমধু-পানে
              চাহি  আছে সেবক, তব  সুদৃষ্টিপাতে
              কবে  হবে এ দুখরাত  প্রভাত॥

২৪১ :: ওরে ভীরু তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার

 ওরে  ভীরু, তোমার  হাতে নাই  ভুবনের ভার।
 হালের  কাছে মাঝি আছে , করবে নদী  পার॥
 তুফান  যদি এসে থাকে  তোমার কিসের  দায়—
 চেয়ে  দেখো ঢেউয়ের  খেলা, কাজ কী  ভাবনায়?
 আসুক-নাকো  গহন রাতি, হোক-না  অন্ধকার—
 হালের  কাছে মাঝি আছে , করবে নদী  পার॥
 পশ্চিমে  তুই তাকিয়ে  দেখিস মেঘে  আকাশ ডোবা,
 আনন্দে  তুই পুবের  দিকে দেখ্‌-না  তারার শোভা।
 সাথি  যারা আছে তারা  তোমার আপন  ব’লে
 ভাবো  কি তাই রক্ষা  পাবে তোমারি  ওই কোলে?
 উঠবে  রে ঝড়, দুলবে  রে বুক, জাগবে  হাহাকার—
 হালের  কাছে মাঝি আছে , করবে তরী  পার॥

২৪২ :: ওই ) আলো যে যায় রে দেখা

  ওই )    আলো যে   যায় রে  দেখা—
          হৃদয়ের   পুব-গগনে   সোনার  রেখা॥
  এবারে    ঘুচল কি  ভয়,   এবারে   হবে কি  জয়?
          আকাশে   হল কি  ক্ষয় কালীর  লেখা?।
                 কারে ওই      যায় গো দেখা,
          হৃদয়ের     সাগরতীরে     দাঁড়ায়  একা।
  ওরে  তুই   সকল ভুলে   চেয়ে  থাক্‌   নয়ন তুলে—
          নীরবে  চরণমূলে   মাথা   ঠেকা॥

২৪৩ :: তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই কতই কী চাই

 তোমার  দ্বারে কেন  আসি ভুলেই যে  যাই,   কতই  কী চাই—
                    দিনের  শেষে ঘরে এসে  লজ্জা যে  পাই॥
   সে-সব  চাওয়া সুখে  দুখে    ভেসে বেড়ায়  কেবল মুখে,
                             গভীর বুকে
       যে  চাওয়াটি গোপন  তাহার কথা যে  নাই॥
                বাসনা  সব বাঁধন যেন  কুঁড়ির গায়ে—
                ফেটে  যাবে, ঝরে  যাবে দখিন-বায়ে।
 একটি  চাওয়া ভিতর  হতে     ফুটবে তোমার  ভোর-আলোতে
                         প্রাণের স্রোতে—
              অন্তরে  সেই গভীর আশা  বয়ে বেড়াই॥

২৪৪ :: তুমি জানো ওগো অন্তর্যামী

  তুমি  জানো, ওগো  অন্তর্যামী,
  পথে  পথেই মন  ফিরালেম  আমি॥
              ভাবনা  আমার বাঁধল  নাকো বাসা,
              কেবল  তাদের  স্রোতের ’পরেই  ভাসা—
              তবু  আমার মনে আছে  আশা,
                  তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী॥
   টেনেছিল  কতই  কান্নাহাসি,
   বারে  বারেই ছিন্ন  হল ফাঁসি।
              শুধায়  সবাই হতভাগ্য  ব’লে,
              ‘মাথা  কোথায় রাখবি  সন্ধ্যা হলে।’
              জানি  জানি নামবে  তোমার কোলে
                 আপনি যেথায় পড়বে মাথা নামি॥

২৪৫ :: তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি ওই গো বাজে হৃদয়মাঝে॥

 তোমার  দুয়ার খোলার  ধ্বনি ওই গো  বাজে   হৃদয়মাঝে॥
 তোমার  ঘরে নিশি-ভোরে   আগল যদি  গেল সরে
            আমার  ঘরে রইব তবে  কিসের লাজে॥
            অনেক  কথা বলেছি, সে  মিথ্যা বলা।
            অনেক  চলা চলেছি, সে  মিথ্যা চলা।
 আজ যেন  সব পথের শেষে     তোমার  দ্বারে দাঁড়াই  এসে—
            ভুলিয়ে  যেন নেয় না  মোরে আপন কাজে॥

২৪৬ :: আমার যে আসে কাছে যে যায় চলে দূরে

         আমার   যে আসে  কাছে, যে যায় চলে দূরে,
         কভু      পাই বা  কভু না পাই যে  বন্ধুরে,
         যেন      এই  কথাটি বাজে  মনের সুরে—
                     তুমি আমার কাছে এসেছ॥
         কভু      মধুর  রসে ভরে  হৃদয়খানি,
         কভু      নিঠুর  বাজে  প্রিয়মুখের  বাণী,
         তবু      নিত্য  যেন এই কথাটি  জানি—
                    তুমি স্নেহের হাসি হেসেছ॥
         ওগো,   কভু  সুখের কভু  দুখের দোলে
         মোর    জীবন  জুড়ে কত তুফান  তোলে,
         যেন    চিত্ত  আমার এই কথা  না ভোলে—
                   তুমি আমায় ভালোবেসেছ।
         যবে    মরণ আসে নিশীথে  গৃহদ্বারে
         যবে    পরিচিতের  কোল হতে সে  কাড়ে,
         যেন    জানি গো  সেই অজানা  পারাবারে
                  এক তরীতে তুমিও ভেসেছ॥

২৪৭ :: হার-মানা হার পরাব তোমার গলে

     হার-মানা  হার পরাব  তোমার গলে—
     দূরে  রব কত আপন  বলের ছলে॥
                জানি আমি জানি ভেসে যাবে অভিমান—
                নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,
                শূন্য হিয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান,
                    পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে॥
     শতদলদল খুলে যাবে থরে  থরে,
     লুকানো রবে না মধু  চিরদিন-তরে।
                আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,
                ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি,
                কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি—
                    পরম মরণ লভিব চরণতলে॥

২৪৮ :: আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে

           আছে দুঃখ,  আছে মৃত্যু, বিরহদহন  লাগে।
           তবুও  শান্তি, তবু  আনন্দ, তবু  অনন্ত জাগে॥
     তবু  প্রাণ  নিত্যধারা,    হাসে  সূর্য চন্দ্র  তারা,
             বসন্ত  নিকুঞ্জে আসে  বিচিত্র  রাগে॥
             তরঙ্গ  মিলায়ে যায় তরঙ্গ  উঠে,
             কুসুম  ঝরিয়া পড়ে  কুসুম ফুটে।
   নাহি  ক্ষয়, নাহি  শেষ,   নাহি  নাহি  দৈন্যলেশ—
             সেই  পূর্ণতার  পায়ে মন স্থান  মাগে॥

২৪৯ :: অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী

 অন্তরে  জাগিছ  অন্তরযামী।
 তবু  সদা দূরে  ভ্রমিতেছি আমি॥
 সংসারসুখ  করেছি বরণ,
 তবু  তুমি মম  জীবনস্বামী॥
 না  জানিয়া পথ  ভ্রমিতেছি  পথে
 আপন  গরবে অসীম  জগতে।
 তবু  স্নেহনেত্র  জাগে  ধ্রুবতারা,
 তব  শুভ আশিস  আসিছে নামি॥

২৫০ :: দীর্ঘ জীবনপথ কত দুঃখতাপ কত শোকদহন

  দীর্ঘ  জীবনপথ, কত দুঃখতাপ,  কত শোকদহন—
        গেয়ে  চলি তবু তাঁর  করুণার গান॥
  খুলে  রেখেছেন  তাঁর    অমৃতভবনদ্বার—
  শ্রান্তি  ঘুচিবে, অশ্রু  মুছিবে, এ  পথের হবে  অবসান॥
  অনন্তের  পানে চাহি    আনন্দের গান  গাহি—
        ক্ষুদ্র  শোকতাপ নাহি  নাহি রে।
  অনন্ত  আলয় যার    কিসের ভাবনা  তার—
        নিমেষের  তুচ্ছ ভারে হব  না রে  ম্রিয়মাণ॥

২৫১ :: আজি কোন্‌ ধন হতে বিশ্বে আমারে

  আজি     কোন্‌  ধন হতে বিশ্বে  আমারে
                            কোন্‌ জনে করে বঞ্চিত,
     তব      চরণ-কমল-রতন-রেণুকা
                            অন্তরে আছে সঞ্চিত॥
     কত      নিঠুর  কঠোর দরশে  ঘরষে  মর্মমাঝারে  শল্য বরষে,
                 তবু  প্রাণ মন  পীযূষপরশে  পলে পলে  পুলকাঞ্চিত॥
   আজি     কিসের  পিপাসা মিটিল  না ওগো
                            পরম পরানবল্লভ!
    চিতে      চিরসুধা করে  সঞ্চার তব
                            সকরুণ করপল্লব।
    নাথ,      যার  যাহা আছে তার  তাই থাক্‌, আমি  থাকি  চিরলাঞ্ছিত—
     শুধু      তুমি এ  জীবনে নয়নে  নয়নে থাকো থাকো  চিরবাঞ্ছিত॥

২৫২ :: কে যায় অমৃতধামযাত্রী

                কে  যায় অমৃতধামযাত্রী !
           আজি এ  গহন  তিমিররাত্রি,
                 কাঁপে  নভ জয়গানে॥
           আনন্দরব  শ্রবণে লাগে,  সুপ্ত  হৃদয় চমকি  জাগে,
                 চাহি  দেখে  পথপানে॥
 ওগো  রহো রহো, মোরে  ডাকি লহো, কহো  আশ্বাসবাণী।
           যাব  অহরহ সাথে  সাথে
                 সুখে  দুখে শোকে  দিবসে রাতে
                          অপরাজিত প্রাণে॥

২৫৩ :: চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে

         চোখের  আলোয়  দেখেছিলেম  চোখের  বাহিরে।
         অন্তরে  আজ দেখব, যখন  আলোক নাহি  রে॥
 ধরায়  যখন দাও না  ধরা   হৃদয় তখন তোমায়  ভরা,
         এখন  তোমার আপন  আলোয় তোমায়  চাহি রে॥
         তোমায়  নিয়ে  খেলেছিলেম  খেলার ঘরেতে।
         খেলার  পুতুল ভেঙে  গেছে প্রলয়  ঝড়েতে।
 থাক্‌  তবে সেই কেবল  খেলা, হোক-না  এখন প্রাণের  মেলা—
         তারের  বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায়  গাহি রে॥

২৫৪ :: এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে

 এবার   নীরব  করে দাও হে  তোমার মুখর  কবিরে।
 তার     হৃদয়বাঁশি  আপনি কেড়ে  বাজাও গভীরে॥
     নিশীথরাতের  নিবিড় সুরে   বাঁশিতে তান  দাও হে পূরে,
           যে তান  দিয়ে অবাক্‌  করো গ্রহশশীরে॥
           যা-কিছু  মোর ছড়িয়ে আছে  জীবন মরণে
           গানের  টানে মিলুক  এসে তোমার চরণে।
           বহুদিনের  বাক্যরাশি এক  নিমেষে যাবে ভাসি—
                একলা  বসে শুনব  বাঁশি অকূল  তিমিরে॥

২৫৫ :: একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা

      একমনে  তোর একতারাতে  একটি যে তার  সেইটি বাজা—
      ফুলবনে  তোর একটি  কুসুম, তাই  নিয়ে তোর ডালি  সাজা॥
      যেখানে  তোর সীমা  সেথায় আনন্দে  তুই থামিস এসে,
      যে কড়ি  তোর প্রভুর  দেওয়া সেই কড়ি  তুই নিস রে হেসে।
      লোকের  কথা নিস নে  কানে, ফিরিস  নে আর হাজার  টানে,
      যেন রে  তোর হৃদয় জানে  হৃদয়ে তোর  আছেন রাজা—
      একতারাতে  একটি যে তার  আপন-মনে সেইটি  বাজা॥

২৫৬ :: গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে আর কোলাহল নাই

        গভীর  রজনী নামিল  হৃদয়ে, আর  কোলাহল নাই।
        রহি  রহি শুধু  সুদূর  সিন্ধুর  ধ্বনি  শুনিবারে পাই॥
   সকল  বাসনা চিত্তে  এল ফিরে,   নিবিড় আঁধার  ঘনালো বাহিরে—
        প্রদীপ  একটি নিভৃত  অন্তরে  জ্বলিতেছে এক  ঠাঁই॥
        অসীম  মঙ্গলে মিলিল  মাধুরী, খেলা  হল সমাধান।
        চপল  চঞ্চল  লহরীলীলা  পারাবারে  অবসান।
   নীরব  মন্ত্রে  হৃদয়মাঝে,  শান্তি  শান্তি  শান্তি বাজে,
        অরূপকান্তি  নিরখি অন্তরে  মুদিতলোচনে  চাই॥

২৫৭ :: ভুবন হইতে ভুবনবাসী এসো আপন হৃদয়ে

         ভুবন  হইতে  ভুবনবাসী এসো  আপন হৃদয়ে।
    হৃদয়মাঝে  হৃদয়নাথ  আছে  নিত্য সাথ  সাথ—
         কোথা  ফিরিছ  দিবারাত,   হেরো  তাঁহারে  অভয়ে॥
    হেথা  চির-আনন্দধাম,  হেথা  বাজিছে অভয়  নাম,
         হেথা  পূরিবে সকল  কাম   নিভৃত অমৃত-আলয়ে॥

২৫৮ :: জীবন যখন ছিল ফুলের মতো

 জীবন  যখন ছিল ফুলের  মতো
 পাপড়ি  তাহার ছিল শত  শত॥
           বসন্তে  সে হত যখন  দাতা
           ঝরিয়ে  দিত দু-চারটি  তার পাতা,
                  তবু যে তার বাকি রইত কত॥
 আজ  বুঝি তার ফল  ধরেছে, তাই
 হাতে  তাহার অধিক  কিছু নাই।
           হেমন্তে  তার সময় হল  এবে
           পূর্ণ  করে আপনাকে সে  দেবে,
                  রসের ভারে তাই সে অবনত॥

২৫৯ :: বাধা দিলে বাধবে লড়াই মরতে হবে

           বাধা  দিলে বাধবে  লড়াই, মরতে  হবে।
           পথ  জুড়ে কি করবি  বড়াই, সরতে  হবে॥
        লুঠ-করা  ধন ক’রে জড়ো  কে হতে  চাস সবার বড়ো—
           এক  নিমেষে পথের  ধুলায় পড়তে  হবে।
           নাড়া  দিতে গিয়ে  তোমায় নড়তে  হবে॥
           নিচে  বসে আছিস কে  রে, কাঁদিস  কেন?
           লজ্জাডোরে  আপনাকে রে  বাঁধিস কেন?
        ধনী যে  তুই দুঃখধনে   সেই  কথাটি রাখিস মনে—
           ধুলার  ’পরে স্বর্গ  তোমায় গড়তে  হবে—
           বিনা  অস্ত্র, বিনা  সহায়, লড়তে  হবে॥

২৬০ :: তুই কেবল থাকিস সরে সরে

          তুই             কেবল  থাকিস সরে সরে,
          তাই            পাস নে  কিছুই হৃদয়  ভরে॥
 আনন্দভাণ্ডারের  থেকে       দূত যে তোরে  গেল ডেকে—
 কোণে  বসে দিস নে  সাড়া,  সব  খোওয়ালি এমনি  করে॥
                       জীবনটাকে  তোল্‌ জাগিয়ে,
                       মাঝে  সবার আয়  আগিয়ে।
 চলিস  নে পথ মেপে  মেপে,   আপনাকে  দে নিখিল  ব্যেপে—
 যে ক’টা  দিন  বাকি আছে  কাটাস নে আর  ঘুমের ঘোরে॥

২৬১ :: দাঁড়াও মন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড-মাঝে আনন্দসভাভবনে আজ॥

 দাঁড়াও,  মন, অনন্ত  ব্রহ্মাণ্ড-মাঝে  আনন্দসভাভবনে  আজ॥
 বিপুলমহিমাময়,  গগনে  মহাসনে   বিরাজ কর   বিশ্বরাজ॥
           সিন্ধু  শৈল তটিনী  মহারণ্য জলধরমালা
      তপন  চন্দ্র তারা  গভীর মন্দে্র  গাহিছে শুন গান।
 এই  বিশ্বমহোৎসব  দেখি মগন হল  সুখে  কবিচিত্ত,
                     ভুলি  গেল সব কাজ॥

২৬২ :: নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি

            নদীপারের  এই আষাঢ়ের  প্রভাতখানি
            নে রে  ও মন, নে রে আপন  প্রাণে  টানি॥
 সবুজ-নীলে  সোনায় মিলে     যে  সুধা এই ছড়িয়ে  দিলে,
            জাগিয়ে  দিলে আকাশতলে  গভীর বাণী,
            নে রে  ও মন, নে রে আপন  প্রাণে  টানি॥
            এমনি  করে চলতে পথে  ভবের কূলে
            দুই  ধারে যা ফুল  ফুটে সব নিস  রে তুলে।
 সে  ফুলগুলি  চেতনাতে   গেঁথে  তুলিস দিবস-রাতে,
            দিনে  দিনে আলোর  মালা ভাগ্য  মানি—
            নে রে  ও মন, নে রে আপন  প্রাণে  টানি॥

২৬৩ :: শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল শান্ত হ রে ওরে দীন

       শান্ত  হ রে মম চিত্ত  নিরাকুল, শান্ত  হ রে ওরে দীন!
       হেরো  চিদম্বরে  মঙ্গলে  সুন্দরে  সর্বচরাচর লীন॥
 শুন রে  নিখিলহৃদয়নিস্যন্দিত   শূন্যতলে  উথলে  জয়সঙ্গীত,
       হেরো  বিশ্ব   চিরপ্রাণতরঙ্গিত  নন্দিত নিত্যনবীন॥
       নাহি  বিনাশ বিকার  বিশোচন, নাহি  দুঃখ সুখ তাপ—
       নির্মল  নিষ্কল  নির্ভয় অক্ষয়,  নাহি জরা জ্বর  পাপ।
 চির  আনন্দ, বিরাম  চিরন্তন,  প্রেম  নিরন্তর, জ্যোতি  নিরঞ্জন—
                      শান্তি  নিরাময়, কান্তি  সুনন্দন,
                                 সান্ত্বন অন্তবিহীন॥

২৬৪ :: শুভ্র নব শঙ্খ তব গগন ভরি বাজে

           শুভ্র  নব শঙ্খ তব  গগন ভরি বাজে,
               ধ্বনিল  শুভ  জাগরণগীত।
           অরুণরুচি  আসনে চরণ তব  রাজে,
               মম  হৃদয়কমল  বিকশিত॥
           গ্রহণ  কর’ তারে  তিমিরপরপারে,
               বিমলতর  পুণ্যকরপরশ-হরষিত॥

২৬৫ :: পূর্বগগনভাগে

                     পূর্বগগনভাগে
                  দীপ্ত হইল সুপ্রভাত
                     তরুণারুণরাগে।
 শুভ্র  শুভ মুহূর্ত  আজি সার্থক  কর’ রে,
                   অমৃতে ভর’ রে—
              অমিতপুণ্যভাগী কে
                  জাগে কে জাগে॥

২৬৬ :: মন জাগ’ মঙ্গললোকে অমল অমৃতময় নব আলোকে

 মন,   জাগ’  মঙ্গললোকে  অমল অমৃতময় নব  আলোকে
                    জ্যোতিবিভাসিত  চোখে॥
 হের’  গগন ভরি জাগে  সুন্দর, জাগে তরঙ্গে  জীবনসাগর—
 নির্মল  প্রাতে   বিশ্বের সাথে  জাগ’ অভয়  অশোকে॥

২৬৭ :: ভোরের বেলা কখন এসে পরশ করে গেছ হেসে॥

  ভোরের  বেলা কখন এসে  পরশ করে  গেছ হেসে॥
  আমার  ঘুমের দুয়ার  ঠেলে   কে সেই খবর  দিল মেলে—
  জেগে  দেখি আমার  আঁখি আঁখির  জলে গেছে  ভেসে॥
  মনে হল  আকাশ যেন কইল  কথা কানে  কানে।
  মনে হল  সকল দেহ পূর্ণ  হল গানে গানে।
  হৃদয়  যেন শিশিরনত  ফুটল  পূজার ফুলের মতো—
  জীবননদী  কূল ছাপিয়ে  ছড়িয়ে গেল  অসীমদেশে॥

২৬৮ :: এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে মেলে না তোর আঁখি

 এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে,  মেলে না তোর আঁখি—
 কাঁটার বনে ফুল ফুটেছে রে   জানিস নে তুই তা কি?
 ওরে অলস,  জানিস নে তুই তা কি?
 জাগো এবার জাগো,   বেলা কাটাস না গো॥
 কঠিন পথের শেষে   কোথায়   অগম বিজন দেশে
 ও সেই  বন্ধু আমার একলা আছে গো,  দিস্‌ নে তারে ফাঁকি॥
 প্রখর রবির তাপে   না হয়   শুষ্ক গগন কাঁপে,
 নাহয়    দগ্ধ বালু তপ্ত আঁচলে  দিক চারি দিক ঢাকি—
 পিপাসাতে    দিক চারি দিক ঢাকি।
 মনের মাঝে চাহি  দেখ্‌ রে   আনন্দ কি নাহি।
 পথে  পায়ে পায়ে দুখের বাঁশরি   বাজবে তোরে ডাকি—
 মধুর সুরে   বাজবে তোরে ডাকি॥

২৬৯ :: আজি নির্ভয়নিদ্রিত ভুবনে জাগে কে জাগে

  আজি   নির্ভয়নিদ্রিত ভুবনে জাগে, কে জাগে?
  ঘন       সৌরভমন্থর পবনে জাগে, কে জাগে?।
  কত      নীরব বিহঙ্গকুলায়ে
              মোহন অঙ্গুলি বুলায়ে— জাগে, কে জাগে?
  কত     অস্ফুট পুষ্পের গোপনে জাগে, কে জাগে?
  এই      অপার অম্বরপাথারে
              স্তম্ভিত গম্ভীর আঁধারে—জাগে, কে জাগে?
  মম       গভীর অন্তরবেদনে জাগে, কে জাগে?।

২৭০ :: ভোর হল বিভাবরী পথ হল অবসান

 ভোর হল বিভাবরী, পথ হল অবসান—
 শুন ওই লোকে লোকে উঠে আলোকেরই গান॥
 ধন্য হলি ওরে পান্থ   রজনীজাগরক্লান্ত,
 ধন্য হল মরি মরি ধুলায় ধূসর প্রাণ॥
 বনের কোলের কাছে  সমীরণ জাগিয়াছে,
 মধুভিক্ষু সারে সারে  আগত কুঞ্জের দ্বারে।
 হল তব যাত্রা সারা,  মোছো মোছো অশ্রুধারা
 লজ্জা ভয় গেল ঝরি, ঘুচিল রে অভিমান॥

২৭১ :: নিশার স্বপন ছুটল রে এই ছুটল রে টুটল বাঁধন টুটল রে॥

   নিশার স্বপন ছুটল রে, এই ছুটল রে,  টুটল বাঁধন টুটল রে॥
   রইল না আর আড়াল প্রাণে,  বেরিয়ে এলেম জগৎ-পানে—
       হৃদয়শতদলের সকল দলগুলি এই ফুটল রে এই ফুটল রে॥
   দুয়ার আমার ভেঙে শেষে  দাঁড়ালে যেই আপনি এসে
       নয়নজলে ভেসে হৃদয় চরণতলে লুটল রে।
   আকাশ হতে প্রভাত-আলো  আমার পানে হাত বাড়ালো,
       ভাঙা কারার দ্বারে আমার জয়ধ্বনি উঠল রে এই উঠল রে॥

২৭২ :: অনেক দিনের শূন্যতা মোর ভরতে হবে

 অনেক দিনের শূন্যতা মোর ভরতে হবে
 মৌনবীণার তন্ত্র আমার জাগাও সুধারবে॥
     বসন্তসমীরে তোমার ফুল-ফুটানো বাণী
               দিক পরানে আনি—
     ডাকো তোমার নিখিল-উৎসবে॥
                 মিলনশতদলে
     তোমার প্রেমের অরূপ মূর্তি দেখাও ভুবনতলে।
     সবার সাথে মিলাও আমায়, ভুলাও অহঙ্কার,
                   খুলাও রুদ্ধদ্বার—
            পূর্ণ করো প্রণতিগৌরবে॥

২৭৩ :: হে চিরনূতন আজি এ দিনের প্রথম গানে

           হে চিরনূতন, আজি এ দিনের প্রথম গানে
           জীবন আমার উঠুক বিকাশি তোমার পানে॥
 তোমার বাণীতে সীমাহীন আশা, চিরদিবসের প্রাণময়ী ভাষা—
       ক্ষয়হীন ধন ভরি দেয় মন তোমার হাতের দানে॥
            এ শুভলগনে জাগুক গগনে অমৃতবায়ু,
            আনুক জীবনে নবজনমের অমল আয়ু।
 জীর্ণ যা-কিছু যাহা-কিছু ক্ষীণ নবীনের মাঝে হোক তা বিলীন—
                          ধুয়ে যাক যত পুরানো মলিন
                                  নব-আলোকের স্নানে॥

২৭৪ :: প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে

  প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে,
           অলস রে, ওরে, জাগো জাগো॥
  শোনো রে চিত্তভবনে অনাদি শঙ্খ বাজিছে—
            অলস রে, ওরে, জাগো জাগো॥

২৭৫ :: জাগো নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে

 জাগো নির্মল নেত্রে  রাত্রির পরপারে,
 জাগো অন্তরক্ষেত্রে  মুক্তির অধিকারে॥
 জাগো ভক্তির তীর্থে  পূজাপুষ্পের ঘ্রাণে,
 জাগো উন্মুখচিত্তে,  জাগো অম্লানপ্রাণে,
 জাগো নন্দননৃত্যে  সুধাসিন্ধুর ধারে,
 জাগো স্বার্থের প্রান্তে  প্রেমমন্দিরদ্বারে॥
 জাগো ঊজ্জ্বল পুণ্যে,  জাগো নিশ্চল আশে,
 জাগো নিঃসীম শূন্যে   পূর্ণের বাহুপাশে।
 জাগো নির্ভয়ধামে,  জাগো সংগ্রামসাজে,
 জাগো ব্রহ্মের নামে,  জাগো কল্যাণকাজে,
 জাগো দুর্গমযাত্রী   দুঃখের অভিসারে,
 জাগো স্বার্থের প্রান্তে  প্রেমমন্দিরদ্বারে॥

২৭৬ :: স্বপন যদি ভাঙিলে রজনীপ্রভাতে

            স্বপন যদি ভাঙিলে রজনীপ্রভাতে
            পূর্ণ করো হিয়া মঙ্গলকিরণে॥
                  রাখো মোরে তব কাজে,
                  নবীন করো এ জীবন হে॥
 খুলি মোর গৃহদ্বার       ডাকো তোমারি ভবনে হে॥

২৭৭ :: বাজাও তুমি কবি তোমার সঙ্গীত সুমধুর

 বাজাও তুমি, কবি, তোমার সঙ্গীত সুমধুর
            গম্ভীরতর তানে প্রাণে মম—
 দ্রব জীবন ঝরিবে ঝর ঝর নির্ঝর তব পায়ে॥
 বিসরিব সব সুখ-দুখ, চিন্তা, অতৃপ্ত বাসনা—
 বিচরিবে বিমুক্ত হৃদয় বিপুল বিশ্ব-মাঝে
               অনুখন আনন্দবায়ে॥

২৭৮ :: মনোমোহন গহন যামিনীশেষে

 মনোমোহন, গহন যামিনীশেষে
          দিলে আমারে জাগায়ে॥
 মেলিদিলে শুভপ্রাতে সুপ্ত এ আঁখি
          শুভ্র আলোক লাগায়ে॥
 মিথ্যা স্বপনরাজি কোথা মিলাইল,
          আঁধার গেল মিলায়ে।
 শান্তিসরসী-মাঝে চিত্তকমল
          ফুটিল আনন্দবায়ে॥

২৭৯ :: পান্থ এখনো কেন অলসিত অঙ্গ

 পান্থ, এখনো কেন অলসিত অঙ্গ—
 হেরো, পুষ্পবনে জাগে বিহঙ্গ॥
 গগন মগন নন্দন-আলোক উল্লাসে,
 লোকে লোকে উঠে প্রাণতরঙ্গ॥
 রুদ্ধ হৃদয়কক্ষে তিমিরে
 কেন আত্মসুখদুঃখে শয়ান—
 জাগো জাগো, চলো মঙ্গলপথে
 যাত্রীদলে মিলি লহো বিশ্বের সঙ্গ॥

২৮০ :: দুঃখরাতে হে নাথ কে ডাকিলে

 দুঃখরাতে, হে নাথ, কে ডাকিলে—
 জাগি হেরিনু তব প্রেমমুখছবি॥
 হেরিনু ঊষালোকে বিশ্ব তব কোলে,
 জাগে তব নয়নে প্রাতে শুভ্র রবি॥
 শুনিনু বনে উপবনে আনন্দগাথা,
 আশা হৃদয়ে বহি নিত্য গাহে কবি॥

২৮১ :: ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে

 ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে
 নিদ্রামগন যবে বিশ্বজগত,
 হৃদয়ে আসিয়ে নীরবে ডাকো হে
         তোমারি অমৃতে॥
 জ্বালো তব দীপ এ অন্তরতিমিরে,
 বার বার ডাকো মম অচেত চিতে॥

২৮২ :: হরষে জাগো আজি জাগো রে তাঁহার সাথে

 হরষে জাগো আজি, জাগো রে তাঁহার সাথে,
          প্রীতিযোগে তাঁর সাথে একাকী॥
 গগনে গগনে হেরো দিব্য নয়নে
      কোন্‌ মহাপুরুষ জাগে মহাযোগাসনে—
            নিখিল কালে জড়ে জীবে জগতে
                  দেহে প্রাণে হৃদয়ে॥

২৮৩ :: বিমল আনন্দে জাগো রে

          বিমল আনন্দে জাগো রে।
          মগন হও সুধাসাগরে॥
 হৃদয়-উদয়াচলে  দেখো রে চাহি
          প্রথম পরম জ্যোতিরাগ রে॥

২৮৪ :: সবে আনন্দ করো

         সবে আনন্দ করো
 প্রিয়তম নাথে লয়ে যতনে হৃদয়ধামে॥
 সঙ্গীতধ্বনি জাগাও জগতে প্রভাতে,
 স্তব্ধ গগন পূর্ণ করো ব্রহ্মনামে॥

২৮৫ :: তুমি আপনি জাগাও মোরে তব সুধাপরশে

 তুমি আপনি জাগাও মোরে তব সুধাপরশে—
 হৃদয়নাথ, তিমিররজনী-অবসানে হেরি তোমারে।
 ধীরে ধীরে বিকাশো হৃদয়গগনে বিমল তব মুখভাতি॥

২৮৬ :: নূতন প্রাণ দাও প্রাণসখা আজি সুপ্রভাতে॥

 নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা, আজি সুপ্রভাতে॥
 বিষাদ সব করো দূর নবীন আনন্দে,
 প্রাচীন রজনী নাশো নূতন ঊষালোকে॥

২৮৭ :: শোনো তাঁর সুধাবাণী শুভমুহূর্তে শান্তপ্রাণে

 শোনো তাঁর সুধাবাণী শুভমুহূর্তে শান্তপ্রাণে—
 ছাড়ো ছাড়ো কোলাহল, ছাড়ো রে আপন কথা॥
 আকাশে দিবানিশি উথলে সঙ্গীতধ্বনি তাঁহার,
                 কে শুনে সে মধুবীণারব—
            অধীর বিশ্ব শূন্যপথে হল বাহির॥

২৮৮ :: নিশিদিন চাহো রে তাঁর পানে

 নিশিদিন চাহো রে তাঁর পানে।
 বিকশিবে প্রাণ তাঁর গুণগানে॥
 হেরো রে অন্তরে সে মুখ সুন্দর,
 ভোলো দুঃখ তাঁর প্রেমমধুপানে॥

২৮৯ :: ওঠো ওঠো রে বিফলে প্রভাত বহে যায় যে

 ওঠো ওঠো রে— বিফলে প্রভাত বহে যায় যে।
 মেলো আঁখি, জাগো জাগো,  থেকো না রে অচেতন॥
 সকলেই তাঁর কাজে   ধাইল জগতমাঝে,
 জাগিল প্রভাতবায়ু,  ভানু ধাইল আকাশপথে॥
 একে একে নাম ধরে ডাকিছেন বুঝি প্রভু—
 একে একে ফুলগুলি তাই  ফুটিয়া উঠিছে বনে।
 শুন সে আহ্বানবাণী,   চাহো সেই মুখপানে—
                তাঁহার আশিস লয়ে
                       চলো রে যাই সবে তাঁর কাজে॥

২৯০ :: ওদের কথায় ধাঁদা লাগে তোমার কথা অমি বুঝি

      ওদের কথায় ধাঁদা লাগে, তোমার কথা অমি বুঝি।
       তোমার আকাশতোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি॥
 হৃদয়কুসুম আপনি ফোটে,  জীবন আমার ভরে ওঠে—
       দুয়ার খুলে চেয়ে দেখি হাতের কাছে সকল পুঁজি॥
       সকাল সাঁজে সুর যে বাজে ভুবন-জোড়া তোমার নাটে,
       আলোর জোয়ার বেয়ে তোমার তরী আসে আমার ঘাটে।
 শুনব কী আর বুঝব কী বা,   এই তো দেখি রাত্রিদিবা
                   ঘরেই তোমার আনাগোনা—
                             পথে কি আর তোমায় খুঁজি॥

২৯১ :: জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে

         জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে।
 আমি           ধুলায় বসে খেলেছি এই
                                 তোমার দ্বারে॥
 অবোধ আমিছিলেম বলে   যেমন খুশি এলেম চলে,
         ভয় করি নি তোমায় আমি অন্ধকারে॥
 তোমার   জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে,
         ’পথ দিয়ে তুই আসিস নি যে, ফিরে যা রে।’
 ফেরারপন্থা বন্ধ করে    আপনি বাঁধো বাহুর ডোরে,
          ওরা আমায় মিথ্যা ডাকে বারে বারে॥

২৯২ :: আমায় ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়

           আমায়  ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়।
 আমার  ভোলার আছে অন্ত, তোমার প্রেমের তো নাই ক্ষয়॥
       দূরে গিয়েবাড়াই যে ঘুর,   সে দূর শুধু আমারি দূর—
             তোমা কাছে দূর কভু দূর নয়॥
       আমার     প্রাণের কুঁড়ি পাপড়ি নাহি খোলে,
       তোমার      বসন্তবায় নাই কি গো তাই বলে!
  এই খেলাতে আমার সনে  হার মানো যে ক্ষণে ক্ষণে—
           হারের মাঝে আছে তোমার জয়॥

২৯৩ :: আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে

    আমার    সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে  ফুল ফুটবে।
    আমার    সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে॥
    আমার    অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া  আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
                  হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে॥
    আমার    লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন,
    যখন       রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন।
    আমার    বন্ধু যখন রাত্রিশেষে  পরশ তারে করবে এসে,
                  ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে॥

২৯৪ :: তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর

 তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
             তুমি  তাই এসেছ নীচে—
 আমায় নইলে,  ত্রিভুবনেশ্বর,
      তোমার  প্রেম হত যে মিছে॥
           আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
           আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
           মোর জীবনে বিচিত্র রূপ ধরে
                  তোমার  ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥
           তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
                  তবু  আমার হৃদয় লাগি
           ফিরছ কত মনোহরণ বেশে,
                  প্রভু,  নিত্য আছ জাগি।
                          তাই তো, প্রভু যেথায় এল নেমে
                          তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে
           মূর্তি তোমার যুগলসম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥

২৯৫ :: তব সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে

 তব     সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে—
 মোর    বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে॥
           একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান;
           তোমার কানে গেল সে সুর, এলে তুমি নেমে—
 মোর    বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে॥
           তোমার সভায় কত যে গান, কতই আছে গুণী—
           গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে!
           লাগল সকল তানের মাঝে একটি করুণ সুর,
           হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে—
 মোর    বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে॥

২৯৬ :: জীবনে যত পূজা হল না সারা

       জীবনে যত পূজা হল না সারা
       জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥
 যে ফুল না ফুটিতে       ঝরেছে ধরণীতে
       যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
       জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥
       জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে
       জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে।
 আমার অনাগত            আমার অনাহত
       তোমার বীণাতারে বাজিছে তারা—
       জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥

২৯৭ :: জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে

 জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে
 ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে—
 সহসা, হে প্রিয়, কত গৃহে পথে
         রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন॥
                  কতবার তুমি মেঘের আড়ালে
                  এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে,
                  অরুণকিরণে চরণ বাড়ালে,
                           ললাটে রাখিলে শুভ পরশন॥
 সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে
 কত কালে কালে কত লোকে লোকে
 কত নব নব আলোকে আলোকে
         অরূপের কত রূপদরশন।
                  কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে
                  ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে
                  কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে
                           অমৃতের কত রসবরষন॥

২৯৮ :: তুমি যে আমারে চাও আমি সে জানি

         তুমি যে আমারে চাও আমি সে জানি।
         কেন যে মোরে কাঁদাও আমি সে জানি॥
 এ আলোকে এ আঁধারে  কেন তুমি আপনারে
         ছায়াখানি দিয়ে ছাও আমি সে জানি॥
 সারাদিন নানা কাজে   কেন তুমি নানা সাজে
         কত সুরে ডাক দাও আমি সে জানি।
 সারা হলে দে’য়া-নে’য়া  দিনান্তের শেষ খেয়া
 কোন্‌ দিক -পানে বাও আমি সে জানি॥

২৯৯ :: জানি হে যবে প্রভাত হবে তোমার কৃপা-তরণী

 জানি হে যবে প্রভাত হবে তোমার কৃপা-তরণী
           লইবে মোরে ভবসাগর-কিনারে।
 করি না ভয়, তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া,
           দাঁড়াব আসি তব অমৃতদুয়ারে  হে প্রভু॥
 জানি হে তুমি যুগে যুগে তোমার বাহু ঘেরিয়া
           রেখেছ মোরে তব অসীম ভুবনে হে—
 জনম মোরে দিয়েছ তুমি আলোক হতে আলোকে,
           জীবন হতে নিয়েছ নব জীবনে  হে প্রভু॥
 জানি হে নাথ, পুণ্যপাপে হৃদয় মোর সতত
           শয়ান আছে তব নয়নসমুখে হে প্রভু।
 আমার হাতে তোমার হাত রয়েছে দিনরজনী,
           সকল পথে-বিপথে সুখে-অসুখে হে প্রভু।
 জানি হে জানি, জীবন মম বিফল কভু হবে না,
           দিবে না ফেলি বিনাশভয়পাথারে হে—
 এমন দিন আসিবে যবে করুণাভরে আপনি
           ফুলের মত তুলিয়া লবে তাহারে  হে প্রভু॥

৩০০ :: নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা

 নিভৃত প্রাণের দেবতা  যেখানে জাগেন একা,
 ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার— আজ লব তাঁর দেখা॥
 সারাদিন শুধু বাহিরে   ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে,
           সন্ধ্যাবেলার আরতি  হয় নি আমার শেখা॥
           তব জীবনের আলোতে  জীবনপ্রদীপ জ্বালি
           হে পূজারি, আজ নিভৃতে  সাজাব আমার থালি।
 যেথা নিখিলের সাধনা  পূজালোক করে রচনা
           সেথায় আমিও ধরিব  একটি জ্যোতির রেখা॥

৩০১ :: ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে জীবনসমর্পণ

          ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে জীবনসমর্পণ—
       ওরে দীন, তুই জোড়কর করি কর্ তাহা দরশন॥
 মিলনের ধারা পড়িতেছে ঝরি,    বহিয়া যেতেছে অমৃতলহরী,
       ভূতলে মাথাটি রাখিয়া লহো রে শুভাশিস্‌-বরিষন॥
       ওই-যে আলোক পড়েছে তাঁহার উদার ললাটদেশে,
       সেথা হতে তারি একটি রশ্মি পড়ুক মাথায় এসে।
 চারি দিকে তাঁর শান্তিসাগর    স্থির হয়ে আছে ভরি চরাচর—
       ক্ষণকাল-তরে দাঁড়াও রে তীরে, শান্ত করো রে মন॥

৩০২ :: এসেছে সকলে কত আশে দেখো চেয়ে

 এসেছে সকলে কত আশে দেখো চেয়ে—
 হে প্রাণেশ, ডাকে সবে ওই তোমারে॥
 এসো হে মাঝে এসো, কাছে এসো,
         তোমায় ঘিরিব চারি ধারে॥
 উৎসবে মাতিব হে তোমায় লয়ে,
         ডুবিব আনন্দ-পারাবারে॥

৩০৩ :: ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে

        ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে,
        দিকে দিগন্তরে ভুবনমন্দিরে শান্তিসঙ্গীত বাজে॥
 হেরো গো অন্তরে অরূপসুন্দরে,  নিখিল সংসারে পরমবন্ধুরে,
           এসো আনন্দিত মিলন-অঙ্গনে শোভন মঙ্গল সাজে॥
 কলুষ কল্মষ বিরোধ বিদ্বেষ   হউক নির্মল, হউক নিঃশেষ—
           চিত্তে হোক যত বিঘ্ন অপগত নিত্য কল্যাণকাজে।
 স্বর তরঙ্গিয়া গাও বিহঙ্গম,   পূর্বপশ্চিমবন্ধুসঙ্গম—
           মৈত্রিবন্ধনপুণ্যমন্ত্র-পবিত্র বিশ্বসমাজে॥

৩০৪ :: কী গাব আমি কী শুনাব আজি আনন্দধামে

 কী গাব আমি, কী শুনাব, আজি আনন্দধামে।
         পুরবাসী জনে এনেছি ডেকে তোমার অমৃতনামে॥
 কেমনে বর্ণিব তোমার রচনা,  কেমনে রটিব তোমার করুণা,
         কেমনে গলাব হৃদয় প্রাণ তোমার মধুর প্রেমে॥
         তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে—
         রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে।
 অসীম আকাশে নীলশতদল  তোমার কিরণে সদা ঢলঢল,
         তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে॥

৩০৫ :: সফল করো হে প্রভু আজি সভা এ রজনী হোক মহোৎসবা॥

 সফল করো হে প্রভু আজি সভা,   এ রজনী হোক মহোৎসবা॥
          বাহির অন্তর ভুবনচরাচর   মঙ্গলডোরে বাঁধি এক করো—
          শুষ্ক হৃদয় করো প্রেমে সরসতর, শূন্য নয়নে আনো পুণ্যপ্রভা॥
 অভয়দ্বার তব করো হে অবারিত,  অমৃত-উৎস তব করো উৎসারিত,
          গগনে গগনে করো প্রসারিত  অতিবিচিত্র তব নিত্যশোভা।
 সব ভকতে তব আনো এ পরিষদে,  বিমুখ চিত্ত যত করো নত তব পদে,
          রাজ-অধীশ্বর, তব চিরসম্পদে   সব সম্পদ করো হতগরবা॥

৩০৬ :: হৃদিমন্দিরদ্বারে বাজে সুমঙ্গল শঙ্খ॥

 হৃদিমন্দিরদ্বারে বাজে সুমঙ্গল শঙ্খ॥
 শত মঙ্গলশিখা করে ভবন আলো,
              উঠে নির্মল ফুলগন্ধ॥

৩০৭ :: ওই পোহাইল তিমিররাতি

 ওই পোহাইল তিমিররাতি।
 পূর্বগগনে দেখা দিল নব প্রভাতছটা,
 জীবনে-যৌবনে হৃদয়ে-বাহিরে
 প্রকাশিল অতি অপরূপ মধুর ভাতি॥
 কে পাঠালে এ শুভদিন নিদ্রা-মাঝে,
 মহা মহোল্লাসে জাগাইলে চরাচর,
 সুমঙ্গল আশীর্বাদ বরষিলে
 করি প্রচার সুখবারতা—
 তুমি চির সাথের সাথি॥

৩০৮ :: আজি বহিছে বসন্তপবন সুমন্দ তোমারি সুগন্ধ হে

   আজি বহিছে বসন্তপবন সুমন্দ তোমারি সুগন্ধ হে।
   কত আকুল প্রাণ আজি গাহিছে গান, চাহে তোমারি পানে আনন্দে হে॥
   জ্বলে তোমার আলোক দ্যুলোকভূলোকে গগন-উৎসবপ্রাঙ্গণে—
   চিরজ্যোতি পাইছে চন্দ্র তারা, আঁখি পাইছে অন্ধ হে॥
   তব মধুরমুখভাতিবিহসিত প্রেমবিকশিত অন্তরে—
   কত ভকত ডাকিছে, ‘নাথ, যাচি দিবসরজনী তব সঙ্গ হে।’
   উঠে সজনে প্রান্তরে লোকলোকান্তরে যশোগাথা কত ছন্দে হে—
   ওই ভবশরণ, প্রভু, অভয় পদ তব সুর মানব মুনি বন্দে হে॥

৩০৯ :: আনন্দগান উঠুক তবে বাজি

 আনন্দগান উঠুক তবে বাজি
          এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।
 অশ্রুজলের ঢেউয়ের ’পরে আজি
          পারের তরী থাকুক ভাসিতে॥
 যাবার হাওয়া ওই-যে উঠেছে, ওগো, ওই-যে উঠেছে,
 সারারত্রি চক্ষে আমার ঘুম যে ছুটেছে।
 হৃদয় আমার উঠছে দুলে দুলে
          অকূল জলের অট্টহাসিতে—
 কে গো তুমি দাও দেখি তান তুলে
          এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে॥
 হে অজানা, অজানা সুর নব
          বাজাও আমার ব্যথার বাঁশিতে,
 হঠাৎ এবার উজান হাওয়ায় তব
          পারের তরী থাক্‌-না ভাসিতে।
 কোনো কালে হয় নি যারে দেখা, ওগো, তারি বিরহে
 এমন করে ডাক দিয়েছে— ঘরে কে রহে!
 বাসার আশা গিয়েছে মোর ঘুরে,
          ঝাঁপ দিয়েছি আকাশরাশিতে।
 পাগল, তোমার সৃষ্টিছাড়া সুরে
          তান দিয়ো মোর ব্যথার বাঁশিতে॥

৩১০ :: এ দিন আজি কোন্‌ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার

        এ দিন আজি কোন্‌ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার?
        আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার?।
 কাহার অভিষেকের তরে  সোনার ঘটে আলোক ভরে,
        ঊষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার?।
        বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা—
        কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা?
        বহু যুগের উপহারে   বরণ করি নিল কারে,
        কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার।

৩১১ :: ওই অমল হাতে রজনী প্রাতে আপনি জ্বালো

  ওই  অমল হাতে  রজনী প্রাতে  আপনি জ্বালো
             এই তো আলো—  এই তো আলো॥
  এই তো প্রভাত, এই তো আকাশ,   এই তো পূজার পুষ্পবিকাশ,
             এই তো বিমল, এই তো মধুর,   এই তো ভালো—
                  এই তো আলো— এই তো আলো॥
             আঁধার মেঘের বক্ষে জেগে আপনি জ্বালো
                  এই তো আলো— এই তো আলো।
             এই তো ঝঞ্ঝা তড়িৎ-জ্বালা,  এই তো দুখের অগ্নিমালা,
             এই তো মুক্তি, এই তো দীপ্তি,  এই তো ভালো—
                  এই তো আলো— এই তো আলো॥

৩১২ :: তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ

 তার    অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ।
 তার    অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,
                 ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
 তারে   মোহনমন্ত্র দিয়ে গেছে কত ফুলের গন্ধ
 তারে   দোলা দিয়ে দুলিয়ে গেছে কত ঢেউয়ের ছন্দ,
                 ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
 আছে   কত সুরের সোহাগ যে তার স্তরে স্তরে লগ্ন,
 সে যে  কত রঙের রসধারায় কতই হল মগ্ন,
                 ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
 কত    শুকতারা যে স্বপ্নে তাহার রেখে গেছে স্পর্শ,
 কত    বসন্ত যে ঢেলেছে তায় অকারণের হর্ষ,
                 ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
 সে যে  প্রাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য—
 ভুবন   কত তীর্থজলের ধারায় করেছে তায় ধন্য,
                 ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
 সে যে  সঙ্গিনী মোর, আমারে সে দিয়েছে বরমাল্য।
 আমি    ধন্য, সে মোর অঙ্গনে যে কত প্রদীপ জ্বালল—
                 ও তার  অন্ত নাই গো নাই॥
   

৩১৩ :: তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে এল এল এল গো ওগো পুরবাসী

   তোমার     আনন্দ ওই এল দ্বারে এল এল এল গো।  ওগো পুরবাসী!
   বুকের      আঁচলখানি ধুলায় পেতে আঙিনাতে মেলো গো॥
   পথে        সেচন কোরো গন্ধবারি  মলিন না হয় চরণ তারি,
   তোমার     সুন্দর ওই এল দ্বারে এল এল এল গো।
   আকুল    হৃদয়খানি সম্মুখে তার ছড়িয়ে ফেলো ফেলো গো॥
   তোমার     সকল ধন যে ধন্য হল হল গো।
                  বিশ্বজনের কল্যাণে আজ ঘরের দুয়ার খোলো গো।
   হেরো        রাঙা হল সকল গগন,   চিত্ত হল পুলকমগন,
   তোমার     নিত্য আলো এল দ্বারে এল এল এল গো।
   তোমার     পরানপ্রদীপ তুলে ধোরো, ওই আলোতে জ্বেলো গো॥

৩১৪ :: প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে

               প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।
               ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে॥
 দুঃখকে আজ কঠিন বলে   জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে
               উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে॥
 হেথায় কারো ঠাঁই হবে না    মনে ছিল এই ভাবনা,
               দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।
 যতন করে আপনাকে যে    রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,
               আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে॥

৩১৫ :: পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে

        পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে
        এই    খসে যাবার, ভেসে যাবার, ভাঙবারই আনন্দে রে॥
 পাতিয়া কান শুনিস না যে      দিকে দিকে গগনমাঝে
        মরণবীণায় কী সুর বাজে তপন-তারা-চন্দ্রে রে—
        জ্বালিয়ে আগুন ধেয়ে ধেয়ে জ্বলবারই আনন্দে রে॥
 পাগল-করা গানের তানে    ধায় যে কোথা কেই বা জানে,
        চায় না ফিরে পিছন-পানে, রয় সে বাঁধা বন্ধে রে—
        লুটে যাবার, ছুটে যাবার, চলবারই আনন্দে রে।
 সেই আনদ-চরণ-পাতে       ছয় ঋতু যে নৃত্যে মাতে,
        প্লাবন বহে যায় ধরাতে বরণ-গীতে গন্ধে রে—
        ফেলে দেবার, ছেড়ে দেবার, মরবারই আনন্দে রে॥

৩১৬ :: প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে

 প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
 প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোকে ভূলোকে
                তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া॥
 দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ
 মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ,
                জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া॥
 চেতনা আমার কল্যাণরসসরসে
 শতদলসম ফুটিল পরম হরষে
                সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া।
 নীরব আলোকে জাগিল হৃদয়প্রান্তে
 উদার উষার উদয়-অরুণকান্তি,
                অলস আঁখির আবরণ গেল সরিয়া॥

৩১৭ :: জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

          জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
          ধন্য হল, ধন্য হল মানবজীবন॥
 নয়ন আমার রূপের পুরে      সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
          শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন॥
          তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি—
          গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্না হাসি।
 এখন সময় হয়েছে কি?   সভায় গিয়ে তোমায় দেখি’
          জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন॥

৩১৮ :: গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর

           গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর—
           হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর?।
     আজিকে এই আকাশতলে  জলে স্থলে ফুলে ফলে
           কেমন ক’রে, মনোহরণ, ছড়ালে মন মোর?।
           কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে!
           পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে।
     আনন্দ আজ কিসের ছলে  কাঁদিতে চায় নয়নজলে,
           বিরহ আজ মধুর হয়ে করেছে প্রাণ ভোর॥

৩১৯ :: আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো

         আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
         আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো॥
    সকল আকাশ সকল ধরা  আনন্দে হাসিতে ভরা,
         যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো॥
         তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
         তোমার আলো পখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।
    তোমার আলো ভালোবেসে  পড়েছে মোর গায়ে এসে,
         হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো॥

৩২০ :: আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে আহা॥

 আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে, আহা॥
       মন্দ পবেনে আজি ভাসে আকাশে
       বিধুর ব্যাকুল মধুমাধুরী, আহা॥
       স্তব্ধ গগনে গ্রহতারা নীরবে
       কিরণসঙ্গীতে সুধা বরষে, আহা।
 প্রাণ মন মম ধীরে ধীরে প্রসাদরসে আসে ভরি,
       দেহ পুলকিত উদার হরষে, আহা॥
   

৩২১ :: বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে

 বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে—
 অমলকমল-মাঝে, জ্যোৎস্নারজনী-মাঝে,
 কাজলঘন-মাঝে, নিশি-আঁধার-মাঝে,
 কুসুমসুরভি-মাঝে বীনরণন শুনি যে—
               প্রেমে প্রেমে বাজে॥
 নাচে নাচে রম্যতালে নাচে—
 তপন তারা নাচে, নদী সমুদ্র নাচে,
 জন্মমরণ নাচে, যুগযুগান্ত নাচে,
 ভকতহৃদয় নাচে বিশ্বছন্দে মাতিয়ে—
               প্রেমে প্রেমে নাচে॥
 সাজে সাজে রম্যবেশে সাজে—
 নীল অম্বর সাজে, ঊষাসন্ধ্যা সাজে,
 ধরণীধূলি সাজে, দীনদুঃখী সাজে,
 প্রণত চিত্ত সাজে বিশ্বশোভায় লুটায়ে—
               প্রেমে প্রেমে সাজে॥

৩২২ :: বিপুল তরঙ্গ রে বিপুল তরঙ্গ রে

               বিপুল  তরঙ্গ রে,  বিপুল তরঙ্গ রে।
 সব গগন উদ্‌বেলিয়া, মগন করি অতীত অনাগত
 আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল  একি আনন্দ-তরঙ্গ॥
               তাই, দুলিছে দিনকর চন্দ্র তারা,
               চমকি কম্পিছে চেতনাধারা,
 আকুল চঞ্চল নাচে সংসার,  কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ॥

৩২৩ :: সদা থাকো আনন্দে সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে॥

 সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে॥
 জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে,
 সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দগানে॥
 সঙ্কটে সম্পদে থাকো কল্যাণে,
 থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে।
 সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে,
 চির-অমৃতনির্ঝরে শান্তিরসপানে॥

৩২৪ :: বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা॥

 বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা॥
 বাজে অসীম নভমাঝে অনাদি রব,
 জাগে অগণ্য রবিচন্দ্রতারা॥
 একক অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডরাজ্যে
 পরম-এক সেই রাজরাজেন্দ্র রাজে।
 বিস্মিত নিমেষহত   বিশ্ব চরণে বিনত,
 লক্ষশত ভক্তচিত বাক্যহারা॥
   

৩২৫ :: অমল কমল সহজে জলের কোলে আনন্দে রহে ফুটিয়া

 অমল কমল সহজে জলের কোলে আনন্দে রহে ফুটিয়া,
 ফিরে না সে কভু ‘আলয় কোথায়’ বলে ধুলায় ধুলায় লুটিয়া॥
           তেমনি সহজে আনন্দে হরষিত
           তোমার মাঝারে রব নিমগ্নচিত,
 পূজাশতদল আপনি সে বিকশিত সব সংশয় টুটিয়া॥
 কোথা আছ তুমি পথ না খুঁজিব কভু,  শুধাব না কোনো পথিকে—
 তোমারি মাঝারে ভ্রমিব ফিরিব প্রভু,   যখন ফিরিব যে দিকে।
           চলিব যখন তোমার আকাশগেহে
           তোমার অমৃতপ্রবাহ লাগিবে দেহে,
 তোমার পবন সখার মতন স্নেহে   বক্ষে আসিবে ছুটিয়া॥

৩২৬ :: আনন্দধারা বহিছে ভুবনে

              আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
 দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে॥
              পান করে রবি শশী অঞ্জলি ভরিয়া—
              সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি—
              নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে॥
              বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
              স্বার্থনিমগন কী কারণে?
              চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,
              ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
              প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে॥

৩২৭ :: নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে

 নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে
 শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে॥
 উৎসারিত নব জীবননির্ঝর, উচ্ছ্বাসিত আশাগীতি,
 অমৃতপুষ্পগন্ধ বহে আজি এই শান্তিপবনে॥

৩২৮ :: হেরি তব বিমলমুখভাতি দূর হল গহন দুখরাতি

     হেরি তব বিমলমুখভাতি  দূর হল গহন দুখরাতি।
     ফুটিল মন প্রাণ মম তব চরণলালসে,  দিনু হৃদয়কমলদল পাতি॥
     তব নয়নজ্যোতিকণা লাগি  তরুণ রবিকিরণ উঠে জাগি।
     নয়ন খুলি বিশ্বজন বদন তুলি চাহিল  তব দরশপরশসুখ মাগি।
               গগনতল মগন হল শুভ্র তব হাসিতে,
     উঠিল ফুটি কত কুসুমপাঁতি—  হেরি তব বিমলমুখভাতি॥
     ধ্বনিত বন বিহগকলতানে,  গীত সব ধায় তব পানে।
     পূর্বগগনে জগত জাগি উঠি গাহিল,  পূর্ণ সব তব রচিত গানে।
               প্রেমরস পান করি গান করি কাননে
     উঠিল মন প্রাণ মম মাতি—হেরি তব বিমলমুখভাতি॥

৩২৯ :: এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়

 এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়,
 জগতপুরবাসী সবে কোথায় ধায়॥
 কোন্‌ অমৃতধনের পেয়েছে সন্ধান,
        কোন্‌ সুধা করে পান!
 কোন্‌ আলোকে আঁধার দূরে যায়॥

৩৩০ :: আঁধার রজনী পোহালো জগত পূরিল পুলকে

      আঁধার রজনী পোহালো,    জগত পূরিল পুলকে।
      বিমল প্রভাতকিরণে        মিলিল দ্যুলোকে ভূলোকে॥
      জগত নয়ন তুলিয়া         হৃদয় দুয়ার খুলিয়া
      হেরিছে হৃদয়নাথেরে       আপন হৃদয়-আলোকে॥
      প্রেমমুখহাসি তাঁহারি       পড়িছে ধরার আননে—
      কুসুম বিকশি উঠিছে,      সমীর বহিছে কাননে।
      সুধীরে আঁধার টুটিছে,     দশ দিক ফুটে উঠিছে—
      জননীর কোলে যেন রে     জাগিছে বালিকা বালকে॥
      জগত যে দিকে চাহিছে    সে দিকে দেখিনু চাহিয়া,
      হেরি সে অসীম মাধুরী     হৃদয় উঠিছে গাহিয়া।
      নবীন আলোকে ভাতিছে,   নবীন আশায় মাতিছে,
      নবীন জীবন লভিয়া        জয়-জয় উঠে ত্রিলোকে॥

৩৩১ :: হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল আজি মম পূর্ণ হল শুন সবে জগতজনে॥

 হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল আজি মম পূর্ণ হল,  শুন সবে জগতজনে॥
            কী হেরিনু শোভা, নিখিলভুবননাথ
                চিত্ত-মাঝে বসি স্থির আসনে॥

৩৩২ :: ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে

             ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে,
             নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে॥
 কী হল না, কী পেলে না,  কে তব শোধে নি দেনা,
             সে সকলি মরীচিকা মিলাইবে পিছে॥
             এই-যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি
             অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি—
 এই তো পরম দান    সফল করিল প্রাণ,
                সত্যের আনন্দরূপ
                       এই তো জাগিছে॥

৩৩৩ :: আমি সংসারে মন দিয়েছিনু তুমি আপনি সে মন নিয়েছ

 আমি   সংসারে মন দিয়েছিনু, তুমি আপনি সে মন নিয়েছ।
 আমি   সুখ ব’লে দুখ চেয়েছিনু, তুমি দুখ ব’লে সুখ দিয়েছ॥
            হৃদয় যাহার শতখানে ছিল শত স্বার্থের সাধনে
            তাহারে কেমনে কুড়ায়ে আনিলে, বাঁধিলে ভক্তিবাঁধনে॥
            সুখ সুখ করে দ্বারে দ্বারে মোরে কত দিকে কত খোঁজালে,
            তুমি যে আমার কত আপনার এবার সে কথা বোঝালে—
            করুণা তোমার কোন্‌ পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায় কাহারে—
                      সহসা দেখিনু নয়ন মেলিয়ে,
                                এনেছ তোমারি দুয়ারে॥

৩৩৪ :: আজিকে এই সকালবেলাতে

              আজিকে এই সকালবেলাতে
       বসে আছি আমার প্রাণের সুরটি মেলাতে॥
 আকাশে ওই অরুণ রাগে  মধুর তান করুণ লাগে,
       বাতাস মাতে আলোছায়ার মায়ার খেলাতে॥
       নীলিমা এই নিলীন হল আমার চেতনায়।
       সোনার আভা জড়িয়ে গেল মনের কামনায়।
 লোকান্তরের ও পার হতে  কে উদাসী বায়ুর স্রোতে
       ভেসে বেড়ায় দিগন্তে ওই মেঘের ভেলাতে॥

৩৩৫ :: যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে

             যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে
             মিলাব তাই জীবনগানে॥
    গগনে তব বিমল নীল—হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
             শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে॥
             বাজায় ঊষা নিশীথকূলে যে গীতভাষা
             সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা।
    ফুলের মতো সহজ সুরে  প্রভাত মোর উঠিবে পূরে,
             সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে॥

৩৩৬ :: ওরে তোরা যারা শুনবি না

                      ওরে,  তোরা যারা শুনবি না
         তোদের তরে আকাশ-’পরে নিত্য বাজে কোন্‌ বীণা॥
 দূরের শঙ্খ উঠল বেজে,  পথে বাহির হল সে যে,
         দুয়ারে তোর আসবে কবে তার লাগি দিন গুনবি না?।
         রাতগুলো যায় হায় রে বৃথায়, দিনগুলো যায় ভেসে—
         মনে আশা রাখবি না কি মিলন হবে শেষে?
 হয়তো দিনের দেরি আছে,  হয়তো সে দিন আস্‌ল কাছে—
         মিলনরাতে ফুটবে যে ফুল তার কি রে বীজ বুনবি না?।

৩৩৭ :: মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে

 মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
 আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে॥
 তুমি আছ, বিশ্বনাথ, অসীম রহস্যমাঝে
 নীরবে একাকী আপন মহিমানিলয়ে॥
 অনন্ত এ দেশকালে, অগণ্য এ দীপ্ত লোকে,
 তুমি আছ মোরে চাহি—আমি চাহি তোমা-পানে।
 স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর—
 এক তুমি, তোমা-মাঝে আমি একা নির্ভয়ে॥

৩৩৮ :: আছ আপন মহিমা লয়ে মোর গগনে রবি

          আছ আপন মহিমা লয়ে মোর গগনে রবি,
          আঁকিছ মোর মেঘের পটে তব রঙেরই ছবি॥
 তাপস, তুমি ধেয়ানে তব  কী দেখ মোরে কেমনে কব—
          তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী॥
          তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা।
          নিজেরে তুমি ভোলাবে ব’লে আমারে নিয়ে খেলা।
 কণ্ঠে মম কী কথা শোন  অর্থ আমি বুঝি না কোনো—
          বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী॥

৩৩৯ :: আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে

   আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
            আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥
   দেহমনের সুদূর পারে  হারিয়ে ফেলি আপনারে,
            গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধে ভাসে॥
            আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
            দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।
   বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা,  আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা—
            জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে॥

৩৪০ :: আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা-আপন সে কি

 আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা-আপন সে কি,
             অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি॥
 যবে দুর্দম ঝড়ে   আগল খুলে পড়ে,
             কার সে নয়ন-’পরে  নয়ন যায় গো ঠেকি॥
 যখন আসে পরম লগন তখন গগন-মাঝে
             তাহার ভেরী বাজে।
 বিদ্যুত-উদ্ভাসে  বেদনারই দূত আসে,
             আমন্ত্রণের বাণী  যায় হৃদয়ে লেখি॥

৩৪১ :: আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে

               আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে!
       মম   পল্লবে পল্লবে  হিল্লোলে হিল্লোলে
                   থরথর কম্পন লাগিল রে॥
       কোন্‌ ভিখারি হায় রে   এল  আমারি এ অঙ্গনদ্বারে,
                 বুঝি  সব মন ধন মম মাগিল রে॥
                 হৃদয় বুঝি তারে জানে,
                 কুসুম ফোটায় তারি গানে।
     আজি মম অন্তরমাঝে       সেই  পথিকেরই পদধ্বনি বাজে,
              তাই  চকিতে চকিতে ঘুম ভাঙিল রে॥

৩৪২ :: প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই

            প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই
            নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হল সেই॥
 নীল অতলের কোথা থেকে  উদাস তারে করল যে কে
            গোপনবাসী সেই উদাসীর ঠিক-ঠিকানা নেই॥
            ‘সুপ্তিশয়ন আয় ছেড়ে আয়’ জাগে রে তার ভাষা,
            সে বলে ‘চল্‌ আছে যেথায় সাগরপারের বাসা’।
 দেশ-বিদেশের সকল ধারা   সেইখানে হয় বাঁধনহারা,
            কোণের প্রদীপ মিলায় শিখা জ্যোতিসমুদ্রেই॥

৩৪৩ :: তোমার হাতের রাখীখানি বাঁধো আমার দখিন-হাতে

        তোমার হাতের রাখীখানি বাঁধো আমার দখিন-হাতে
        সূর্য যেমন ধরার করে আলোক-রাখী জড়ায় প্রাতে॥
  তোমার আশিস আমার কাজে     সফল হবে বিশ্ব-মাঝে,
        জ্বলবে তোমার দীপ্ত শিখা আমার সকল বেদনাতে॥
        কর্ম করি যে হাত লয়ে কর্মবাঁধন তারে বাঁধে।
        ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে।
  তোমার রাখী বাঁধো আঁটি—সকল বাঁধন যাবে কাটি,
        কর্ম তখন বীণার মতো বাজবে মধুর মূর্ছনাতে॥

৩৪৪ :: বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে কাজ নাই

         বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে  কাজ নাই,
         ভালো আমার লেগেছে যে রইল সেই কথাই॥
 ভোরের আলোয় নয়ন ভ’রে  নিত্যকে পাই নূতন করে,
                   কাহার মুখে চাই॥
         প্রতিদিনের কাজের পথে করতে আনাগোনা
         কানে আমার লেগেছে গান, করেছে আন্‌মনা।
         হৃদয়ে মোর কখন জানি  পড়ল পায়ের চিহ্নখানি
                   চেয়ে দেখি তাই॥

৩৪৫ :: ফেলে রাখলেই কি পড়ে রবে ও অবোধ

   ফেলে       রাখলেই কি পড়ে রবে  ও অবোধ।
   যে তার     দাম জানে সে কুড়িয়ে লবে  ও অবোধ॥
   ও যে        কোন্‌ রতন তা দেখ্‌-না ভাবি,  ওর ’পরে কি ধুলোর দাবি?
   ও             হারিয়ে গেলে তারি গলার হার গাঁথা যে ব্যর্থ হবে॥
   ওর           খোঁজ পড়েছে জানিস নে তা?
   তাই           দূত বেরোল হেথা সেথা।
   যারে          করলি হেলা সবাই মিলি  আদর যে তার বাড়িয়ে দিলি—
   যারে          দরদ দিলি তার ব্যথা কি সেই দরদীর প্রাণে সবে?।

৩৪৬ :: দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে-দেওয়া তোমায় আমায়

                 দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে-দেওয়া তোমায় আমায়—
                 জনম জনম এই চলেছে, মরণ কভু তারে থামায়?।
   যখন       তোমার গানে আমি জাগি  আকাশে চাই তোমার লাগি,
   আবার    একতারাতে আমার গানে মাটির পানে তোমায় নামায়॥
   ওগো,       তোমার সোনার আলোর ধারা, তার ধারি ধার—
   আমার    কালো মাটির ফুল ফুটিয়ে শোধ করি তার।
   আমার    শরৎরাতের শেফালিবন  সৌরভেতে মাতে যখন
   তখন      পালটা সে গান লাগে তব শ্রাবণ-রাতের প্রেম-বরিষায়॥

৩৪৭ :: অরূপবীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে

         অরূপবীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
         সে বীণা আজি উঠিল বাজি’ হৃদয়মাঝে॥
 ভুবন আমার ভরিল সুরে,    ভেদ ঘুচে যায় নিকটে দূরে,
         সেই রাগিণী লেগেছে আমার সকল কাজে॥
         হাতে-পাওয়ার চোখে-চাওয়ার সকল বাঁধন
         গেল কেটে আজ, সফল হল সকল কাঁদন।
 সুরের রসে হারিয়ে যাওয়া    সেই তো দেখা, সেই তো পাওয়া—
         বিরহ মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে॥

৩৪৮ :: আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি

 আমি      জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি,
 আমি      শুনব বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী॥
 আমার    এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথরাতে,
 আমার    লুকিয়ে-ফোটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে
               থাক্‌-না ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি॥
 আমার    সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে
               যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে।
 আমার    সকল দিনের পথ খোঁজা এই হল সারা,
 এখন      দিক্‌-বিদিকের শেষে এসে দিশাহারা
               কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি॥

৩৪৯ :: আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই তখন যাহা পাই

 আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই  তখন যাহা পাই
                   সে যে আমি হারাই বারে বারে॥
 তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে
 বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে গোপন রতনভার,
 হারায় না সে আর॥
 প্রভাত আসে তাঁহার কাছে আলোক ভিক্ষা নিতে,
 সে আলো তার লুটায় ধরণীতে।
 তিনি যখন সন্ধ্যা-কাছে দাঁড়ান ঊধর্বকরে  তখন স্তরে স্তরে
 ফুটে ওঠে অন্ধকারের আপন প্রাণের ধন,
 মুকুটে তাঁর পরেন সে রতন॥

৩৫০ :: আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে তোমারি নাম সকল তারার মাঝে॥

  আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে  তোমারি নাম সকল তারার মাঝে॥
  সে নামখানি নেমে এল ভুঁয়ে,   কখন আমার ললাট দিল ছুঁয়ে,
  শান্তিধারায় বেদন গেল ধুয়ে—   আপন আমার আপনি মরে লাজে॥
  মন মিলে যায় আজ ওই নীরব রাতে  তারায়-ভরা ওই গগনের সাথে।
  অমনি করে আমার এ হৃদয়  তোমার নামে হোক-না নামময়,
  আঁধারে মোর তোমার আলোর জয়  গভীর হয়ে থাক্‌ জীবনের কাজে॥

৩৫১ :: অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক

     অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
              তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
     বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক্‌,
              ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি।
              ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে,
              ‘আঁধারে পথ চিনবে কেমন ক’রে?’
     আমি কইনু, ‘চলব আমি নিজের আলো ধরে,
              হাতে আমার এই-যে আছে বাতি।’
     বাতি যতই উচ্চ শিখায় জ্বলে আপন তেজে
              চোখে ততই লাগে আলোর বাধা,
     ছায়ায় মিশে চারি দিকে মায়া ছড়ায় সে-যে—
              আধেক দেখা করে আমায় আঁধা।
              গর্বভরে যতই চলি বেগে
              আকাশ তত ঢাকে ধুলার মেঘে,
     শিখা আমার কেঁপে ওঠে অধীর হাওয়া লেগে,
              পায়ে পায়ে সৃজন করে ধাঁদা॥
     হঠাৎ শিরে লাগল আঘাত বনের শাখাজালে,
              হঠাৎ হাতে নিবল আমার বাতি।
     চেয়ে দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন্‌ কালে—
              চেয়ে দেখি, তিমিরগহন রাতি।
              কেঁদে বলি মাথা করে নিচু,
              ‘শক্তি আমার রইল না আর কিছু!’
     সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি, কখন পিছু পিছু
              এসেছে মোর চিরপথের সাথি॥

৩৫২ :: ভুবনজোড়া আসনখানি

                           ভুবনজোড়া আসনখানি
              আমার   হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি॥
              রাতের তারা, দিনের রবি,  আঁধার-আলোর সকল ছবি,
 তোমার   আকাশ-ভরা সকল বাণী—
                             আমার    হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি॥
                             ভুবনবীণার সকল সুরে
              আমার   হৃদয় পরান দাও-না পূরে।
              দুঃখসুখের সকল হরষ,  ফুলের পরশ, ঝড়ের পরশ—
  তোমার   করুণ শুভ উদার পাণি 
                             আমার    হৃদয়-মাঝে দিক্‌-না আনি॥

৩৫৩ :: ডাকে বার বার ডাকে

                  ডাকে বার বার ডাকে,
 শোনো রে, দুয়ারে দুয়ারে আঁধারে আলোকে॥
 কত সুখদুঃখশোকে  কত মরণে জীবনলোকে
                  ডাকে বজ্রভয়ঙ্কর রবে,
 সুধাসঙ্গীতে ডাকে দ্যুলোকে ভূলোকে॥

৩৫৪ :: অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো

 অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
                সেই তো তোমার আলো!
 সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
                সেই তো তোমার ভালো॥
 পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ
                সেই তো তোমার গেহ।
 সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ
                সেই তো তোমার স্নেহ।
 সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান
                সেই তো তোমার দান।
 মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ
                সেই তো তোমার প্রাণ॥
 বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
                সেই তো স্বর্গভূমি।
 সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
                সেই তো আমার তুমি॥

৩৫৫ :: সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ

           সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ
           তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ॥
    মেঘের কলস ভ’রে ভ’রে  প্রসাদবারি পড়ে ঝ’রে,
           সকল দেহে প্রভাত বায়ু ঘুচায় অবসাদ—
           তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ॥
           তৃণ যে এই ধুলার ’পরে পাতে আঁচলখানি,
           এই-যে আকাশ চিরনীরব অমৃতময় বাণী,
    ফুল যে আসে দিনে দিনে  বিনা রেখার পথটি চিনে,
           এই-যে ভুবন দিকে দিকে পূরায় কত সাধ—
           তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ॥

৩৫৬ :: আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া

             আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
             বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া॥
 এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে  তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,
                  সকল পরান দিক-না নাড়া॥
             বোস্‌-না ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে
             অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু-মাখা হয়ে।
 যেখানেতে অগাধ ছুটি   মেল সেথা তোর ডানাদুটি,
              সবার মাঝে পাবি ছাড়া॥

৩৫৭ :: যে থাকে থাক‌-না দ্বারে যে যাবি যা-না পারে॥

 যে থাকে      থাক‌-না দ্বারে,   যে যাবি   যা-না পারে॥
 যদি ওই       ভোরের পাখি  তোরি নাম  যায় রে ডাকি
                   একা তুই   চলে যা রে॥
 কুঁড়ি চায়     আঁধার রাতে   শিশিরের  রসে মাতে।
 ফোটা ফুল    চায় না নিশা,  প্রাণে তার  আলোর তৃষা,
                    কাঁদে সে   অন্ধকারে॥

৩৫৮ :: আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় ও কে

            আকাশে    দুই হাতে প্রেম বিলায় ও কে!
            সে সুধা      গড়িয়ে গেল লোকে লোকে॥
            গাছেরা      ভরে নিল সবুজ পাতায়,
            ধরণী         ধরে নিল আপন মাথায়।
            ছেলেরা      সকল গায়ে নিল মেখে,
            পাখিরা      পাখায় পাখায় নিল এঁকে।
            ছেলেরা      কুড়িয়ে নিল মায়ের বুকে,
            মায়েরা       দেখে নিল ছেলের মুখে।
            সে যে ওই   দুঃখশিখায় উঠল জ্বলে,
            সে যে ওই   অশ্রুধারায় পড়ল গলে॥
            সে যে ওই   বিদীর্ণ বীর-হৃদয় হতে
            বহিল          মরণরূপী জীবনস্রোতে।
            সে যে ওই    ভাঙাগড়ার তালে তালে
            নেচে যায়    দেশে দেশে কালে কালে॥

৩৫৯ :: নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে

               নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে
 তারি       মধু কেন মনমধুপে খাওয়াও না?
               নিত্যসভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে,
 তোমার     ভৃত্যেরে সেই সভায় কেন গাওয়াও না?।
               বিশ্বকমল ফুটে চরণচুম্বনে,
 সে যে     তোমার মুখে মুখ তুলে চায় উন্মনে,
               আমার চিত্ত-কমলটিরে সেই রসে
 কেন       তোমার পানে নিত্য-চাওয়া চাওয়াও না?।
               আকাশে ধায় রবি-তারা ইন্দুতে,
 তোমার     বিরামহারা নদীরা যায় সিন্ধুতে,
                তেমনি করে সুধাসাগর-সন্ধানে
 আমার    জীবনধারা নিত্য কেন ধাওয়াও না?
               পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ,
 তুমি        ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ,
               তেমনি করে আমার হৃদয়ভিক্ষুরে
 কেন       দ্বারে তোমার নিত্য প্রসাদ পাওয়াও না?।

৩৬০ :: এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে

               এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে,
               আর তো গতি নাহি রে মোর নাহি রে॥
               যে পথে তব রথের রেখা ধরিয়া
               আপনা হতে কুসুম উঠে ভরিয়া,
   চন্দ্র ছুটে, সূর্য ছুটে,  সে পথতলে পড়িব লুটে—
               সবার পানে রহিব শুধু চাহি রে॥
               তোমার ছায়া পড়ে যে সরোবরে গো
               কমল সেথা ধরে না, নাহি ধরে গো।
   জলের ঢেউ তরল তানে   সে ছায়া লয়ে মাতিল গানে,
               ঘিরিয়া তারে ফিরিব তরী বাহি রে।
               যে বাঁশিখানি বাজিছে তব ভবনে
               সহসা তাহা শুনিব মধু পবনে।
   তাকায়ে রব দ্বারের পানে,  সে তানখানি লইয়া কানে
               বাজায়ে বীণা বেড়াব গান গাহি রে॥

৩৬১ :: কোলাহল তো বারণ হল এবার কথা কানে কানে

         কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
         এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে॥
  রাজার পথে লোক ছুটেছে, বেচা-কেনার হাঁক উঠেছে,
         আমার ছুটি অবেলাতেই দিন-দুপুরের মধ্যখানে—
         কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তা কেই-বা জানে॥
         মোর কাননে অকালে ফুল উঠুক তবে মুঞ্জরিয়া।
         মধ্যদিনে মৌমাছিরা বেড়াক মৃদু গুঞ্জরিয়া।
  মন্দভালোর দ্বন্দ্বে খেটে   গেছে তো দিন অনেক কেটে,
         অলস বেলার খেলার সাথি এবার আমার হৃদয় টানে।
                 বিনা কাজের ডাক পড়েছে
                                কেন যে তা কেই-বা জানে॥

৩৬২ :: যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে

            যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে
            সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে॥
 সোনার ঘটে সূর্য তারা  নিচ্ছে তুলে আলোর ধারা,
            অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে॥
            যেথায় তুমি বস দানের আসনে
            চিত্ত আমার সেথায় যাবে কেমনে?
 নিত্য নূতন রসে ঢেলে  আপনাকে যে দিচ্ছ মেলে,
            সেথা কি ডাক পড়বে না গো জীবনে?।

৩৬৩ :: বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো

               বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
                সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও॥
 নয়কো বনে, নয় বিজনে,   নয়কো আমার আপন মনে—
 সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,  সেথায় আপন আমারও॥
               সবার পানে যেথায় বাহু পসারো
               সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারও।
      গোপনে প্রেম রয় না ঘরে,  আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে—
      সবার তুমি আনন্দধন হে প্রিয়,    আনন্দ সেই আমারও॥

৩৬৪ :: প্রভু আজি তোমার দক্ষিণ হাত রেখো না ঢাকি

   প্রভু,    আজি তোমার দক্ষিণ হাত রেখো না ঢাকি।
              এসেছি তোমারে, হে নাথ, পরাতে রাখী॥
    যদি বাঁধি তোমার হাতে    পড়ব বাঁধা সবার সাথে,
              যেখানে যে আছে কেহই রবে না বাকি॥
              আজি যেন ভেদ নাহি রয় আপনা পরে,
              তোমায় যেন এক দেখি হে বাহিরে ঘরে।
     তোমা সাথে যে বিচ্ছেদে  ঘুরে বেড়াই কেঁদে কেঁদে
              ক্ষণেকতরে ঘুচাতে তাই তোমারে ডাকি॥

৩৬৫ :: অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না

  অমন   আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
  এবার   হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো,  কেউ জানবে না, কেউ বলবে না॥
              বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,    দেশ-বিদেশে কতই ঘুরি—
  এবার   বলো আমার মনের কোণে   দেবে ধরা, ছলবে না॥
             জানি আমার কঠিন হৃদয়    চরণ রাখার যোগ্য সে নয়—
  সখা,    তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়  তবু কি প্রাণ গলবে না?
              নাহয় আমার নাই সাধনা—ঝরলে তোমার কৃপার কণা
  তখন    নিমেষে কি ফুটবে না ফুল,  চকিতে ফল ফলবে না?।

৩৬৬ :: কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই

           কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই—
           দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই॥
  পুরানো আবাস ছেড়ে যাই যবে  মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে—
           নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই॥
           জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে
           চিরজনমের পরিচিত ওহে তুমিই চিনাবে সবে।
  তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর—
           সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ দেখা যেন সদা পাই॥

৩৬৭ :: সবার মাঝারে তোমারে স্বীকার করিব হে

         সবার মাঝারে তোমারে স্বীকার করিব হে।
         সবার মাঝারে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
         শুধু আপনার মনে নয়,  আপন ঘরের কোণে নয়,
  শুধু আপনার রচনার মাঝে নহে—তোমার মহিমা যেথা উজ্জ্বল রহে
         সেই সবা-মাঝে তোমারে স্বীকার করিব হে।
         দ্যুলোকে ভূলোকে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
         সকলই তেয়াগি তোমারে স্বীকার করিব হে।
         সকলই গ্রহণ করিয়া তোমারে বরিব হে।
         কেবলই তোমার স্তবে নয়,  শুধু সঙ্গীতরবে নয়,
  শুধু নির্জনে ধ্যানের আসনে নহে—তব সংসার যেথা জাগ্রত রহে,
         কর্মে সেথায় তোমারে স্বীকার করিব হে।
         প্রিয়ে অপ্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
         জানি না বলিয়া তোমারে স্বীকার করিব হে।
         জানি ব’লে, নাথ, তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
         শুধু জীবনের সুখে নয়,   শুধু প্রফুল্লমুখে নয়,
  শুধু সুদিনের সহজ সুযোগে নহে— দুখশোক যেথা আঁধার করিয়া রহে
         নত হয়ে সেথা তোমারে স্বীকার করিব হে।
         নয়নের জলে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥

৩৬৮ :: মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে তোমার বিশ্বের সভাতে

  মোরে  ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে  তোমার বিশ্বের সভাতে
                        আজি  এ মঙ্গলপ্রভাতে॥
  উদয়গিরি হতে উচ্চে কহো মোরে ঃ  তিমির লয় হল দীপ্তিসাগরে—
  স্বার্থ হতে জাগো, দৈন্য হতে জাগো, সব জড়তা হতে জাগো জাগো রে
                        সতেজ উন্নত শোভাতে॥
  বাহির করো তব পথের মাঝে,  বরণ করো মোরে তোমার কাজে।
  নিবিড় আবরণ করো বিমোচন,  মুক্ত করো সব তুচ্ছ শোচন,
  ধৌত করো মম মুগ্ধ লোচন  তোমার উজ্জ্বল শুভ্ররোচন
                        নবীন নির্মল বিভাতে॥

৩৬৯ :: যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্‌ তারা তো পারে না জানিতে

     যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্‌, তারা তো পারে না জানিতে—
     তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে॥
 যারা কথা বলে তাহারা বলুক,  আমি করিব না কারেও বিমুখ—
     তারা নাহি জানে ভরা আছে প্রাণ তব অকথিত বাণীতে।
     নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার নীরব হৃদয়খানিতে॥
 তোমার লাগিয়া কারেও, হে প্রভু,  পথ ছেড়ে দিতে বলিব না কভু,
     যত প্রেম আছে সব প্রেম মোরে তোমা-পানে রবে টানিতে—
     সকলের প্রেমে রবে তব প্রেম আমার হৃদয়খানিতে।
 সবার সহিতে তোমার বাঁধন   হেরি যেন সদা এ মোর সাধন—
     সবার সঙ্গ পারে যেন মনে তব আরাধনা আনিতে।
          সবার মিলনে তোমার মিলন
                    জাগিবে হৃদয়খানিতে॥

৩৭০ :: জাগ্রত বিশ্বকোলাহল-মাঝে

            জাগ্রত বিশ্বকোলাহল-মাঝে
     তুমি গম্ভীর, স্তব্ধ, শান্ত, নির্বিকার,
                 পরিপূর্ণ মহাজ্ঞান॥
 তোমা-পানে ধায় প্রাণ  সব কোলাহল ছাড়ি,
           চঞ্চল নদী যেমন ধায় সাগরে॥

৩৭১ :: শান্তিসমুদ্র তুমি গভীর

 শান্তিসমুদ্র তুমি গভীর,
             অতি অগাধ আনন্দরাশি।
 তোমাতে সব দুঃখ জ্বালা
             করি নির্বাণ ভুলিব সংসার,
      অসীম সুখসাগরে ডুবে যাব॥

৩৭২ :: ডুবি অমৃতপাথারে যাই ভুলে চরাচর

 ডুবি অমৃতপাথারে— যাই ভুলে চরাচর,
                     মিলায় রবি শশী॥
 নাহি দেশ, নাহি কাল, নাহি হেরি সীমা—
      প্রেমমুরতি হৃদয়ে জাগে,
           আনন্দ নাহি ধরে॥

৩৭৩ :: ভেঙেছে দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় তোমারি হউক জয়

 ভেঙেছে দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়,   তোমারি হউক জয়।
 তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়,  তোমারি হউক জয়॥
             হে বিজয়ী বীর, নব জীবনের প্রাতে
             নবীন আশার খড়্গ তোমার হাতে—
 জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে,  বন্ধন হোক ক্ষয়॥
 এসো দুঃসহ, এসো এসো নির্দয়,  তোমারি হউক জয়।
 এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয়, তোমারি হউক জয়।
             প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে,
             দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে—
 অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে,  মৃত্যুর হোক লয়॥

৩৭৪ :: হবে জয় হবে জয় হবে জয় রে

         হবে জয়, হবে জয়, হবে জয় রে,
                 ওহে বীর, হে নির্ভয়॥
 জয়ী প্রাণ, চিরপ্রাণ,  জয়ী রে আনন্দগান,
 জয়ী প্রেম, জয়ী ক্ষেম,  জয়ী জ্যোতির্ময় রে॥
         এ আঁধার হবে ক্ষয়, হবে ক্ষয় রে,
                 ওহে বীর, হে নির্ভয়।
 ছাড়ো ঘুম, মেলো চোখ,  অবসাদ দূর হোক,
 আশার অরুণালোক  হোক অভ্যুদয় রে॥

৩৭৫ :: জয় হোক জয় হোক নব অরুণোদয়

 জয় হোক, জয় হোক নব অরুণোদয়।
 পূর্ব দিগঞ্চল হোক জ্যোতির্ময়॥
 এসো অপরাজিত বাণী,  অসত্য হানি—
 অপহত শঙ্কা, অপগত সংশয়॥
 এসো নবজাগ্রত প্রাণ,  চিরযৌবনজয়গান।
 এসো মৃত্যুঞ্জয় আশা   জড়ত্বনাশা—
 ত্রন্দন দূর হোক, বন্ধন হোক ক্ষয়॥

৩৭৬ :: জয় তব বিচিত্র আনন্দ হে কবি

            জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি,
                   জয় তোমার করুণা।
            জয় তব ভীষণ সব-কলুষ-নাশন রুদ্রতা।
            জয় অমৃত তব, জয় মৃত্যু তব,
                   জয় শোক তব, জয় সান্ত্বনা॥
            জয় পূর্ণজাগ্রত জ্যোতি তব,
       জয় তিমিরনিবিড় নিশীথিনী ভয়দায়িনী।
 জয় প্রেমমধুময় মিলন তব,  জয় অসহ বিচ্ছেদবেদনা॥

৩৭৭ :: সকলকলুষতামসহর জয় হোক তব জয়

          সকলকলুষতামসহর, জয় হোক তব জয়—
          অমৃতবারি সিঞ্চন কর’ নিখিলভুবনময়—
          মহাশান্তি, মহাক্ষেম, মহাপুণ্য, মহাপ্রেম॥
    জ্ঞানসূর্য-উদয়-ভাতি    ধ্বংস করুক তিমিররাতি—
          দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি অপগত কর’ ভয়॥
          মোহমলিন অতি-দুর্দিন-শঙ্কিত-চিত পান্থ
          জটিল-গহন-পথসঙ্কট-সংশয়-উদ্‌ভ্রান্ত।
    করুণাময়, মাগি শরণ— দুর্গতিভয় করহ হরণ,
          দাও দুঃখবন্ধতরণ মুক্তির পরিচয়॥

৩৭৮ :: রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে

        রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে,
        প্রাণমনে ধরি রাখো নিবিড় আনন্দবন্ধনে॥
 আলো জ্বালো হৃদয়দীপে  অতিনিভৃত অন্তরমাঝে,
        আকুলিয়া দাও প্রাণ গন্ধচন্দনে॥

৩৭৯ :: হৃদয়মন্দিরে প্রাণাধীশ আছ গোপনে

 হৃদয়মন্দিরে, প্রাণাধীশ, আছ গোপনে।
 অমৃতসৌরভে আকুল প্রাণ,  হায়,
 ভ্রমিয়া জগতে না পায় সন্ধান—
 কে পারে পশিতে আনন্দভবনে
 তোমার করুণাকিরণ-বিহনে॥

৩৮০ :: ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে

          ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে,
                         শুনি    আপন-মনে।
          বুঝি আমার মনোহরণ আসে গোপনে॥
               পাবার আগে কিসের আভাস পাই,
               চোখের জলের বাঁধ ভেঙেছে তাই গো,
          মালার গন্ধ এল যারে জানি স্বপনে॥
 ফুলের মালা হাতে ফাগুন চেয়ে আছে  ওই-যে—
      তার  চলার পথের কাছে  ওই-যে।
          দিগঙ্গনার অঙ্গনে যে আজি
          ক্ষণে ক্ষণে শঙ্খ ওঠে বাজি,
 আশার হাওয়া লাগে   ওই   নিখিল গগনে॥

৩৮১ :: বেঁধেছ প্রেমের পাশে ওহে প্রেমময়

       বেঁধেছ প্রেমের পাশে ওহে প্রেমময়।
 তব প্রেম লাগি   দিবানিশি জাগি  ব্যাকুলহৃদয়॥
 তব প্রেমে কুসুম হাসে,  তব প্রেমে চাঁদ বিকাশে,
              প্রেমহাসি তব উষা নব নব,
              প্রেমে-নিমগন নিখিল নীরব,
 তব প্রেম-তরে ফিরে হা হা ক’রে উদাসী মলয়॥
       আকুল প্রাণ মম ফিরিবে না সংসারে,
       ভুলেছে তোমারি রূপে নয়ন আমারি।
 জলে স্থলে    গগনতলে    তব সুধাবাণী সতত উথলে—
              শুনিয়া পরান শান্তি না মানে,
              ছুটে যেতে চায় অনন্তেরই পানে,
 আকুল হৃদয়  খোঁজে বিশ্বময়  ও প্রেম-আলয়॥

৩৮২ :: দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও

             দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও।
             আমার দিকে ও মুখ ফিরাও॥
 কাছে থেকে চিনতে নারি,  কোন্‌ দিকে যে কী নেহারি,
 তুমি আমার হৃদ্‌বিহারী     হৃদয়-পানে হাসিয়া চাও॥
 বলো আমায় বলো কথা,    গায়ে আমায় পরশ করো।
 দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে   আমায় তুমি তুলে ধরো।
 যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে,  যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে—
 হাসি মিছে, কান্না মিছে,   সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও॥

৩৮৩ :: আর নহে আর নয়

               আর নহে, আর নয়,
 আমি      করি নে আর ভয়।
 আমার    ঘুচল কাঁদন, ফলল সাধন, হল বাঁধন ক্ষয়॥
 ওই         আকাশে ওই ডাকে,
 আমায়    আর কে ধ’রে রাখে—
 আমি       সকল দুয়ার খুলেছি, আজ যাব সকলময়॥
 ওরা        ব’সে ব’সে মিছে
 শুধু         মায়াজাল গাঁথিছে—
 ওরা        কী-যে গোনে ঘরের কোণে আমায় ডাকে পিছে।
 আমার    অস্ত্র হল গড়া,
 আমার    বর্ম হল পরা—
 এবার      ছুটবে ঘোড়া পবনবেগে, করবে ভুবন জয়॥

৩৮৪ :: আরো চাই যে আরো চাই গো আরো যে চাই

          আরো চাই যে, আরো চাই গো—আরো যে চাই।
          ভাণ্ডারী যে সুধা আমায় বিতরে নাই॥
    সকালবেলার আলোয় ভরা এই-যে আকাশ বসুন্ধরা
          এরে আমার জীবন-মাঝে কুড়ানো চাই—
          সকল ধন যে বাইরে আমার, ভিতরে নাই॥
          প্রাণের বীণায় আরো আঘাত, আরো যে চাই।
          গুণীর পরশ পেয়ে সে যে শিহরে নাই।
    দিনরজনীর বাঁশি পূরে  যে গান বাজে অসীম সুরে
          তারে আমার প্রাণের তারে বাজানো চাই।
          আপন গান যে দূরে তাহার, নিয়ড়ে নাই॥

৩৮৫ :: নয়ন ছেড়ে গেলে চলে এলে সকল-মাঝে

           নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল-মাঝে—
           তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে॥
 ফুরায় যবে মিলনরাতি        তবু চির সাথের সাথি
           ফুরায় না তো তোমায় পাওয়া, এসো স্বপনসাজে॥
           তোমার সুধারসের ধারা গহনপথে এসে
           ব্যথারে মোর মধুর করি নয়নে যায় ভেসে।
 শ্রবণে মোর নব নব       শুনিয়েছিলে যে সুর তব
           বীণা থেকে বিদায় নিল, চিত্তে আমার বাজে॥

৩৮৬ :: আরাম-ভাঙা উদাস সুরে

                    আরাম-ভাঙা উদাস সুরে
      আমার বাঁশির শূন্য হৃদয় কে দিল আজ ব্যথায় পূরে॥
 বিরামহারা ঘরছাড়াকে  ব্যাকুল বাঁশি আপনি ডাকে—
      ডাকে স্বপন-জাগরণে, কাছের থেকে ডাকে দূরে॥
 আমার প্রাণের কোন্‌ নিভৃতে  লুকিয়ে কাঁদায় গোধূলিতে—
 মন আজও তার নাম জানে না,  রূপ আজও তার নয়কো চেনা—
          কেবল যে সে ছায়ার বেশে স্বপ্নে আমার বেড়ায় ঘুরে॥

৩৮৭ :: আসা-যাওয়ার মাঝখানে

                   আসা-যাওয়ার মাঝখানে
          একলা আছ চেয়ে কাহার পথ-পানে॥
 আকাশে ওই কালোয় সোনায়  শ্রাবণমেঘের কোণায় কোণায়
          আঁধার-আলোয় কোন্‌ খেলা যে কে জানে
               আসা-যাওয়ার মাঝখানে॥
 শুকনো পাতা ধুলায় ঝরে,  নবীন পাতায় শাখা ভরে।
 মাঝে তুমি আপন-হারা,  পায়ের কাছে জলের ধারা
          যায় চলে ওই অশ্রু-ভরা কোন্‌ গানে
                আসা যাওয়ার মাঝখানে॥

৩৮৮ :: বারে বারে পেয়েছি যে তারে

               বারে বারে পেয়েছি যে তারে
               চেনায় চেনায় অচেনারে॥
 যারে দেখা গেল তারি মাঝে    না-দেখারই কোন্‌ বাঁশি বাজে,
 যে আছে বুকের কাছে কাছে   চলেছি তাহারি অভিসারে॥
 অপরূপ সে যে রূপে রূপে    কী খেলা খেলিছে চুপে চুপে।
 কানে কানে কথা উঠে পূরে    কোন্‌ সুদূরের সুরে সুরে,
 চোখে-চোখে-চাওয়া নিয়ে চলে  কোন্‌ অজানারই পথপারে॥

৩৮৯ :: এ পথ গেছে কোন্‌খানে গো কোন্‌খানে

 এ পথ গেছে কোন্‌খানে গো কোন্‌খানে
         তা     কে জানে তা কে জানে॥
 কোন্‌ পাহাড়ের পারে,  কোন্‌ সাগরের ধারে,
         কোন্‌ দুরাশার দিক্‌-পানে—
         তা     কে জানে তা কে জানে॥
 এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্‌খানে
         তা     কে জানে তা কে জানে।
 কেমন যে তার বাণী,  কেমন হাসিখানি,
         যায়     সে কাহার সন্ধানে—
         তা      কে জানে তা কে জানে॥

৩৯০ :: নিত্য নব সত্য তব শুভ্র আলোকময়

 নিত্য নব সত্য তব শুভ্র আলোকময়
 পরিপূর্ণ জ্ঞানময়
 কবে হবে বিভাসিত মম চিত্ত-আকাশে॥
 রয়েছি বসি দীর্ঘনিশি
 চাহিয়া উদয়দিশি
 ঊর্ধমুখে করপুটে—
 নবসুখ-নবপ্রাণ-নবদিবা-আশে॥
 কী দেখিব, কী জানিব,
 না জানি সে কী আনন্দ—
 নূতন আলোক আপন মনোমাঝে।
 সে আলোকে মহাসুখে
 আপন আলয়মুখে
 চলে যাব গান গাহি—
 কে রহিবে আর দূর পরবাসে॥

৩৯১ :: যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল-অন্তর

    যদি     ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল-অন্তর
    তবে     দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো ঈশ্বর॥
    ওহে     অপাপপুরুষ, দীনহীন আমি এসেছি পাপের কূলে—
    প্রভু,     দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া করে লও তুলে॥
    আমি    জলের মাঝারে বাস করি, তবু তৃষায় শুকায়ে মরি—
    প্রভু      দয়া কোরো হে, দয়া করে দাও সুধায় হৃদয় ভরি॥

৩৯২ :: তুমি আমাদের পিতা

                        তুমি আমাদের পিতা,
        তোমায়      পিতা ব’লে যেন জানি,
        তোমায়      নত হয়ে যেন মানি,
        তুমি         কোরো না কোরো না রোষ।
 হে পিতা, হে দেব, দূর করে দাও যত পাপ, যত দোষ—
 যাহা ভলো তাই দাও আমাদের, যাহাতে তোমার তোষ॥
 তোমা হতে সব সুখ হে পিতা, তোমা হতে সব ভলো।
 তোমাতেই সব সুখ হে পিতা, তোমাতেই সব ভালো।
 তুমিই ভালো হে তুমিই ভালো সকল-ভালোর সার—
 তোমারে নমস্কার হে পিতা, তোমারে নমস্কার॥

৩৯৩ :: প্রেমানন্দে রাখো পূর্ণ আমারে দিবসরাত

 প্রেমানন্দে রাখো পূর্ণ আমারে দিবসরাত।
 বিশ্বভুবনে নিরখি সতত সুন্দর তোমারে,
 চন্দ্র-সূর্য-কিরণে তোমার করুণ নয়নপাত॥
 সুখসম্পদে করি হে পান তব প্রসাদবারি,
 দুখসঙ্কটে পরশ পাই তব মঙ্গলহাত॥
 জীবনে জ্বালো অমর দীপ তব অনন্ত আশা,
 মরণ-অন্তে হউক তোমারি চরণে সুপ্রভাত॥
 লহো লহো মম সব আনন্দ, সকল প্রীতি-গীতি—
 হৃদয়ে বাহিরে একমাত্র তুমি আমার নাথ॥

৩৯৪ :: মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না

 মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
 কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?।
 ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
 হারাই-হারাই সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে॥
 কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
 এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে?
 আর কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ—
 তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন॥

৩৯৫ :: তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল

   তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।
   সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল॥
   আপনি কেটেছে আপনার মূল—না জানে সাঁতার, নাহি পায় কূল,
   স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে, করে দিবানিশি টলমল॥
   আমি কোথা যাব, কাহারে শুধাব, নিয়ে যায় সবে টানিয়া।
   একেলা আমারে ফেলে যাবে শেষে অকূল পাথারে আনিয়া।
   সুহৃদের তরে চাই চারি ধারে, আঁখি করিতেছে ছলছল।
   আপনার ভরে মরি যে আপনি কাঁপিছে হৃদয় হীনবল॥

৩৯৬ :: কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে

  কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে?
  অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে,  
  বিরহে তব কাটে দিনরাত হে॥
  স্বপনসম মিলাবে যদি কেন গো দিলে চেতনা—
  চকিতে শুধু দেখা দিয়ে চিরমরমবেদনা,
  আপনা-পানে চাহি শুধু নয়নজলপাত হে॥
  পরশে তব জীবন নব সহসা যদি জাগিল
  কেন জীবন বিফল কর— মরণশরঘাত হে॥
  অহঙ্কার চূর্ণ করো, প্রেমে মন পূর্ণ করো,
  হৃদয় মন হরণ করি রাখো তব সাথ হে॥

৩৯৭ :: তুমি ছেড়ে ছিলে ভুলে ছিলে ব’লে হেরো গো কী দশা হয়েছে

     তুমি ছেড়ে ছিলে, ভুলে ছিলে ব’লে হেরো গো কী দশা হয়েছে—
     মলিন বদন, মলিন হৃদয়, শোকে প্রাণ ডুবে রয়েছে॥
     বিরহীর বেশে এসিছ হেথায় জানাতে বিরহবেদনা;
     দরশন নেব তবে চলে যাব, অনেক দিনের বাসনা॥
     ‘নাথ নাথ’ ব’লে ডাকিব তোমারে, চাহিব হৃদয়ে রাখিতে—
     কাতর প্রাণের রোদন শুনিলে আর কি পারিবে থাকিতে?
     ও অমৃতরূপ দেখিব যখন মুছিব নয়নবারি হে—
     আর উঠিব না, পড়িয়া রহিব চরণতলে তোমারি হে॥

৩৯৮ :: অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ কত গ্রহ উপগ্রহ

 অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ
 কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালায়ে—
 তুমি কোথায়, তুমি কোথায়?।
 হায় সকলই অন্ধকার— চন্দ্র, সূর্য, সকল কিরণ,
 আঁধার নিখিল বিশ্বজগত।
 তোমার প্রকাশ হৃদয়মাঝে সুন্দর মোর নাথ—
 মধুর প্রেম-আলোকে  তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে॥

৩৯৯ :: চরণধ্বনি শুনি তব নাথ জীবনতীরে

 চরণধ্বনি শুনি তব, নাথ, জীবনতীরে
 কত নীরব নির্জনে কত মধুসমীরে॥
 গগনে গ্রহতারাচয়  অনিমেষে চাহি রয়,
 ভাবনাস্রোত হৃদয়ে বয়  ধীরে একান্ত ধীরে॥
 চাহিয়া রহে আঁখি মম   তৃষ্ণাতুর পাখিসম,
 শ্রবণ রয়েছি মেলি চিত্তগভীরে—
 কোন্‌ শুভপ্রাতে দাঁড়াবে হৃদিমাঝে,
 ভুলিব সব দুঃখ সুখ ডুবিয়া আনন্দনীরে॥

৪০০ :: শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ পথে পথে ফিরি হে দ্বারে দ্বারে

 শূন্য হাতে ফিরি, হে নাথ, পথে পথে—  ফিরি হে দ্বারে দ্বারে—
          চিরভিখারি হৃদি মম নিশিদিন চাহে কারে॥
          চিত্ত না শান্তি জানে, তৃষ্ণা না তৃপ্তি মানে—
          যাহা পাই তাই হারাই, ভাসি অশ্রুধারে॥
          সকল যাত্রী চলি গেল, বহি গেল সব বেলা,
          আসে তিমিরযামিনী, ভাঙিয়া গেল মেলা—
          কত পথ আছে বাকি, যাব চলি ভিক্ষা রাখি,
          কোথা জ্বলে গৃহপ্রদীপ কোন্‌ সিন্ধুপারে॥

৪০১ :: হৃদয়বেদনা বহিয়া প্রভু এসেছি তব দ্বারে

          হৃদয়বেদনা বহিয়া, প্রভু, এসেছি তব দ্বারে।
          তুমি অন্তর্যামী হৃদয়স্বামী, সকলই জানিছ হে—
          যত দুঃখ লাজ দারিদ্র্য সঙ্কট আর জানাইব কারে?।
          অপরাধ কত করেছি, নাথ, মোহপাশে প’ড়ে—
          তুমি ছাড়া, প্রভু, মার্জনা কেহ করিবে না সংসারে॥
          সব বাসনা দিব বিসর্জন তোমার প্রেমপাথারে,
          সব বিরহ বিচ্ছেদ ভুলিব তব মিলন-অমৃতধারে।
 আর  আপন ভাবনা পারি না ভাবিতে, তুমি লহো মোর ভার—
          পরিশ্রান্ত জনে, প্রভু, লয়ে যাও সংসারসাগরপারে।

৪০২ :: কেন জাগে না জাগে না অবশ পরান

       কেন  জাগে না, জাগে না অবশ পরান—
                নিশিদিন অচেতন ধূলিশয়ান?।
                জাগিছে তারা নিশীথ-আকাশে,
                 জাগিছে শত অনিমেষ নয়ান॥
                বিহগ গাহে বনে ফুটে ফুলরাশি,
                চন্দ্রমা হাসে সুধাময় হাসি—
                তব মাধুরী কেন জাগে না প্রাণে?
                কেন হেরি না তব প্রেমবয়ান॥
                পাই জননীর অযাচিত স্নেহ,
                ভাই ভগিনী মিলি মধুময় গেহ
                কত ভাবে সদা তুমি আছ হে কাছে,
                কেন করি তোমা হতে দূরে প্রয়াণ?।

৪০৩ :: যাদের চাহিয়া তোমারে ভুলেছি তারা তো চাহে না আমারে

      যাদের চাহিয়া তোমারে ভুলেছি তারা তো চাহে না আমারে;
      তারা আসে, তারা চলে যায় দূরে, ফেলে যায় মরু-মাঝারে॥
      দু দিনের হাসি দু দিনে ফুরায়, দীপ নিভে যায় আঁধারে;
      কে রহে তখন মুছাতে নয়ন, ডেকে ডেকে মরি কাহারে?।
      যাহা পাই তাই ঘরে নিয়ে যাই আপনার মন ভুলাতে—
      শেষে দেখি হায় ভেঙে সব যায়, ধুলা হয়ে যাবে ধুলাতে।
      সুখের আশায় মরি পিপাসায় ডুবে মরি দুখপাথারে—
      রবি শশী তারা কোথা হয় হারা, দেখিতে না পাই তোমারে॥

৪০৪ :: আমি জেনে শুনে তবু ভুলে আছি দিবস কাটে বৃথায় হে

 আমি    জেনে শুনে তবু ভুলে আছি, দিবস কাটে বৃথায় হে—
 আমি    যেতে চাই তব পথপানে, কত বাধা পায় পায় হে॥
             চারি দিকে হেরো ঘিরিছে কারা, শত বাঁধনে জড়ায় হে—
 আমি    ছাড়াতে চাহি, ছাড়ে না কেন গো ডুবায়ে রাখে মায়ায় হে॥
             দাও ভেঙে দাও এ ভবের সুখ, কাজ নেই এ খেলায় হে।
 আমি    ভুলে থাকি যত অবোধের মতো বেলা বহে তত যায় হে॥
             হানো তব বাজ হৃদয়গহনে, দুখানল জ্বালো তায় হে—
             নয়নের জলে ভাসায়ে আমারে সে জল দাও মুছায়ে হে॥
             শূন্য করে দাও হৃদয় আমার, আসন পাতো সেথায় হে—
             তুমি এসো এসো, নাথ হয়ে বোসো, ভুলো না আর আমায় হে॥

৪০৫ :: নয়ান ভাসিল জলে

                     নয়ান ভাসিল জলে—
 শূন্য হিয়াতলে ঘনাইল নিবিড় সজল ঘন প্রসাদপবনে,
               জাগিল রজনী হরষে হরষে রে॥
       তাপহরণ তৃষিতশরণ জয় তাঁর দয়া গাও রে।
       জাগো রে আনন্দে চিতচাতক জাগো—
       মৃদু মৃদু মধু মধু প্রেম বরষে বরষে রে॥

৪০৬ :: হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব

       হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;
       ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ॥
                 নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী—
                 কর’ ত্রাণ মহাপ্রাণ, আন’ অমৃতবাণী,
                 বিকশিত কর’ প্রেমপদ্ম চিরমধুনিষ্যন্দ।
                      শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
                      করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য।
       এস’ দানবীর, দাও ত্যাগকঠিন দীক্ষা।
       মহাভিক্ষু, লও সবার অহঙ্কারভিক্ষা।
                 লোক লোক ভুলুক শোক, খণ্ডন কর’ মোহ,
                 উজ্জ্বল হোক জ্ঞানসূর্য-উদয়সমারোহ—
                 প্রাণ লভুক সকল ভুবন, নয়ন লভুক অন্ধ।
                       শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
                       করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য।
       ত্রন্দনময় নিখিলহৃদয় তাপদহনদীপ্ত
       বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।
                 দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষগ্লানি,
                 তব মঙ্গলশঙ্খ আন’ তব দক্ষিণপাণি—
                 তব শুভসঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
                       শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
                       করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য॥

৪০৭ :: অনেক দিয়েছ নাথ

            অনেক দিয়েছ নাথ
 আমায়  অনেক দিয়েছ নাথ,
 আমার বাসনা তবু পুরিল না—
 দীনদশা ঘুচিল না, অশ্রুবারি মুছিল না,
 গভীর প্রাণের তৃষা মিটিল না, মিটিল না॥
 দিয়েছ জীবন মন, প্রাণপ্রিয় পরিজন,
 সুধাস্নিগ্ধ সমীরণ, নীলকান্ত অম্বর, শ্যামশোভা ধরণী।
 এত যদি দিলে, সখা, আরো দিতে হবে হে—
 তোমারে না পেলে আমি ফিরিব না, ফিরিব না॥

৪০৮ :: তব অমল পরশরস তব শীতল শান্ত পুণ্যকর অন্তরে দাও

 তব অমল পরশরস, তব শীতল শান্ত পুণ্যকর অন্তরে দাও।
 তব উজ্জ্বল জ্যোতি বিকাশি হৃদয়মাঝে মম চাও॥
 তব মধুময় প্রেমরসসুন্দরসুগন্ধে জীবন ছাও।
 জ্ঞান ধ্যান তব, ভক্তি-অমৃত তব, শ্রী আনন্দ জাগাও॥

৪০৯ :: বীণা বাজাও হে মম অন্তরে॥

 বীণা বাজাও হে মম অন্তরে॥
 সজনে বিজনে, বন্ধু, সুখে দুঃখে বিপদে—
 আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে॥

৪১০ :: শান্তি করো বরিষন নীরব ধারে নাথ চিত্তমাঝে

 শান্তি করো বরিষন নীরব ধারে, নাথ, চিত্তমাঝে
 সুখে দুখে সব কাজে, নির্জনে জনসমাজে॥
 উদিত রাখো, নাথ, তোমার প্রেমচন্দ্র
 অনিমেষ মম লোচনে   গভীরতিমিরমাঝে॥

৪১১ :: হে সখা মম হৃদয়ে রহো

              হে সখা, মম হৃদয়ে রহো।
 সংসারে সব কাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো॥
 নাথ, তুমি এসো ধীরে   সুখ-দুখ-হাসি-নয়ননীরে,
              লহো আমার জীবন ঘিরে—
 সংসারে সব কাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো॥

৪১২ :: লহো লহো তুলি লও হে ভূমিতল হতে ধূলিম্লান এ পরান

 লহো লহো তুলি লও হে ভূমিতল হতে ধূলিম্লান এ পরান—
 রাখো তব কৃপাচোখে, রাখো তব স্নেহকরতলে।
 রাখো তারে আলোকে, রাখো তারে অমৃতে,
 রাখো তারে নিয়ত কল্যাণে, রাখো তারে কৃপাচোখে,
                  রাখো তারে স্নেহকরতলে॥

৪১৩ :: চিরসখা ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না

 চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।
 সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো॥
 অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল।
 জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর॥

৪১৪ :: স্বামী তুমি এসো আজ অন্ধকার হৃদয়মাঝ

       স্বামী, তুমি এসো আজ অন্ধকার হৃদয়মাঝ—
       পাপে ম্লান পাই লাজ, ডাকি হে তোমারে॥
 ত্রন্দন উঠিছে প্রাণে,  মন শান্তি নাহি মানে,
       পথ তবু নাহি জানে আপন আঁধারে॥
 ধিক ধিক জনম মম,  বিফল বিষয়শ্রম—
       বিফল ক্ষণিক প্রেম টুটিয়া যায় বারবার।
 সন্তাপে হৃদয় দহে,    নয়নে অশ্রুবারি বহে,
       বাড়িছে বিষয়পিপাসা বিষম বিষবিকারে॥

৪১৫ :: হায় কে দিবে আর সান্ত্বনা

               হায় কে দিবে আর সান্ত্বনা।
           সকলে গিয়েছে হে, তুমি যেয়ো না—
 চাহো প্রসন্ন নয়নে, প্রভু, দীন অধীন জনে॥
      চারি দিকে চাই, হেরি না কাহারে।
      কেন গেলে ফেলে একেলা আঁধারে—
      হেরো গো শূন্য ভুবন মম॥

৪১৬ :: আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম

        আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম।
  আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি॥
        রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী—
        করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী॥
        অতৃপ্ত বাসনা লাগি ফিরিয়াছি পথে পথে—
  বৃথা খেলা, বৃথা মেলা, বৃথা বেলা গেল বহে।
        আজি সন্ধ্যাসমীরণে লহো শান্তিনিকেতনে,
        স্নেহকরপরশনে চিরশান্তি দেহো আনি॥

৪১৭ :: কামনা করি একান্তে

                  কামনা করি একান্তে
      হউক বরষিত নিখিল বিশ্বে সুখ শান্তি॥
 পাপতাপ হিংসা শোক  পাসরে সকল লোক,
                  সকল প্রাণী পায় কূল
      সেই তব তাপিতশরণ অভয়চরণপ্রান্তে॥

৪১৮ :: নাথ হে প্রেমপথে সব বাধা ভাঙিয়া দাও

 নাথ হে, প্রেমপথে সব বাধা ভাঙিয়া দাও।
          মাঝে কিছু রেখো না, রেখো না—
                 থেকো না, থেকো না দূরে॥
 নির্জনে সজনে অন্তরে বাহিরে
                 নিত্য তোমারে হেরিব॥

৪১৯ :: পূর্ণ-আনন্দ পূর্ণমঙ্গলরূপে হৃদয়ে এসো

                   পূর্ণ-আনন্দ পূর্ণমঙ্গলরূপে হৃদয়ে এসো,
                             এসো মনোরঞ্জন॥
 আলোকে আঁধার হউক চূর্ণ   অমৃতে মৃত্যু করো পূর্ণ —
                             করো গভীরদারিদ্র্যভঞ্জন॥
 সকল সংসার দাঁড়াবে সরিয়া তুমি হৃদয়ে আসিছ দেখি—
      জ্যোতির্ময় তোমার প্রকাশে শশী তপন পায় লাজ,
        ‍          সকলের তুমি গর্বগঞ্জন॥

৪২০ :: সংশয়তিমিরমাঝে না হেরি গতি হে

                   সংশয়তিমিরমাঝে না হেরি গতি হে।
                   প্রেম-আলোকে প্রকাশো জগপতি হে॥
      বিপদে সম্পদে থেকো না দূরে, সতত বিরাজো হৃদয়পুরে—
                   তোমা বিনে অনাথ আমি অতি হে॥
      মিছে আশা লয়ে সতত ভ্রান্ত,   তাই প্রতিদিন হতেছি শ্রান্ত,
                        তবু চঞ্চল বিষয়ে মতি হে—
 নিবারো নিবারো প্রাণের ত্রন্দন,  কাটো হে কাটো হে এ মায়াবন্ধন,
                   রাখো রাখো চরণে এ মিনতি হে॥

৪২১ :: নিশিদিন মোর পরানে প্রিয়তম মম

         নিশিদিন মোর পরানে প্রিয়তম মম
              কত-না বেদনা দিয়ে বারতা পাঠালে॥
 ভরিলে চিত্ত মম নিত্য তুমি প্রেমে প্রাণে গানে হায়
                     থাকি আড়ালে॥

৪২২ :: আছ অন্তরে চিরদিন তবু কেন কাঁদি

 আছ অন্তরে চিরদিন, তবু কেন কাঁদি?।
 তবু কেন হেরি না তোমার জ্যোতি,
 কেন দিশাহারা অন্ধকারে?।
 অকূলের কূল তুমি আমার,
 তবু কেন ভেসে যাই মরণের পারাবারে?
 আনন্দঘন বিভু, তুমি যার স্বামী
 সে কেন ফিরে পথে দ্বারে দ্বারে?।

৪২৩ :: এ মোহ-আবরণ খুলে দাও দাও হে॥

 এ মোহ-আবরণ খুলে দাও, দাও হে॥
 সুন্দর মুখ তব হেরি নয়ন ভরি,
 চাও হৃদয়মাঝে চাও হে॥

৪২৪ :: ডাকিছ কে তুমি তাপিত জনে তাপহরণ স্নেহকোলে॥

 ডাকিছ কে তুমি তাপিত জনে তাপহরণ স্নেহকোলে॥
               নয়নসলিলে ফুটেছে হাসি,
 ডাক শুনে সবে ছুটে চলে তাপহরণ স্নেহকোলে॥
 ফিরিছে যারা পথে পথে, ভিক্ষা মাগিছে দ্বারে দ্বারে
               শুনেছে তাহারা তব করুণা—
 দুখীজনে তুমি নেবে তুলে তাপহরণ স্নেহকোলে॥

৪২৫ :: আজি নাহি নাহি নিদ্রা অঁখিপাতে

 আজি  নাহি নাহি নিদ্রা অঁখিপাতে।
 তোমার ভবনতলে হেরি প্রদীপ জ্বলে,
 দূরে বাহিরে তিমিরে আমি জাগি জোড়হাতে॥
         ত্রন্দন ধ্বনিছে পথহারা পবনে,
         রজনী মূর্ছাগত বিদ্যুতঘাতে।
         দ্বার খোলো হে দ্বার খোলো—
 প্রভু,     করো দয়া, দেহো দেখা দুখরাতে॥

৪২৬ :: তিমিরবিভাবরী কাটে কেমনে

 তিমিরবিভাবরী কাটে কেমনে
 জীর্ণ ভবনে, শূন্য জীবনে—
 হৃদয় শুকাইল প্রেম বিহনে॥
 গহন আঁধার কবে  পুলকে পূর্ণ হবে
 ওহে আনন্দময়, তোমার বীণারবে—
 পশিবে পরানে তব সুগন্ধ বসন্তপবনে॥

৪২৭ :: অমৃতের সাগরে আমি যাব যাব রে

 অমৃতের সাগরে               আমি যাব যাব রে,
            তৃষ্ণা জ্বলিছে মোর প্রাণে॥
 কোথা পথ বলো হে      বলো, ব্যথার ব্যথী হে—
         কোথা হতে কলধ্বনি আসিছে কানে॥

৪২৮ :: কার মিলন চাও বিরহী

             কার মিলন চাও বিরহী—
 তাঁহারে কোথা খুঁজিছ ভব-অরণ্যে
 কুটিল জটিল গহনে শান্তিসুখহীন ওরে মন॥
 দেখো দেখো রে চিত্তকমলে চরণপদ্ম রাজে—হায়!
 অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর ওরে মন॥

৪২৯ :: তোমা লাগি নাথ জাগি জাগি হে

 তোমা লাগি, নাথ, জাগি জাগি হে—
 সুখ নাই জীবনে তোমা বিনা॥
 সকলে চলে যায় ফেলে চিরশরণ হে—
 তুমি কাছে থাক সুখে দুখে নাথ,
 পাপে তাপে আর কেহ নাহি॥

৪৩০ :: মোরে বারে বারে ফিরালে

              মোরে  বারে বারে ফিরালে।
     পূজাফুল না ফুটিল     দুখনিশা না ছুটিল,
                  না টুটিল আবরণ॥
 জীবন ভরি মাধুরী    কী শুভলগনে জাগিবে?
     নাথ ওহে নাথ,   তবে লবে তনু মন ধন?।

৪৩১ :: কোথা হতে বাজে প্রেমবেদনা রে

 কোথা হতে বাজে প্রেমবেদনা রে!
 ধীরে ধীরে বুঝি অন্ধকারঘন
 হৃদয়-অঙ্গনে আসে সখা মম॥
 সকল দৈন্য তব দূর করো ওরে,
 জাগো সুখে ওরে প্রাণ।
 সকল প্রদীপ তব জ্বালো রে, জ্বালো রে—
 ডাকো আকুল স্বরে ‘এসো হে প্রিয়তম’॥

৪৩২ :: নিকটে দেখিব তোমারে করেছি বাসনা মনে

      নিকটে দেখিব তোমারে করেছি বাসনা মনে।
      চাহিব না হে, চাহিব না হে দূরদূরান্তর গগনে॥
 দেখিব তোমারে গৃহমাঝারে জননীস্নেহে, ভ্রাতৃপ্রেমে,
                   শত সহস্র মঙ্গলবন্ধনে॥
            হেরিব উৎসবমাঝে, মঙ্গলকাজে,
                   প্রতিদিন হেরিব জীবনে।
      হেরিব উজ্জ্বল বিমল মূর্তি তব শোকে দুঃখে মরণে।
 হেরিব সজনে নরনারীমুখে, হেরিব বিজনে বিরলে হে
              গভীর অন্তর-আসনে॥

৪৩৩ :: তোমার দেখা পাব ব’লে এসেছি-যে সখা

 তোমার দেখা পাব ব’লে এসেছি-যে সখা!
 শুন প্রিয়তম হে, কোথা আছ লুকাইয়ে —
 তব গোপন বিজন গৃহে লয়ে যাও॥
 দেহো গো সরায়ে তপন তারকা,
 আবরণ সব দূর করো হে,   মোচন করো তিমির—
 জগত-আড়ালে থেকো না বিরলে,
 লুকায়ো না আপনারি মহিমা-মাঝে—
 তোমার গৃহের দ্বার খুলে দাও॥

৪৩৪ :: ঘোর দুঃখে জাগিনু ঘনঘোরা যামিনী

 ঘোর দুঃখে জাগিনু, ঘনঘোরা যামিনী
 একেলা হায় রে—তোমার আশা হারায়ে॥
 ভোর হল নিশা,   জাগে দশ দিশা—
 আছি দ্বারে দাঁড়ায়ে
 উদয়পথপানে দুই বাহু বাড়ায়ে॥

৪৩৫ :: এ পরবাসে রবে কে হায়

 এ পরবাসে রবে কে হায়!
 কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে॥
 হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে—
 তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে॥

৪৩৬ :: এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ

 এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ—
 এ প্রাণ দীন মলিন, চিত অধীর,
             সব শূন্যময়॥
 চারি দিকে চাহি, পথ নাহি নাহি—
 শান্তি কোথা, কোথা আলয়?
 কোথা তাপহারী পিপাসার বারি—
             হৃদয়ের চির-আশ্রয়॥

৪৩৭ :: ব্যাকুল প্রাণ কোথা সুদূরে ফিরে

 ব্যাকুল প্রাণ কোথা সুদূরে ফিরে—
 ডাকি লহো, প্রভু, তব ভবনমাঝে
       ভবপারে সুধাসিন্ধুতীরে॥

৪৩৮ :: শূন্য প্রাণ কাঁদে সদা প্রাণেশ্বর

 শূন্য প্রাণ কাঁদে সদা, প্রাণেশ্বর,
         দীনবন্ধু, দয়াসিন্ধু,
    প্রেমবিন্দু কাতরে করো দান।
    কোরো না, সখা, কোরো না
         চিরনিষ্ফল এই জীবন।
    প্রভু, জনমে মরণে তুমি গতি,
         চরণে দাও স্থান।

৪৩৯ :: সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে ভ্রমিছ দীনপ্রাণে

           সুখহীন নিশিদিন   পরাধীন হয়ে   ভ্রমিছ দীনপ্রাণে।
           সতত হায় ভাবনা শত শত, নিয়ত ভীত পীড়িত—
                   শির নত কত অপমানে॥
           জানো না রে অধ-ঊধের্ব বাহির-অন্তরে
           ঘেরি তোরে নিত্য রাজে সেই অভয়-আশ্রয়।
           তোলো আনত শির, ত্যজো রে ভয়ভার,
           সতত সরলচিতে চাহো তাঁরি প্রেমমুখপানে॥

৪৪০ :: দূরে কোথায় দূরে দূরে

                     দূরে কোথায় দূরে দূরে
      আমার   মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
 যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে॥
 যে পথ সকল দেশ পারায়ে    উদাস হয়ে যায় হারায়ে
 সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিন পুরে॥

৪৪১ :: পিপাসা হায় নাহি মিটিল নাহি মিটিল

 পিপাসা হায় নাহি মিটিল, নাহি মিটিল।
    গরলরসপানে জরজরপরানে
        মিনতি করি হে করজোড়ে,
 জুড়াও সংসারদাহ তব প্রেমের অমৃতে॥

৪৪২ :: দিন যায় রে দিন যায় বিষাদে

 দিন যায় রে দিন যায় বিষাদে—
 স্বার্থকোলাহলে, ছলনায়, বিফলা বাসনায়॥
 এসেছ ক্ষণতরে, ক্ষণপরে যাইবে চলে,
 জনম কাটে বৃথায় বাদবিবাদের কুমন্ত্রণায়॥

৪৪৩ :: তোমা-হীন কাটে দিবস হে প্রভু

 তোমা-হীন কাটে দিবস হে প্রভু,
 হায় তোমা-হীন মোর স্বপন জাগরণ—
 কবে আসিবে হিয়ামাঝারে?।

৪৪৪ :: বর্ষ গেল বৃথা গেল কিছুই করি নি হায়

       বর্ষ গেল, বৃথা গেল, কিছুই করি নি হায়—
       আপন শূন্যতা লয়ে জীবন বহিয়া যায়॥
 তবু তো আমার কাছে    নব রবি উদিয়াছে,
       তবু তো জীবন ঢালি বহিছে নবীন বায়॥
       বহিছে বিমল ঊষা তোমার আশিসবাণী,
       তোমার করুণাসুধা হৃদয়ে দিতেছে আনি।
 রেখেছ জগতপুরে,     মোরে তো ফেল নি দূরে,
       অসীম আশ্বাসে তাই পুলকে শিহরে কায়॥

৪৪৫ :: কেমনে ফিরিয়া যাও না দেখি তাঁহারে

 কেমনে ফিরিয়া যাও না দেখি তাঁহারে!
    কেমনে জীবন কাটে চির-অন্ধকারে॥
 মহান জগতে থাকি    বিস্ময়বিহীন আঁখি,
    বারেক না দেখ তাঁরে এ বিশ্বমাঝারে॥
 যতনে জাগায়ে জ্যোতি ফিরে কোটি সূর্যলোক,
    তুমি কেন নিভায়েছ আত্মার আলোক?
 তাঁহার আহ্বানরবে     আনন্দে চলিছে সবে,
    তুমি কেন বসে আছ ক্ষুদ্র এ সংসারে॥

৪৪৬ :: কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু

   কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু,—
 জাগাইলে অনুপম সুন্দর শোভা হে হৃদয়েশ্বর॥
 সহসা ফুটিল ফুলমঞ্জরী শুকানো তরুতে,
          পাষাণে বহে সুধাধারা॥

৪৪৭ :: অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে

 অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে।
 অমৃতভবন কোথা আছে তাহা কে জানে॥
 হেরো আপন হৃদয়মাঝে ডুবিয়ে, এ কি শোভা!
         অমৃতময় দেবতা সতত
 বিরাজে এই মন্দিরে, এই সুধানিকেতনে॥

৪৪৮ :: ইচ্ছা যবে হবে লইয়ো পারে

             ইচ্ছা যবে হবে লইয়ো পারে,
         পূজাকুসুমে রচিয়া অঞ্জলি
  আছি ব’সে ভবসিন্ধু-কিনারে॥
         যত দিন রাখ তোমা মুখ চাহি
             ফুল্লমনে রব এ সংসারে॥
         ডাকিবে যখনি তোমার সেবকে
              দ্রুত চলি যাইব ছাড়ি সবারে॥

৪৪৯ :: শুভ্র আসনে বিরাজ’ অরুণছটামাঝে

       শুভ্র আসনে বিরাজ’ অরুণছটামাঝে,
 নীলাম্বরে ধরণী’পরে   কিবা মহিমা তব বিকাশিল॥
               দীপ্ত সূর্য তব মুকুটোপরি,
                    চরণে কোটি তারা মিলাইল,
               আলোকে প্রেমে আনন্দে
                    সকল জগত বিভাসিল॥

৪৫০ :: পেয়েছি অভয়পদ আর ভয় কারে

       পেয়েছি অভয়পদ, আর ভয় কারে—
       আনন্দে চলেছি ভবপারাবারপারে॥
 মধুর শীতল ছায়       শোক তাপ দূরে যায়,
       করুণাকিরণ তাঁর অরুণ বিকাশে।
       জীবনে মরণে আর কভু না ছাড়িব তাঁরে॥

৪৫১ :: শুনেছে তোমার নাম অনাথ আতুর জন

       শুনেছে তোমার নাম অনাথ আতুর জন—
       এসেছে তোমার দ্বারে, শূন্য ফেরে না যেন॥
  কাঁদে যারা নিরাশায়    আঁখি যেন মুছে যায়,
       যেন গো অভয় পায় ত্রাসে-কম্পিত মন॥
  কত শত আছে দীন     অভাগা আলয়হীন,
       শোকে জীর্ণ প্রাণ কত কাঁদিতেছে নিশিদিন।
  পাপে যারা ডুবিয়াছে    যাবে তারা কার কাছে—
       কোথা হায় পথ আছে, দাও তারে দরশন॥

৪৫২ :: সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে

 সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
 তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজ্বালা সেই পাশরে—
                 সব দুখজ্বালা সেই পাশরে॥
 তোমার জ্ঞানে তোমার ধ্যানে তব নামে কত মাধুরী
                 যেই ভকত সেই জানে,
          তুমি জানাও যারে সেই জানে।
 ওহে,   তুমি জানাও যারে সেই জানে॥

৪৫৩ :: চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি

     চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি
                 তুমি হে প্রভু—
 তুমি চিরমঙ্গল সখা হে  তোমার জগতে,
              চিরসঙ্গী চিরজীবনে॥
 চিরপ্রীতিসুধানির্ঝর তুমি হে হৃদয়েশ—
 তব জয়সঙ্গীত ধ্বনিছে  তোমার জগতে
              চিরদিবা চিররজনী॥

৪৫৪ :: বাঁচান বাঁচি মারেন মরি

            বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি—
                বলো ভাই ধন্য হরি॥
 ধন্য হরি ভবের নাটে,   ধন্য হরি রাজ্যপাটে,
 ধন্য হরি শ্মশানঘাটে, ধন্য হরি, ধন্য হরি।
 সুধা দিয়ে মাতান যখন ধন্য হরি, ধন্য হরি।
 ব্যথা দিয়ে কাঁদান যখন ধন্য হরি, ধন্য হরি।
 আত্মজনের কোলে বুকে   ধন্য হরি হাসিমুখে,
 ছাই দিয়ে সব ঘরের সুখে ধন্য হরি, ধন্য হরি॥
 আপনি কাছে আসেন হেসে ধন্য হরি, ধন্য হরি।
 ফিরিয়ে বেড়ান দেশে দেশে ধন্য হরি, ধন্য হরি।
 ধন্য হরি স্থলে জলে,  ধন্য হরি ফুলে ফলে,
 ধন্য হৃদয়পদ্মদলে চরণ-আলোয় ধন্য করি॥

৪৫৫ :: সংসারে কোনো ভয় নাহি নাহি

 সংসারে কোনো ভয় নাহি নাহি—
 ওরে ভয়চঞ্চল প্রাণ, জীবনে মরণে সবে
           রয়েছি তাঁহারি দ্বারে।
 অভয়শঙ্খ বাজে নিখিল অম্বরে সুগম্ভীর,
 দিশি দিশি দিবানিশি সুখে শোকে
           লোক-লোকান্তরে॥

৪৫৬ :: শক্তিরূপ হেরো তাঁর

         শক্তিরূপ হেরো তাঁর,
         আনন্দিত, অতন্দ্রিত,
             ভূর্লোকে ভুবর্লোকে—
         বিশ্বকাজে চিত্তমাঝে
             দিনে রাতে॥
         জাগো রে জাগো জাগো,
             উৎসাহে উল্লাসে—
         পরান বাঁধো রে মরণহরণ
             পরমশক্তি-সাথে॥
         শ্রান্তি আলস বিষাদ
         বিলাস দ্বিধা বিবাদ
             দূর করো রে।
 চলো রে—চলো রে কল্যাণে,
 চলো রে অভয়ে, চলো রে আলোকে,
                  চলো বলে।
 দুখ শোক পরিহরি মিলো রে নিখিলে
                  নিখিলনাথে॥

৪৫৭ :: শ্রান্ত কেন ওহে পান্থ পথপ্রান্তে বসে একি খেলা

      শ্রান্ত কেন ওহে পান্থ, পথপ্রান্তে বসে একি খেলা!
 আজি বহে অমৃতসমীরণ, চলো চলো এইবেলা॥
                    তাঁর দ্বারে হেরো ত্রিভুবন দাঁড়ায়ে,
                    সেথা অনন্ত উৎসব জাগে,
         সকল শোভা গন্ধ সঙ্গীত আনন্দের মেলা॥

৪৫৮ :: গাও বীণা বীণা গাও রে

                     গাও বীণা—বীণা, গাও রে।
          অমৃতমধুর তাঁর প্রেমগান মানব-সবে শুনাও রে।
          মধুর তানে নীরস প্রাণে মধুর প্রেম জাগাও রে॥
 ব্যথা দিয়ো না কাহারে, ব্যথিতের তরে পাষাণ প্রাণ কাঁদাও রে।
 নিরাশেরে কহো আশার কাহিনী, প্রাণে নব বল দাও রে।
 আনন্দময়ের আনন্দ-আলয় নব নব তানে ছাও রে।
 পড়ে থাকো সদা বিভুর চরণে, আপনারে ভুলে যাও রে॥

৪৫৯ :: কে রে ওই ডাকিছে

           কে রে ওই ডাকিছে,
 স্নেহের রব উঠিছে জগতে জগতে—
           তোরা আয় আয় আয় আয়॥
 তাই আনন্দে বিহঙ্গ গান গায়,
           প্রভাতে সে সুধাস্বর প্রচারে।
 বিষাদ তবে কেন, অশ্রু বহে চোখে,
           শোককাতর আকুল কেন আজি॥
 কেন নিরানন্দ, চলো সবে যাই—
           পূর্ণ হবে আশা॥

৪৬০ :: মন্দিরে মম কে আসিলে হে

     মন্দিরে মম কে আসিলে হে!
             সকল গগন অমৃতমগন,
 দিশি দিশি গেল মিশি অমানিশি দূরে দূরে॥
             সকল দুয়ার আপনি খুলিল,
             সকল প্রদীপ আপনি জ্বলিল,
   সব বীণা বাজিল নব নব সুরে সুরে॥

৪৬১ :: একি করুণা করুণাময়

                                    একি করুণা করুণাময়!
             হৃদয়শতদল উঠিল ফুটি অমল কিরণে তব পদতলে॥
 অন্তরে বাহিরে হেরিনু তোমারে লোকে লোকে লোকান্তরে—
                আঁধারে আলোকে সুখে দুখে, হেরিনু হে
                         স্নেহে প্রেমে জগতময় চিত্তময়॥

৪৬২ :: পেয়েছি সন্ধান তব অন্তর্যামী অন্তরে দেখেছি তোমারে॥

 পেয়েছি সন্ধান তব অন্তর্যামী, অন্তরে দেখেছি তোমারে॥
        চকিতে চপল আলোকে, হৃদয়শতদলমাঝে,
                          হেরিনু একি অপরূপ রূপ॥
        কোথা ফিরিতেছিলাম পথে পথে দ্বারে দ্বারে
                          মাতিয়া কলরবে—
        সহসা কোলাহলমাঝে শুনেছি তব আহ্বান,
                          নিভৃতহৃদয়মাঝে
                    মধুর গভীর শান্ত বাণী॥

৪৬৩ :: আমার হৃদয়সমুদ্রতীরে কে তুমি দাঁড়ায়ে

    আমার    হৃদয়সমুদ্রতীরে কে তুমি দাঁড়ায়ে!
                   কাতর পরান ধায় বাহু বাড়ায়ে॥
    হৃদয়ে     উথলে তরঙ্গ চরণপরশের তরে,
    তারা       চরণকিরণ লয়ে কাড়াকাড়ি করে॥
                   মেতেছে হৃদয় আমার, ধৈরজ না মানে—
                   তোমারে ঘেরিতে চায়, নাচে সঘনে॥
    সখা,       ওইখেনেতে থাকো তুমি, যেয়ো না চলে—
    আজি     হৃদয়সাগরের বাঁধ ভাঙি সবলে।
                   কোথা হতে আজি প্রেমের পবন ছুটেছে,
    আমার    হৃদয়ে তরঙ্গ কত নেচে উঠেছে।
                   তুমি দাঁড়াও, তুমি যেয়ো না—
    আমার    হৃদয়ে তরঙ্গ আজি নেচে উঠেছে॥

৪৬৪ :: জননী তোমার করুণ চরণখানি

 জননী, তোমার করুণ চরণখানি
 হেরিনু আজি এ অরুণকিরণরূপে॥
 জননী, তোমার মরণহরণ বাণী
 নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে॥
 তোমারে নমি হে সকল ভুবনমাঝে,
 তোমারে নমি হে সকল জীবনকাজে,
 তনু মন ধন করি নিবেদন আজি
 ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে।
 জননী, তোমার করুণ চরণখানি
 হেরিনু আজি এ অরুণকিরণরূপে॥

৪৬৫ :: তিমিরদুয়ার খোলো এসো এসো নীরবচরণে

 তিমিরদুয়ার খোলো— এসো, এসো নীরবচরণে।
 জননী আমার, দাঁড়াও এই নবীন অরুণকিরণে॥
 পুণ্যপরশপুলকে সব আলস যাক দূরে।
 গগনে বাজুক বীণা জগত-জাগানো সুরে।
 জননী, জীবন জুড়াও তব প্রসাদসুধাসমীরণে।
 জননী আমার, দাঁড়াও মম জ্যোতিবিভাসিত নয়নে॥

৪৬৬ :: তুমি জাগিছ কে

                      তুমি জাগিছ কে?
 তব আঁখিজ্যোতি ভেদ করে সঘন গহন
                      তিমিররাতি॥
 চাহিছ হৃদয়ে অনিমেষ নয়নে,
 সংশয়চপল প্রাণ কম্পিত ত্রাসে॥
 কোথা লুকাব তোমা হতে স্বামী—
 এ কলঙ্কিত জীবন তুমি দেখিছ, জানিছ—
                      প্রভু, ক্ষমা করো হে।
 তব পদপ্রান্তে বসি একান্তে দাও কাঁদিতে আমায়,
                      আর কোথা যাই॥

৪৬৭ :: আজি শুভ শুভ্র প্রাতে কিবা শোভা দেখালে

     আজি শুভ শুভ্র প্রাতে কিবা শোভা দেখালে
              শান্তিলোক জ্যোতির্লোক প্রকাশি।
     নিখিল নীল অম্বর বিদারিয়া দিক‍্‍দিগন্তে
              আবরিয়া রবি শশী তারা
                     পুণ্যমহিমা উঠে বিভাসি॥

৪৬৮ :: ভক্তহৃদিবিকাশ প্রাণবিমোহন

            ভক্তহৃদিবিকাশ প্রাণবিমোহন
  নব নব তব প্রকাশ নিত্য নিত্য চিত্তগগনে হৃদীশ্বর॥
            কভু মোহবিনাশ মহারুদ্রজ্বালা,
            কভু বিরাজ ভয়হর শান্তিসুধাকর॥
            চঞ্চল হর্ষশোকসঙ্কুল কল্লোল ’পরে
            স্থির বিরাজে চিরদিন মঙ্গল তব রূপ।
            প্রেমমূর্তি নিরুপম প্রকাশ করো নাথ হে,
            ধ্যাননয়নে পরিপূর্ণ রূপ তব সুন্দর॥

৪৬৯ :: বাণী তব ধায় অনন্ত গগনে লোকে লোকে

 বাণী তব ধায় অনন্ত গগনে লোকে লোকে,
 তব বাণী গ্রহ চন্দ্র দীপ্ত তপন তারা॥
 সুখ দুখ তব বাণী, জনম মরণ বাণী তোমার,
 নিভৃত গভীর তব বাণী ভক্তহৃদয়ে শান্তিধারা॥

৪৭০ :: প্রথম আদি তব শক্তি

           প্রথম আদি তব শক্তি—
 আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে
           গগনে গগনে॥
 তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ,
 জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে॥
 তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয চন্দ্র তারা,
           প্রাণতরঙ্গ উঠে পবনে।
 তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,
           মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে॥

৪৭১ :: শীতল তব পদছায়া তাপহরণ তব সুধা

 শীতল তব পদছায়া, তাপহরণ তব সুধা,
          অগাধ গভীর তোমার শান্তি,
                  অভয় অশোক তব প্রেমমুখ॥
 অসীম করুণা তব, নব নব তব মাধুরী,
                  অমৃত তোমার বাণী॥

৪৭২ :: হে মহাপ্রবল বলী

                    হে মহাপ্রবল বলী,
       কত অসংখ্য গ্রহ তারা তপন চন্দ্র
                  ধারণ করে তোমার বাহু,
       নরপতি ভূমাপতি হে দেববন্দ্য।
 ধন্য ধন্য তুমি মহেশ,   ধন্য, গাহে সর্ব দেশ—
       স্বর্গে মর্তে বিশ্বলোকে এক ইন্দ্র॥
       অন্ত নাহি জানে মহাকাল মহাকাশ,
                  গীতছন্দে করে প্রদক্ষিণ।
       তব অভয়চরণে শরণাগত দীনহীন,
                  হে রাজা বিশ্ববন্ধু॥

৪৭৩ :: জগতে তুমি রাজা অসীম প্রতাপ

 জগতে তুমি রাজা, অসীম প্রতাপ—
 হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণরূপ॥
 নীলাম্বর জ্যোতিখচিত চরণপ্রান্তে প্রসারিত,
 ফিরে সভয়ে নিয়মপথে অনন্তলোক॥
 নিভৃত হৃদয়মাঝে কিবা প্রসন্ন মুখচ্ছবি
          প্রেমপরিপূর্ণ মধুর ভাতি।
 ভকতহৃদয়ে তব করুণারস সতত বহে,
          দীনজনে সতত করো অভয় দান॥

৪৭৪ :: তুমি ধন্য ধন্য হে ধন্য তব প্রেম

 তুমি ধন্য ধন্য হে, ধন্য তব প্রেম,
       ধন্য তোমার জগতরচনা॥
 একি অমৃতরসে চন্দ্র বিকাশিলে,
       এ সমীরণ পুরিলে প্রাণহিল্লোলে॥
 একি প্রেমে তুমি ফুল ফুটাইলে,
       কুসুমবন ছাইলে শ্যাম পল্লবে॥
 একি গভীর বাণী শিখালে সাগরে,
       কী মধুগীতি তুলিলে নদীকল্লোলে!
 একি ঢালিছ সুধা, মানবহৃদয়ে,
       তাই হৃদয় গাহিছে প্রেম-উল্লাসে॥

৪৭৫ :: তাঁহারে আরতি করে চন্দ্র তপন দেব মানব বন্দে চরণ

 তাঁহারে    আরতি করে চন্দ্র তপন,    দেব মানব বন্দে চরণ—
           আসীন সেই বিশ্বশরণ তাঁর জগতমন্দিরে॥
 অনাদিকাল অনন্তগগন   সেই   অসীম-মহিমা-মগন—
           তাহে তরঙ্গ উঠে সঘন    আনন্দ-নন্দ-নন্দ রে॥
 হাতে লয়ে ছয় ঋতুর ডালি     পায়ে দেয় ধরা কুসুম ঢালি—
           কতই বরন, কতই গন্ধ    কত গীত কত ছন্দ রে॥
 বিহগগীত গগন ছায়—     জলদ গায়, জলধি গায়—
           মহাপবন হরষে ধায়,    গাহে গিরিকন্দরে।
 কত কত শত ভকতপ্রাণ    হেরিছে পুলকে, গাহিছে গান—
           পুণ্য কিরণে ফুটিছে প্রেম,    টুটিছে মোহবন্ধ রে॥

৪৭৬ :: আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর॥

 আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর॥
 মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
 বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে॥
 গ্রহতারক চন্দ্রতপন ব্যাকুল দ্রুত বেগে
 করিছে পান, করিছে স্নান, অক্ষয় কিরণে॥
 ধরণী’পর ঝরে নির্ঝর, মোহন মধু শোভা
 ফুলপল্লব-গীতগন্ধ-সুন্দর-বরনে॥
 বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
 করুণা তব অবিশ্রাম জনমে মরণে॥
 স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,
 কত সান্ত্বন করো বর্ষণ সন্তাপহরণে॥
 জগতে তব কী মহোৎসব, বন্দন করে বিশ্ব
 শ্রীসম্পদ ভূমাস্পদ নির্ভয়শরণে॥

৪৭৭ :: ওই রে তরী দিল খুলে

                    ওই রে তরী দিল খুলে।
                তোর বোঝা কে নেবে তুলে?।
 সামনে যখন যাবি ওরে    থাক্‌-না পিছন পিছে পড়ে—
      পিঠে তারে বইতে গেলি, একলা পড়ে রইলি কূলে॥
 ঘরের বোঝা টেনে টেনে    পারের ঘাটে রাখলি এনে—
      তাই যে তোরে বারে বারে ফিরতে হল, গেলি ভুলে॥
 ডাক্‌ রে আবার মাঝিরে ডাক্‌,    বোঝা তোমার যাক ভেসে যাক—
      জীবনখানি উজাড় করে সঁপে দে তার চরণমূলে॥

৪৭৮ :: আমি কী ব’লে করিব নিবেদন

      আমি       কী ব’লে করিব নিবেদন
                   আমার হৃদয় প্রাণ মন॥
          চিত্তে আসি দয়া করি    নিজে লহো অপহরি,
 করো তারে আপনারি ধন—আমার হৃদয় প্রাণ মন॥
          শুধু ধূলি, শুধু ছাই,    মূল্য যার কিছু নাই,
 মূল্য তারে করো সমর্পণ স্পর্শে তব পরশরতন!
 তোমারি গৌরবে যবে    আমার গৌরব হবে
               সব তবে দিব বিসর্জন—
                     আমার হৃদয় প্রাণ মন॥

৪৭৯ :: সংসার যবে মন কেড়ে লয় জাগে না যখন প্রাণ

       সংসার যবে মন কেড়ে লয়, জাগে না যখন প্রাণ,
       তখনো, হে নাথ, প্রণমি তোমায় গাহি বসে তব গান॥
 অন্তরযামী, ক্ষমো সে আমার    শূন্য মনের বৃথা উপহার—
       পুষ্পবিহীন পূজা-আয়োজন, ভক্তিবিহীন তান॥
       ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে, আশা করি প্রাণপণে—
       নিবিড় প্রেমের সরস বরষা যদি নেমে আসে মনে।
 সহসা একদা আপনা হইতে  ভরি  দিবে তুমি তোমার অমৃতে,
       এই ভরসায় করি পদতলে শূন্য হৃদয় দান॥

৪৮০ :: ওহে জীবনবল্লভ ওহে সাধনদুর্লভ

        ওহে        জীবনবল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ,
        আমি      মর্মের কথা অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব—
        শুধু         জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহো সব।
                       আমি কী আর কব॥
        এই         সংসারপথসঙ্কট অতি কণ্টকময় হে,
        আমি      নীরবে যাব হৃদয়ে লয়ে প্রেমমুরতি তব।
                      আমি কী আর কব॥
                      সুখ দুখ সব তুচ্ছ করিনু প্রিয় অপ্রিয় হে—
        তুমি       নিজ হাতে যাহা সঁপিবে তাহা মাথায় তুলিয়া লব।
                      আমি কী আর কব॥
                      অপরাধ যদি ক’রে থাকি পদে, না করো যদি ক্ষমা,
        তবে      পরানপ্রিয়, দিয়ো হে দিয়ো বেদনা নব নব।
        তবু       ফেলো না দূরে, দিবসশেষে ডেকে নিয়ো চরণে—
                     তুমি ছাড়া আর কী আছে আমার মৃত্যু-আঁধার ভব।
                     আমি কী আর কব॥

৪৮১ :: সবাই যারে সব দিতেছে তার কাছে সব দিয়ে ফেলি

       সবাই যারে সব দিতেছে তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।
       ক’বার আগে চাবার আগে আপনি আমায় দেব মেলি॥
 নেবার বেলা হলেম ঋণী,   ভিড় করেছি, ভয় করি নি—
       এখনো ভয় করব না রে, দেবার খেলা এবার খেলি॥
       প্রভাত তারি সোনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নেচেকুঁদে।
       সন্ধ্যা তারে প্রণাম ক’রে সব সোনা তার দেয় রে শুধে।
 ফোটা ফুলের আনন্দ রে  ঝরা ফুলেই ফলে ধরে—
       আপনাকে, ভাই, ফুরিয়ে-দেওয়া চুকিয়ে দে তুই বেলাবেলি॥

৪৮২ :: আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি

 আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি—
 আমার যত বিত্ত, প্রভু, আমার যত বাণী॥
 আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা,
 আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা—
                       সব দিতে হবে॥
 আমার প্রভাত, আমার সন্ধ্যা হৃদয়পত্রপুটে
 গোপন থেকে তোমার পানে উঠবে ফুটে ফুটে।
 এখন সে যে আমার বীণা, হতেছে তার বাঁধা,
 বাজবে যখন তোমার হবে তোমার সুরে সাধা—
                       সব দিতে হবে॥
 তোমারি আনন্দ আমার দুঃখে সুখে ভ’রে
 আমার ক’রে নিয়ে তবে নাও যে তোমার ক’রে।
 আমার ব’লে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে
 তোমার ক’রে দেব তখন তারা আমার হবে—
                       সব দিতে হবে॥

৪৮৩ :: আমি দীন অতি দীন

                    আমি দীন, অতি দীন—
        কেমনে শুধিব, নাথ হে, তব করুণাঋণ॥
  তব স্নেহ শত ধারে,    ডুবাইছে সংসারে,
        তাপিত হৃদিমাঝে ঝরিছে নিশিদিন॥
  হৃদয়ে যা আছে       দিব তব কাছে,
        তোমারি এ প্রেম দিব তোমারে—
  চিরদিন তব কাজে    রহিব জগতমাঝে,
        জীবন করেছি তোমার চরণতলে লীন॥

৪৮৪ :: কী ভয় অভয়ধামে তুমি মহারাজা ভয় যায় তব নামে

 কী ভয় অভয়ধামে, তুমি মহারাজা—ভয় যায় তব নামে।
              নির্ভয়ে অযুত সহস্র লোক ধায় হে,
              গগনে গগনে সেই অভয়নাম গায় হে॥
              তব বলে কর বলী যারে, কৃপাময়,
              লোকভয় বিপদ মৃত্যুভয় দূর হয় তার।
 আশা বিকাশে, সব বন্ধন ঘুচে, নিত্য অমৃতরস পায় হে॥

৪৮৫ :: আনন্দ রয়েছে জাগি ভুবনে তোমার

 আনন্দ রয়েছে জাগি ভুবনে তোমার
             তুমি সদা নিকটে আছ ব’লে।
 স্তব্ধ অবাক নীলাম্বরে রবি শশী তারা
             গাঁথিছে হে শুভ্র কিরণমালা॥
 বিশ্বপরিবার তোমার ফেরে সুখে আকাশে,
             তোমার ত্রোড় প্রসারিত ব্যোমে ব্যোমে।
 আমি দীন সন্তান আছি সেই তব আশ্রয়ে
             তব স্নেহমুখপানে চাহি চিরদিন॥

৪৮৬ :: সকল ভয়ের ভয় যে তারে কোন্‌ বিপদে কাড়বে

        সকল ভয়ের ভয় যে তারে কোন্‌ বিপদে কাড়বে?
        প্রাণের সঙ্গে যে প্রাণ গাঁথা কোন্‌ কালে সে ছাড়বে॥
 নাহয় গেল সবই ভেসে,     রইবে তো সেই সর্বনেশে,
        যে লাভ সকল ক্ষতির শেষে    সে লাভ কেবল বাড়বে॥
 সুখ নিয়ে, ভাই, ভয়ে থাকি,    আছে আছে দেয় সে ফাঁকি—
        দুঃখে যে সুখ থাকে বাকি কেই বা সে সুখ নাড়বে?
 যে পড়েছে পড়ার শেষে      ঠাঁই পেয়েছে তলায় এসে,
        ভয় মিটেছে, বেঁচেছে সে—তারে কে আর পাড়বে?।

৪৮৭ :: নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে

           নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
           হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে॥
 বাসনার বশে মন অবিরত    ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,
           স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে॥
 সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ,    তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ—
           নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে।
 তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর,   সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার—
           কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে॥
 জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি,   তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
           যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে।
 জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর    লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর—
           তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে॥

৪৮৮ :: দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে

           দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।
           নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে॥
 তোমায় দিতে পূজার ডালি   বেরিয়ে পড়ে সকল কালী,
           পরান আমার পারি নে তাই পায়ে থুতে॥
           এত দিন তো ছিল না মোর কোনো ব্যথা,
           সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল মলিনতা।
 আজ ওই শুভ্র কোলের তরে    ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে—
           দিয়ো না গো দিয়ো না আর ধুলায় শুতে॥

৪৮৯ :: এ মণিহার আমায় নাহি সাজে

                               এ মণিহার আমায় নাহি সাজে—
 এরে    পরতে গেলে লাগে, এরে   ছিঁড়তে গেলে বাজে॥
                          কণ্ঠ যে রোধ করে,   সুর তো নাহি সরে—
             ওই দিকে যে মন পড়ে রয়,   মন লাগে না কাজে॥
                                         তাই তো বসে আছি,
             এ হার তোমায় পরাই যদি তবেই আমি বাঁচি।
                           ফুলমালার ডোরে     বরিয়া লও মোরে—
             তোমার কাছে দেখাই নে মুখ    মণিমালার লাজে॥

৪৯০ :: যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন

               যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
                           সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
               সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে॥
 যখন তোমায় প্রণাম করি আমি    প্রণাম আমার কোন্‌খানে যায় থামি।
               তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে
                         সেথায়    আমার প্রণাম নামে না যে
               সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে॥
                          অহঙ্কার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের
                                       রিক্তভূষণ দীন দরিদ্র সাজে
               সবার পিছে, সবার নিচে, সবহারাদের মাঝে।
 ধনে মানে যেথায় আছে ভরি    সেথায় তোমার সঙ্গ আশা করি,
         সঙ্গী হয়ে আছ যেথায় সঙ্গীহীনের ঘরে
                                       সেথায়    আমার হৃদয় নামে না যে
               সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে॥

৪৯১ :: ওই আসনতলের মাটির ’পরে লুটিয়ে রব

 ওই       আসনতলের মাটির ’পরে লুটিয়ে রব,
             তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব॥
                     কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ?
                     চিরজনম এমন ক’রে ভুলিয়ো নাকো।
                               অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব।
                               তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব॥
             আমি তোমার যাত্রীদলের রব পিছে,
             স্থান দিয়ো হে আমায় তুমি সবার নীচে।
                     প্রসাদ লাগি কতই লোকে আসে ধেয়ে,
                     আমি কিছু চাইব না তো, রইব চেয়ে—
                               সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব।
                               তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব॥

৪৯২ :: আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে

 আমার   মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
                সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
     নিজেরে করিতে গৌরব দান   নিজেরে কেবলই করি অপমান,
               আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।
               সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
               আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,
               তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।
     যাচি হে তোমার চরমশান্তি    পরানে তোমার পরমকান্তি—
              আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে।
              সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥

৪৯৩ :: গরব মম হরেছ প্রভু দিয়েছ বহু লাজ

          গরব মম হরেছ, প্রভু, দিয়েছ বহু লাজ।
          কেমনে মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ॥
 তোমারে আমি পেয়েছি বলি   মনে মনে যে মনেরে ছলি,
          ধরা পড়িনু সংসারেতে করিতে তব কাজ।
          কেমনে মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ॥
 জানি নে, নাথ, আমার ঘরে  ঠাঁই কোথা যে তোমারি তরে—
          নিজেরে তব চরণ’পরে সঁপি নি রাজরাজ!
 তোমারে চেয়ে দিবসযামী    আমারি পানে তাকাই আমি—
          তোমারে চোখে দেখি নে, স্বামী, তব মহিমামাঝ।
          কেমনে মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ॥


৪৯৪ :: ভয় হয় পাছে তব নামে আমি আমারে করি প্রচার হে

               ভয় হয় পাছে তব নামে আমি আমারে করি প্রচার হে।
               মোহবশে পাছে ঘিরে আমায়    তব নামগান-অহঙ্কার হে॥
 তোমার কাছে কিছু নাহি তো লুকানো, অন্তরের কথা তুমি সব জানো—
               আমি কত দীন, আমি কত হীন, কেহ নাহি জানে আর হে॥
 ক্ষুদ্র কণ্ঠে যবে উঠে তব নাম   বিশ্ব শুনে তোমায় করে গো প্রণাম—
               তাই আমার পাছে জাগে অভিমান, গ্রাসে আমায় আঁধার হে,
 পাছে প্রতারণা করি আপনারে   তোমার আসনে বসাই আমারে—
               রাখো মোহ হতে, রাখো তম হতে, রাখো রাখো বারবার হে॥

৪৯৫ :: আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ সংসারকাজে

 আজি   প্রণমি তোমারে চলিব, নাথ, সংসারকাজে।
 তুমি    আমার নয়নে নয়ন রেখো অন্তরমাঝে॥
 হৃদয়দেবতা রয়েছ প্রাণে   মন যেন তাহা নিয়ত জানে,
            পাপের চিন্তা মরে যেন দহি দুঃসহ লাজে॥
 সব কলরবে সারা দিনমান  শুনি অনাদি সঙ্গীতগান,
            সবার সঙ্গে অবিরত তোমার সঙ্গ রাজে।
 নিমেষে নিমেষে নয়নে বচনে,  সকল কর্মে, সকল মননে,
            সকল হৃদয়তন্ত্রে যেন মঙ্গল বাজে॥

৪৯৬ :: যে-কেহ মোরে দিয়েছ সুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়

   যে-কেহ মোরে দিয়েছ সুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়,
                   সবারে আমি নমি।
   যে-কেহ মোরে দিয়েছ দুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়,
                   সবারে আমি নমি॥
   যে-কেহ মোরে বেসেছ ভালো  জ্বেলেছ ঘরে তাঁহারি আলো,
       তাঁহারি মাঝে সবারই আজি পেয়েছি আমি পরিচয়,
                   সবারে আমি নমি॥
   যা-কিছু কাছে এসেছে, আছে, এনেছে তাঁরে প্রাণে,
                   সবারে আমি নমি।
   যা-কিছু দূরে গিয়েছে ছেড়ে টেনেছে তাঁরি পানে,
                   সবারে আমি নমি।
 জানি বা আমি নাহি বা জানি,  মানি বা আমি নাহি বা মানি,
   নয়ন মেলি নিখিলে আমি পেয়েছি তাঁরি পরিচয়,
                   সবারে আমি নমি॥

৪৯৭ :: কে জানিত তুমি ডাকিবে আমারে ছিলাম নিদ্রামগন

       কে জানিত তুমি ডাকিবে আমারে, ছিলাম নিদ্রামগন।
       সংসার মোরে মহামোহঘোরে ছিল সদা ঘিরে সঘন॥
       আপনার হাতে দিবে যে বেদনা, ভাসাবে নয়নজলে,
       কে জানিত হবে আমার এমন শুভদিন শুভলগন॥
       জানি না কখন করুণা-অরুণ উঠিল উদয়াচলে,
       দেখিতে দেখিতে কিরণে পুরিল আমার হৃদয়গগন॥
       তোমার অমৃতসাগর হইতে বন্যা আসিল কবে,
       হৃদয়ে বাহিরে যত বাঁধ ছিল কখন হইল ভগন॥
       সুবাতাস তুমি আপনি দিয়েছ, পরানে দিয়েছ আশা—
       আমার জীবনতরণী হইবে তোমার চরণে মগন॥

৪৯৮ :: জীবনে আমার যত আনন্দ পেয়েছি দিবস-রাত

         জীবনে আমার যত আনন্দ পেয়েছি দিবস-রাত
         সবার মাঝারে আজিকে তোমারে স্মরিব জীবননাথ॥
    যে দিন তোমার জগত নিরখি   হরষে পরান উঠিছে পুলকি
         সে দিন আমার নয়নে হয়েছে তোমারি নয়নপাত॥
         বারে বারে তুমি আপনার হাতে স্বাদে সৌরভে গানে
         বাহির হইতে পরশ করেছ অন্তরমাঝখানে।
    পিতা মাতা ভ্রাতা সব পরিবার,   মিত্র আমার, পুত্র আমার,
                         সকলের সাথে প্রবেশি হৃদয়ে
                                  তুমি আছ মোর সাথ॥

৪৯৯ :: আঁখিজল মুছাইলে জননী

 আঁখিজল মুছাইলে জননী—
 অসীম স্নেহ তব, ধন্য তুমি গো,
            ধন্য ধন্য তব করুণা॥
 অনাথ যে তারে তুমি মুখ তুলে চাহিলে,
 মলিন যে তারে বসাইলে পাশে—
 তোমার দুয়ার হতে কেহ না ফিরে
            যে আসে অমৃতপিয়াসে॥
 দেখেছি আজি তব প্রেমমুখহাসি,
            পেয়েছি চরণচ্ছায়া।
 চাহি-না আর-কিছু—পূরেছে কামনা,
            ঘুচেছে হৃদয়বেদনা॥

৫০০ :: তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে তুমি ধন্য ধন্য হে

       তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে।
       আমার প্রাণ তোমারি দান, তুমি ধন্য ধন্য হে॥
 পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে,  জনম দিয়েছ জননীত্রোড়ে,
       বেঁধেছ সখার প্রণয়ডোরে, তুমি ধন্য ধন্য হে॥
 তোমার বিশাল বিপুল ভুবন   করেছ আমার নয়নলোভন—
       নদী গিরি বন সরসশোভন, তুমি ধন্য ধন্য হে॥
 হৃদয়ে-বাহিরে স্বদেশে-বিদেশে   যুগে-যুগান্তে নিমেষে-নিমেষে
       জনমে-মরণে শোকে-আনন্দে তুমি ধন্য ধন্য হে॥

৫০১ :: হৃদয়ে হৃদয় আসি মিলে যায় যেথা

হৃদয়ে হৃদয় আসি মিলে যায় যেথা,
         হে বন্ধু আমার,
সে পুণ্যতীর্থের যিনি জাগ্রত দেবতা
         তাঁরে নমস্কার॥
বিশ্বলোক নিত্য যাঁর শাশ্বত শাসনে
মরণ উত্তীর্ণ হয় প্রতি ক্ষণে ক্ষণে,
আবর্জনা দূরে যায় জরাজীর্ণতার,
         তাঁরে নমস্কার॥
যুগান্তের বহ্নিস্নানে যুগান্তর দিন
নির্মল করেন যিনি, করেন নবীন,
ক্ষয়েশষে পরিপূর্ণ করেন সংসার,
         তাঁরে নমস্কার।
পথযাত্রী জীবনের দুঃখে সুখে ভরি
অজানা উদ্দেশ-পানে চলে কালতরী,
ক্লান্তি তার দূর করি করিছেন পার,
         তাঁরে নমস্কার॥

৫০২ :: ফুল বলে ধন্য আমি মাটির ’পরে

ফুল বলে, ধন্য আমি মাটির ’পরে,
  দেবতা ওগো, তোমার সেবা আমার ঘরে॥
জন্ম নিয়েছি ধূলিতে  দয়া করে দাও ভুলিতে,
      নাই ধূলি মোর অন্তরে॥
  নয়ন তোমার নত করো,
      দলগুলি কাঁপে থরোথরো।
চরণপরশ দিয়ো দিয়ো,  ধূলির ধনকে করো স্বর্গীয়—
     ধরার প্রণাম আমি   তোমার তরে॥

৫০৩ :: নমি নমি চরণে

নমি নমি চরণে,
    নমি কলুষহরণে॥
সুধারসনির্ঝর হে,
    নমি নমি চরণে।
নমি চিরনির্ভর হে
    মোহগহনতরণে॥
নমি চিরমঙ্গল হে,
নমি চিরসম্বল হে।
উদিল তপন, গেল রাত্রি,
    নমি নমি চরণে।
জাগিল অমৃতপথযাত্রী—
  নমি চিরপথসঙ্গী,
    নমি নিখিলশরণে॥
নমি সুখে দুঃখে ভয়ে,
নমি জয়পরাজয়ে।
অসীম বিশ্বতলে
    নমি নমি চরণে।
নমি চিতকমলদলে
  নিবিড় নিভৃত নিলয়ে,
    নমি জীবনে মরণে॥

৫০৪ :: একটি নমস্কারে প্রভু একটি নমস্কারে

      একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
      সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে॥
  ঘন শ্রাবণমেঘের মতো   রসের ভারে নম্র নত
      একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
      সমস্ত মন পড়িয়া থাক্‌ তব ভবনদ্বারে॥
  নানা সুরের আকুল ধারা   মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা
      একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
      সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে।
  হংস যেমন মানসযাত্রী   তেমনি সারা দিবসরাত্রি
      একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
      সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে॥

৫০৫ :: তোমারি নামে নয়ন মেলিনু পুণ্যপ্রভাতে আজি

তোমারি নামে নয়ন মেলিনু পুণ্যপ্রভাতে আজি,
তোমারি নামে খুলিল হৃদয়শতদলদলরাজি॥
তোমারি নামে নিবিড় তিমিরে ফুটিল কনকলেখা,
তোমারি নামে উঠিল গগনে কিরণবীণা বাজি।
তোমারি নামে পূর্বতোরণে খুলিল সিংহদ্বার,
বাহিরিল রবি নবীন আলোকে দীপ্ত মুকুট মাজি।
তোমারি নামে জীবনসাগরে জাগিল লহরীলীলা,
তোমারি নামে নিখিল ভুবন বাহিরে আসিল সাজি॥

৫০৬ :: অনিমেষ আঁখি সেই কে দেখেছে

  অনিমেষ আঁখি সেই কে দেখেছে
  যে আঁখি জগতপানে চেয়ে রয়েছে॥
রবি শশী গ্রহ তারা    হয় নাকো দিশাহারা,
  সেই আঁখি ’পরে তারা আঁখি রেখেছে॥
  তরাসে আঁধারে কেন কাঁদিয়া বেড়াই,
  হৃদয়-আকাশ-পানে কেন না তাকাই?
ধ্রুবজ্যোতি সে নয়ন  জাগে সেথা অনুক্ষণ,
  সংসারের মেঘে বুঝি দৃষ্টি ঢেকেছে॥

৫০৭ :: মম অঙ্গনে স্বামী আনন্দে হাসে

মম অঙ্গনে স্বামী আনন্দে হাসে,
সুগন্ধ ভাসে আনন্দ-রাতে॥
  খুলে দাও দুয়ার সব,
  সবারে ডাকো ডাকো,
নাহি রেখো কোথাও কোনো বাধা—
অহো, আজি সঙ্গীতে মন প্রাণ মাতে॥

৫০৮ :: আজি মম জীবনে নামিছে ধীরে

আজি মম জীবনে নামিছে ধীরে
ঘন রজনী নীরবে নিবিড়গম্ভীরে॥
জাগো আজি জাগো, জাগো রে তাঁরে লয়ে
   প্রেমঘন হৃদয়মন্দিরে॥

৫০৯ :: কেমনে রাখিবি তোরা তাঁরে লুকায়ে

কেমনে রাখিবি তোরা তাঁরে লুকায়ে
চন্দ্রমা তপন তারা আপন আলোকছায়ে॥
হে বিপুল সংসার, সুখে দুখে আঁধার,
কত কাল রাখিবি ঢাকি তাঁহারে কুহেলিকায়।
আত্মা-বিহারী তিনি, হৃদয়ে উদয় তাঁর—
নব নব মহিমা জাগে, নব নব কিরণ ভায়॥

৫১০ :: হে নিখিলভারধারণ বিশ্ববিধাতা

হে নিখিলভারধারণ বিশ্ববিধাতা,
হে বলদাতা মহাকালরথসারথি॥
তব নামজপমালা গাঁথে রবি শশী তারা,
অনন্ত দেশ কাল জপে দিবারাতি॥

৫১১ :: দেবাধিদেব মহাদেব

দেবাধিদেব মহাদেব!
অসীম সম্পদ, অসীম মহিমা॥
মহাসভা তব অনন্ত আকাশে।
কোটি কণ্ঠ গাহে জয় জয় জয় হে॥

৫১২ :: দিন ফুরালো হে সংসারী

            দিন ফুরালো হে সংসারী,
 ডাকো তাঁরে ডাকো যিনি শ্রান্তিহারী॥
             ভোলো সব ভবভাবনা,
          হৃদয়ে লহো হে শান্তিবারি॥

৫১৩ :: জরজর প্রাণে নাথ বরিষন করো তব প্রেমসুধা

জরজর প্রাণে, নাথ, বরিষন করো তব প্রেমসুধা—
           নিবারো এ হৃদয়দহন॥
করো হে মোচন করো সব পাপমোহ,
           দূর করো বিষয়বাসনা॥

৫১৪ :: কোথায় তুমি আমি কোথায়

কোথায় তুমি, আমি কোথায়,
জীবন কোন্‌ পথে চলিছে নাহি জানি॥
নিশিদিন হেনভাবে আর কতকাল যাবে—
দীননাথ, পদতলে লহো টানি॥

৫১৫ :: সকল গর্ব দূর করি দিব

সকল গর্ব দূর করি দিব,
      তোমার গর্ব ছাড়িব না।
সবারে ডাকিয়া কহিব যে দিন
      পাব তব পদরেণুকণা॥
তব আহ্বান আসিবে যখন
      সে কথা কেমনে করিব গোপন॥
সকল বাক্যে সকল কর্মে
      প্রকাশিবে তব আরাধনা॥
যত মান আমি পেয়েছি যে কাজে
      সে দিন সকলই যাবে দূরে,
শুধু তব মান দেহে মনে মোর
      বাজিয়া উঠিবে এক সুরে।
পথের পথিক সেও দেখে যাবে
তোমার বারতা মোর মুখভাবে
ভবসংসারবাতায়নতলে
       বসে রব যবে আনমনা॥

৫১৬ :: এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর

              এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর!
পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর  সুন্দর হে সুন্দর॥
  আলোকে মোর চক্ষুদুটি     মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি,
হৃদ্‌গগনে পবন হল সৌরভেতে মন্থর   সুন্দর হে সুন্দর॥
              এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত,
              এই তোমারি মিলনসুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত।
  তোমার মাঝে এমনি ক’রে  নবীন করি লও যে মোরে
এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম-জনমান্তর   সুন্দর হে সুন্দর॥

৫১৭ :: সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত

        সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি  তারায় তারায় খচিত—
           স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি,  বর্ণে বর্ণে রচিত॥
 খড়্গ তোমার আরো মনোহর লাগে  বাঁকা বিদ্যুতে আঁকা সে
 গরুড়ের পাখা রক্ত রবির রাগে  যেন গো অস্ত-আকাশে॥
    জীবনশেষের শেষজাগরণসম   ঝলসিছে মহাবেদনা—
    নিমেষে দহিয়া যাহা-কিছু আছে মম   তীব্র ভীষণ চেতনা।
      সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি   তারায় তারায় খচিত—
 খড়্গ তোমার, হে দেব বজ্রপাণি,    চরম শোভায় রচিত॥

৫১৮ :: আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো

আলো যে আজ গান করে মোর  প্রাণে গো।
    কে এল মোর অঙ্গনে কে জানে গো॥
হৃদয় আমার উদাস করে  কেড়ে নিল আকাশ মোরে,
  বাতাস আমায় আনন্দবাণ হানে গো॥
      দিগন্তের ওই নীল নয়নের ছায়াতে
          কুসুম যেন বিকাশে মোর কায়াতে।
মোর হৃদয়ের সুগন্ধ যে  বাহির হল কাহার খোঁজে,
    সকল জীবন চাহে কাহার পানে গো॥

৫১৯ :: মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দরবেশে এসেছ

মোর    সন্ধ্যায় তুমি সুন্দরবেশে এসেছ,
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
মোর    অন্ধকারের অন্তরে তুমি হেসেছ,
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
এই     নম্র নীরব সৌম্য গভীর আকাশে
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
এই     শান্ত সুধীর তন্দ্রানিবিড় বাতাসে
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
এই     ক্লান্ত ধরার শ্যামলাঞ্চল-আসনে
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
এই     স্তব্ধ তারার মৌনমন্ত্রভাষণে
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
এই     কর্ম-অন্তে নিভৃত পান্থশালাতে
  তোমায়   করি গো নমস্কার।
এই     গন্ধগহন-সন্ধ্যাকুসুম-মালাতে
  তোমায়   করি গো নমস্কার॥

৫২০ :: এই তো তোমার আলোকধেনু সূর্য তারা দলে দলে

এই তো তোমার আলোকধেনু সূর্য তারা দলে দলে—
কোথায় ব’সে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে॥
   তৃণের সারি তুলছে মাথা,  তরুর শাখে শ্যামল পাতা—
   আলোয়-চরা ধেনু এরা ভিড় করেছে ফুলে ফলে॥
   সকালবেলা দূরে দূরে উড়িয়ে ধূলি কোথায় ছোটে,
   আঁধার হলে সাঁঝের সুরে ফিরিয়ে আনে আপন গোঠে।
   আশা তৃষা আমার যত   ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত—
মোর জীবনের রাখাল ওগো,  ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে?।

৫২১ :: যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

যদি         প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন        ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?।
কেন        তারার মালা গাঁথা,
কেন        ফুলের শয়ন পাতা,
কেন        দখিন-হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?।
যদি         প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন        আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে?
তবে        ক্ষণে ক্ষণে কেন
আমার    হৃদয় পাগল-হেন
তরী        সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?।

৫২২ :: মহারাজ একি সাজে এলে হৃদয়পুরমাঝে

      মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুরমাঝে!
      চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে॥
 গর্ব  সব টুটিয়া  মূর্ছি পড়ে লুটিয়া,
 সকল মম দেহ মন বীণাসম বাজে॥
    একি পুলকবেদনা বহিছে মধুবায়ে!
    কাননে যত পুষ্প ছিল মিলিল তব পায়ে।
         পলক নাহি নয়নে,  হেরি না কিছু ভুবনে—
         নিরখি শুধু অন্তরে সুন্দর বিরাজে॥

৫২৩ :: হৃদয়শশী হৃদিগগনে উদিল মঙ্গললগনে

       হৃদয়শশী হৃদিগগনে  উদিল মঙ্গললগনে,
       নিখিল সুন্দর ভুবনে   একি এ মহামধুরিমা॥
 ডুবিল কোথা দুখ সুখ রে   অপার শান্তির সাগরে,
       বাহিরে অন্তরে জাগে রে শুধুই সুধাপুরনিমা॥
 গভীর সঙ্গীত দ্যুলোকে   ধ্বনিছে গম্ভীর পুলকে,
       গগন-অঙ্গন-আলোকে উদার দীপদীপ্তিমা।
 চিত্তমাঝে কোন্‌ যন্ত্রে     কী গান মধুময় মন্ত্রে
       বাজে রে অপরূপ তন্ত্রে, প্রেমের কোথা পরিসীমা॥

৫২৪ :: আমারে দিই তোমার হাতে

                আমারে দিই তোমার হাতে
                   নূতন ক’রে নূতন প্রাতে॥
 দিনে দিনেই ফুল যে ফোটে,    তেমনি করেই ফুটে ওঠে
               জীবন তোমার আঙিনাতে
                   নূতন ক’রে নূতন প্রাতে॥
               বিচ্ছেদেরই ছন্দে লয়ে
                   মিলন ওঠে নবীন হয়ে।
 আলো-অন্ধকারের তীরে   হারায়ে পাই ফিরে ফিরে,
              দেখা আমার তোমার সাথে
                   নূতন ক’রে নূতন প্রাতে॥

৫২৫ :: কে গো অন্তরতর সে

                    কে গো অন্তরতর সে!
       আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে॥
 আঁখিতে আমার বুলায় মন্ত্র,    বাজায় হৃদয়বীণার তন্ত্র,
         কত আনন্দে জাগায় ছন্দ কত সুখে দুখে হরষে॥
 সোনালি রুপালি সবুজে সুনীলে    সে এমন মায়া কেমনে গাঁথিলে—
         তারি সে আড়ালে চরণ বাড়ালে, ডুবালে সে সুধাসরসে।
 কত দিন আসে, কত যুগ যায়,    গোপনে গোপনে পরান ভুলায়,
     নানা পরিচয়ে নানা নাম ল’য়ে নিতি নিতি রস বরষে॥

৫২৬ :: এই-যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ

 এই-যে তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ,
            এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন॥
 এই-যে মধুর আলসভরে  মেঘ ভেসে যায় আকাশ ’পরে,
            এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ॥
 প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে।
      এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে।
            তোমারি ওই মুখ নুয়েছে,  মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
               আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ॥

৫২৭ :: তোমারি মধুর রূপে ভরেছ ভুবন

          তোমারি মধুর রূপে ভরেছ ভুবন—
          মুগ্ধ নয়ন মম, পুলকিত মোহিত মন॥
 তরুণ অরুণ নবীনভাতি,      পূর্ণিমাপ্রসন্ন রাতি,
          রূপরাশি-বিকশিত-তনু কুসুমবন॥
          তোমা-পানে চাহি সকলে সুন্দর,
          রূপ হেরি আকুল অন্তর।
 তোমারে ঘেরিয়া ফিরে নিরন্তর তোমার প্রেম চাহি।
 উঠে সঙ্গীত তোমার পানে,    গগন পূর্ণ প্রেমগানে,
          তোমার চরণ করেছে বরণ নিখিলজন॥

৫২৮ :: লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি

               লহো লহো, তুলে লহো নীরব বীণাখানি।
 তোমার  নন্দননিকুঞ্জ হতে সুর দেহো তায় আনি
                 ওহে     সুন্দর হে সুন্দর॥
 আমি   আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে
                         তোমারি আশ্বাসে।
           তারায় তারায় জাগাও তোমার আলোক-ভরা বাণী
                 ওহে   সুন্দর হে সুন্দর॥
           পাষাণ আমার কঠিন দুখে তোমায় কেঁদে বলে,
           ’পরশ দিয়ে সরস করো, ভাসাও অশ্রুজলে,
                ওহে  সুন্দর হে সুন্দর।’
            শুষ্ক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে
                  আমার চিত্তমাঝে,
            শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহো টানি
                ওহে   সুন্দর হে সুন্দর॥

৫২৯ :: ডাকিল মোরে জাগার সাথি

                   ডাকিল মোরে জাগার সাথি।
 প্রাণের মাঝে বিভাস বাজে,  প্রভাত হল আঁধার রাতি॥
 বাজায় বাঁশি তন্দ্রা-ভাঙা,   ছড়ায় তারি বসন রাঙা—
       ফুলের বাসে এই বাতাসে   কী মায়াখানি দিয়েছে গাঁথি॥
       গোপনতম অন্তরে কী   লেখনরেখা দিয়েছে লেখি!
 মন তো তারি নাম জানে না,  রূপ আজিও নয় যে চেনা,
       বেদনা মম বিছায়ে দিয়ে    রেখেছি তারি আসন পাতি॥

৫৩০ :: ওহে সুন্দর মরি মরি

 ওহে        সুন্দর, মরি মরি,
 তোমায়   কী দিয়ে বরণ করি॥
 তব         ফাল্গুন যেন আসে
 আজি     মোর পরানের পাশে,
 দেয়        সুধারসধারে-ধারে
 মম         অঞ্জলি ভরি ভরি॥
 মধু         সমীর দিগঞ্চলে
 আনে     পুলকপূজাঞ্জলি—
 মম         হৃদয়ের পথতলে
 যেন        চঞ্চল আসে চলি।
 মম         মনের বনের শাখে
 যেন        নিখিল কোকিল ডাকে,
 যেন        মঞ্জরীদীপশিখা
 নীল        অম্বরে রাখে ধরি॥

৫৩১ :: তোমায় চেয়ে আছি বসে পথের ধারে সুন্দর হে

         তোমায় চেয়ে আছি বসে পথের ধারে সুন্দর হে।
         জমল ধুলা প্রাণের বীণার তারে তারে সুন্দর হে॥
 নাই যে কুসুম, মালা গাঁথব কিসে!  কান্নার গান বীণায় এনেছি যে,
         দূর হতে তাই শুনতে পাবে অন্ধকারে সুন্দর হে॥
         দিনের পরে দিন কেটে যায় সুন্দর হে।
         মরে হৃদয় কোন্‌ পিপাসায় সুন্দর হে।
 শূন্য ঘাটে আমি কী-যে করি—  রঙিন পালে কবে আসবে তরী,
         পাড়ি দেব কবে সুধারসের পারাবারে সুন্দর হে॥

৫৩২ :: তুমি সুন্দর যৌবনঘন রসময় তব মূর্তি

 তুমি সুন্দর, যৌবনঘন রসময় তব মূর্তি,
 দৈন্যভরণ বৈভব তব অপচয়পরিপূর্তি॥
 নৃত্য গীত কাব্যছন্দ  কলগুঞ্জন বর্ণ গন্ধ—
 মরণহীন চিরনবীন তব মহিমাস্ফুর্তি॥

৫৩৩ :: ওই মরণের সাগরপারে চুপে চুপে

           ওই মরণের সাগরপারে চুপে চুপে
           এলে তুমি ভুবনমোহন স্বপনরূপে॥
             কান্না আমার সারা প্রহর তোমায় ডেকে
             ঘুরেছিল চারি দিকের বাধায় ঠেকে,
               বন্ধ ছিলেম এই জীবনের অন্ধকূপে—
               আজ এসেছ ভুবনমোহন স্বপনরূপে॥
          আজ কী দেখি কালো চুলের আঁধার ঢালা,
 তারি  স্তরে স্তরে সন্ধ্যাতারার মানিক জ্বালা।
             আকাশ আজি গানের ব্যথায় ভরে আছে,
             ঝিল্লিরবে কাঁপে তোমার পায়ের কাছে,
                বন্দনা তোর পুষ্পবনের গন্ধধূপে—
                আজ এসেছ ভুবনমোহন স্বপনরূপে॥

৫৩৪ :: ওগো সুন্দর একদা কী জানি কোন্‌ পুণ্যের ফলে

 ওগো সুন্দর, একদা কী জানি কোন্‌ পুণ্যের ফলে
 আমি বনফুল তোমার মালায় ছিলাম তোমার গলে॥
          তখন প্রভাতে প্রথম তরুণ আলো
          ঘুম-ভাঙা চোখে ধরার লেগেছে ভালো,
 বিভাসে ললিতে নবীনের বীণা বেজেছে জলে স্থলে॥
          আজি এ ক্লান্ত দিবসের অবসানে
          লুপ্ত আলোয়, পাখির সুপ্ত গানে,
 শ্রান্তি-আবেশে যদি অবশেষে ঝরে ফুল ধরাতলে—
          সন্ধ্যাবাতাসে অন্ধকারের পারে
          পিছে পিছে তব উড়ায়ে চলুক তারে,
 ধুলায় ধুলায় দীর্ণ জীর্ণ না হোক সে পলে পলে॥

৫৩৫ :: রুদ্রবেশে কেমন খেলা কালো মেঘের ভ্রূকুটি

           রুদ্রবেশে কেমন খেলা, কালো মেঘের ভ্রূকুটি!
           সন্ধ্যাকাশের বক্ষ যে ওই বজ্রবাণে যায় টুটি॥
 সুন্দর হে, তোমায় চেয়ে   ফুল ছিল সব শাখা ছেয়ে,
           ঝড়ের বেগে আঘাত লেগে ধুলায় তারা যায় লুটি॥
           মিলনদিনে হঠাৎ কেন লুকাও তোমার মাধুরী!
           ভীরুকে ভয় দেখাতে চাও, একি দারুণ চাতুরী!
 যদি তোমার কঠিন ঘায়ে   বাঁধন দিতে চাও ঘুচায়ে
           কঠোর বলে টেনে নিয়ে বক্ষে তোমার দাও ছুটি॥

৫৩৬ :: জাগে নাথ জোছনারাতে

             জাগে নাথ জোছনারাতে—
                  জাগো, রে অন্তর, জাগো॥
             তাঁহারি পানে চাহো মুগ্ধপ্রাণে
                  নিমেষহারা আঁখিপাতে॥
 নীরব চন্দ্রমা নীরব তারা,    নীরব গীতরসে হল হারা—
             জাগে বসুন্ধরা, অম্বর জাগে রে—
                  জাগে রে সুন্দর সাথে॥

৫৩৭ :: সুন্দর বহে আনন্দমন্দানিল

         সুন্দর বহে আনন্দমন্দানিল,
         সমুদিত প্রেমচন্দ্র, অন্তর পুলকাকুল॥
 কুঞ্জে কুঞ্জে জাগিছে বসন্ত পুণ্যগন্ধ,
 শূন্যে বাজিছে রে অনাদি বীণাধ্বনি॥
         অচল বিরাজ করে
 শশীতারামণ্ডিত সুমহান সিংহাসনে ত্রিভুবনেশ্বর॥
         পদতলে বিশ্বলোক রোমাঞ্চিত,
         জয় জয় গীত গাহে সুরনর॥

৫৩৮ :: চিরদিবস নব মাধুরী নব শোভা তব বিশ্বে

 চিরদিবস নব মাধুরী, নব শোভা তব বিশ্বে—
 নব কুসুমপল্লব, নব গীত, নব আনন্দ॥
 নব জ্যোতি বিভাসিত, নব প্রাণ বিকাশিত
        নবপ্রীতিপ্রবাহহিল্লোলে॥
 চারিদিকে চিরদিন নবীন লাবণ্য,
             তব প্রেমনয়নছটা।
 হৃদয়স্বামী, তুমি চিরপ্রবীণ,
 তুমি চিরনবীন, চিরমঙ্গল, চিরসুন্দর॥

৫৩৯ :: একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে

 একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,
     আনন্দবসন্তসমাগমে॥
 বিকশিত প্রীতিকুসুম হে
     পুলকিত চিতকাননে॥
 জীবনলতা অবনতা তব চরণে।
         হরষগীত উচ্ছসিত হে
              কিরণমগন গগনে॥

৫৪০ :: আজি হেরি সংসার অমৃতময়

                  আজি হেরি সংসার অমৃতময়।
                     মধুর পবন, বিমল কিরণ, ফুল্ল বন,
                         মধুর বিহগকলধ্বনি॥
 কোথা হতে বহিল সহসা প্রাণভরা প্রেমহিল্লোল, আহা—
              হৃদয়কুসুম উঠিল ফুটি পুলকভরে॥
 অতি আশ্চর্য দেখো সবে, দীনহীন ক্ষুদ্র হৃদয়মাঝে
     অসীম জগতস্বামী বিরাজে সুন্দর শোভন!
          ধন্য এই মানবজীবন, ধন্য বিশ্বজগত,
                ধন্য তাঁর প্রেম, তিনি ধন্য ধন্য॥

৫৪১ :: প্রভাতে বিমল আনন্দে বিকশিত কুসুমগন্ধে

 প্রভাতে বিমল আনন্দে বিকশিত কুসুমগন্ধে
 বিহঙ্গমগীতছন্দে তোমার আভাস পাই॥
 জাগে বিশ্ব তব ভবনে প্রতিদিন নব জীবনে,
              অগাধ শূন্য পূরে কিরণে,
              খচিত নিখিল বিচিত্র বরনে—
 বিরল আসনে বসি তুমি সব দেখিছ চাহি॥
 চারি দিকে করে খেলা বরন-কিরণ-জীবন-মেলা,
              কোথা তুমি অন্তরালে!
 অন্ত কোথায়, অন্ত কোথায়— অন্ত তোমার নাহি নাহি॥

৫৪২ :: এ কী সুগন্ধহিল্লোল বহিল

            এ কী সুগন্ধহিল্লোল বহিল
 আজি প্রভাতে, জগত মাতিল তায়॥
হৃদয়মধুকর ধাইছে দিশি দিশি পাগলপ্রায়॥
বরন-বরন পুষ্পরাজি   হৃদয় খুলিয়াছে আজি,
       সেই সুরভিসুধা করিছে পান
   পূরিয়া প্রাণ, সে সুধা করিছে দান—
       সে সুধা অনিলে উথলি যায়॥

৫৪৩ :: একি এ সুন্দর শোভা কী মুখ হেরি এ

 একি এ সুন্দর শোভা!   কী মুখ হেরি এ!
 আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ,
 প্রেম-উৎস উথলিল আজি॥
 বলো হে প্রেমময় হৃদয়ের স্বামী,
 কী ধন তোমারে দিব উপহার।
 হৃদয় প্রাণ লহো লহো তুমি, কী বলিব—
 যাহা-কিছু আছে মম সকলই লও হে নাথ॥

৫৪৪ :: মধুর রূপে বিরাজ হে বিশ্বরাজ

 মধুর রূপে বিরাজ হে বিশ্বরাজ,
 শোভন সভা নিরখি মন প্রাণ ভুলে॥
 নীরব নিশি সুন্দর, বিমল নীলাম্বর,
 শুচিরুচির চন্দ্রকলা চরণমূলে॥

৫৪৫ :: রহি রহি আনন্দতরঙ্গ জাগে

 রহি রহি আনন্দতরঙ্গ জাগে—
 রহি রহি, প্রভু, তব পরশমাধুরী
 হৃদয়মাঝে আসি লাগে।
 রহি রহি শুনি তব চরণপাত হে
 মম পথের আগে আগে।
 রহি রহি মম মনোগগন ভাতিল
 তব প্রসাদরবিরাগে॥

৫৪৬ :: আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে

 আমি    কান পেতে রই    ও আমার   আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে
 কোন্‌    গোপনবাসীর কান্নাহাসির   গোপন কথা শুনিবারে— বারে বারে॥
             ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী    নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
 কোন্‌    রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে   বারে বারে॥
             কে সে মোর   কেই বা জানে,   কিছু তার    দেখি আভা।
             কিছু পাই    অনুমানে,   কিছু তার   বুঝি না বা।
             মাঝে মাঝে তার বারতা   আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,
 ও সে    আমায় জানি পাঠায় বাণী    গানের তানে লুকিয়ে তারে   বারে বারে॥

৫৪৭ :: আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে

 আমি        তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে।
 সে            আছে ব’লে
 আমার      আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে,
 প্রাতে        ফুল ফুটে রয় বনে আমার বনে॥
 সে            আছে ব’লে চোখের তারার আলোয়
 এত          রূপের খেলা রঙের মেলা অসীম সাদায় কালোয়।
 সে মোর    সঙ্গে থাকে ব’লে
 আমার     অঙ্গে অঙ্গে হরষ জাগায় দখিন-সমীরণে॥
                 তারি বাণী হঠাৎ উঠে পূরে
                 আন্‌মনা কোন্‌ তানের মাঝে আমার গানের সুরে।
                 দুখের দোলে হঠাৎ মোরে দোলায়,
                 কাজের মাঝে লুকিয়ে থেকে আমারে কাজ ভোলায়।
 সে মোর    চিরদিনের ব’লে
 তারি         পুলকে মোর পলকগুলি ভরে ক্ষণে ক্ষণে॥

৫৪৮ :: সে যে মনের মানুষ কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে

 সে যে     মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে?
               ডাক্‌-না রে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়নধারে॥
 যখন      নিভবে আলো, আসবে রাতি,   হৃদয়ে দিস আসন পাতি—
               আসবে সে যে সঙ্গোপনে বিচ্ছেদেরই অন্ধকারে॥
                       তার     আসা-যাওয়ার গোপন পথে
                       সে       আসবে যাবে আপন মতে।
 তারে       বাঁধবে ব’লে যেই করো পণ    সে থাকে না, থাকে বাঁধন—
               সেই বাঁধনে মনে মনে বাঁধিস কেবল আপনারে॥

৫৪৯ :: আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

 আমার         প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
                    তাই হেরি তায় সকল খানে॥
 আছে সে     নয়নতারায়  আলোক-ধারায়,  তাই না হারায়—
 ওগো           তাই দেখি তায়   যেথায় সেথায়
                    তাকাই আমি যে দিক-পানে॥
 আমি তার    মুখের কথা     শুনব ব’লে   গেলাম কোথা,
                    শোনা     হল না, হল না—
 আজ           ফিরে এসে   নিজের দেশে   এই-যে শুনি
 শুনি             তাহার বাণী আপন গানে॥
 কে তোরা     খুঁজিস তারে   কাঙাল বেশে   দ্বারে দ্বারে,
                    দেখা   মেলে না,  মেলে না—
 তোরা           আয় রে ধেয়ে,   দেখ্‌ রে চেয়ে   আমার বুকে—
 ওরে             দেখ্‌ রে আমার দুই নয়ানে॥

৫৫০ :: আমার মন যখন জাগলি না রে

 আমার          মন, যখন জাগলি না রে
 ও তোর         মনের মানুষ এল দ্বারে।
 তার              চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ভাঙল রে ঘুম—
 ও তোর         ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে॥
 মাটির  ’পরে আঁচল পাতি   একলা কাটে নিশীথরাতি।
 তার     বাঁশি বাজে আঁধার-মাঝে,  দেখি না যে চক্ষে তারে॥
 ওরে,   তুই যাহারে দিলি ফাঁকি    খুঁজে তারে পায় কি আঁখি?
 এখন  পথে ফিরে পাবি কি রে    ঘরের বাহির করলি যারে॥

৫৫১ :: আমি তারেই জানি তারেই জানি আমায় যে জন আপন জানে

 আমি   তারেই জানি তারেই জানি আমায় যে জন আপন জানে—
            তারি দানে দাবি আমার যার অধিকার আমার দানে॥
            যে আমারে চিনতে পারে   সেই চেনাতে চিনি তারে গো—
            একই আলো চেনার পথে   তার প্রাণে আর আমার প্রাণে॥
                        আপন মনের অন্ধকারে ঢাকল যারা
                        আমি    তাদের মধ্যে আপনহারা।
            ছুঁইয়ে দিল সোনার কাঠি,   ঘুমের ঢাকা গেল কাটি গো—
            নয়ন আমার ছুটেছে তার   আলো-করা মুখের পানে॥

৫৫২ :: জানি জানি তোমার প্রেমে সকল প্রেমের বাণী মেশে

 জানি জানি   তোমার প্রেমে সকল প্রেমের বাণী মেশে,
 আমি       সেইখানেতেই মুক্তি খুঁজি দিনের শেষে॥
 সেথায় প্রেমের চরম সাধন,  যায় খসে তার সকল বাঁধন—
 মোর         হৃদয়পাখির গগন তোমার হৃদয়দেশে॥
 ওগো,       জানি আমার শ্রান্ত দিনের সকল ধারা
 তোমার     গভীর রাতের শান্তিমাঝে ক্লান্তিহারা।
 আমার     দেহে ধরার পরশ   তোমার সুধায় হল সরস—
 আমার     ধুলারই ধন তোমার মাঝে নূতন বেশে॥

৫৫৩ :: তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি

 তোমার         খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে    টুকরো করে কাছি
 আমি        ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি॥
 সকাল আমার গেল মিছে,   বিকেল যে যায় তারি পিছে গো—
             রেখো না আর, বেঁধো না আর কূলের কাছাকাছি॥
             মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
             ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।
 ঝড়কে আমি করব মিতে,    ডরব না তার ভ্রূকুটিতে—
             দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি॥

৫৫৪ :: আমি যখন ছিলেম অন্ধ

                 আমি    যখন ছিলেম অন্ধ
       সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাই নি তো আনন্দ॥
 খেলাঘরের দেয়াল গেঁথে    খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
       ভিত ভেঙে যেই এল ঘরে ঘুচল আমার বন্ধ।
       সুখের খেলা আর রোচে না, পেয়েছি আনন্দ॥
 ভীষণ আমার, রুদ্র আমার,   নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার—
       উগ্র ব্যথায় নূতন ক’রে বাঁধলে আমার ছন্দ।
 যে দিন তুমি অগ্নিবেশে    সব-কিছু মোর নিলে এসে
       সে দিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব।
       দুঃখসুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥

৫৫৫ :: আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন্‌ খ্যাপা সে

 আমারে    পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন্‌ খ্যাপা সে!
 ওরে,        আকাশ জুড়ে মোহন সুরে কী যে বাজে কোন্‌ বাতাসে॥
                 গেল রে,  গেল বেলা,  পাগলের  কেমন খেলা—
                 ডেকে সে  আকুল করে,  দেয় না ধরা।
 তারে         কানন গিরি খুঁজে ফিরি,   কেঁদে মরি কোন্‌ হুতাশে॥

৫৫৬ :: মন রে ওরে মন তুমি কোন্‌ সাধনার ধন

               মন রে ওরে মন,   তুমি   কোন্‌ সাধনার ধন!
             পাই নে তোমায় পাই নে, শুধু খুঁজি সারাক্ষণ॥
 রাতের তারা চোখ না বোজে—  অন্ধকারে তোমায় খোঁজে,
               দিকে দিকে বেড়ায় ডেকে দখিন-সমীরণ॥
     সাগর যেমন জাগায় ধ্বনি,   খোঁজে নিজের রতনমণি,
  তেমনি করে আকাশ ছেয়ে   অরুণ আলো যায় যে চেয়ে—
        নাম ধরে তোর বাজায় বাঁশি কোন্‌ অজানা জন॥

৫৫৭ :: কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস

 কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস—
            সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
               পাগল ওগো,   ধরায় আস॥
                     এই   অকূল সংসারে
      দুঃখ আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝঙ্কারে।
                    ঘোর   বিপদ-মাঝে
      কোন্‌ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাসো॥
                    তুমি   কাহার সন্ধানে
      সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে!
                    এমন   ব্যাকুল ক’রে
      কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস॥
                    তোমার   ভাবনা কিছু নাই—
      কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
                    তুমি   মরণ ভুলে
      কোন্‌ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস॥

৫৫৮ :: আমারে কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই আপনারে

           আমারে    কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে।
 আমার এই   মন গলিয়ে কাজ ভুলিয়ে সঙ্গে তোদের নিয়ে যা রে॥
      তোরা কোন্‌    রুপের হাটে    চলেছিস    ভবের বাটে,
              পিছিয়ে    আছি আমি    আপন ভারে—
      তোদের ওই   হাসিখুশি   দিবানিশি   দেখে মন   কেমন করে॥
      আমার এই   বাঁধা টুটে   নিয়ে যা   লুটেপুটে—
      পড়ে থাক্‌   মনের বোঝা ঘরের দ্বারে—
              যেমন ওই   এক নিমেষে   বন্যা এসে
                                ভাসিয়ে নে যায় পারাবারে॥
      এত যে    আনাগোনা    কে আছে    জানাশোনা,
                কে আছে  নাম ধ’রে মোর ডাকতে পারে?
      যদি সে    বারেক এসে   দাঁড়ায় হেসে
                          চিনতে পারি দেখে তারে॥

৫৫৯ :: আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ

 আমার এই    পথ-চাওয়াতেই   আনন্দ।
 খেলে যায়   রৌদ্র ছায়া,   বর্ষা আসে   বসন্ত॥
 কারা এই   সমুখ দিয়ে    আসে যায়   খবর নিয়ে,
 খুশি রই   আপন-মনে— বাতাস বহে   সুমন্দ॥
 সারাদিন   আঁখি মেলে   দুয়ারে   রব একা,
 শুভখন   হঠাৎ এলে   তখনি  পাব দেখা।
 ততখন   ক্ষণে ক্ষণে   হাসি গাই   আপন-মনে,
 ততখন   রহি রহি   ভেসে আসে   সুগন্ধ॥

৫৬০ :: হাওয়া লাগে গানের পালে

 হাওয়া লাগে গানের পালে—
 মাঝি আমার, বোসো হালে॥
           এবার ছাড়া পেলে বাঁচে,
           জীবনতরী ঢেউয়ে নাচে
 এই বাতাসের তালে তালে॥
    দিন গিয়েছে, এল রাতি,
      নাই কেহ মোর ঘাটের সাথি।
          কাটো বাঁধন, দাও গো ছাড়ি—
       তারার আলোয় দেব পাড়ি,
            সুর জেগেছে যাবার কালে॥

৫৬১ :: পথ দিয়ে কে যায় গো চলে

                        পথ দিয়ে কে যায় গো চলে
                                 ডাক দিয়ে সে যায়।
                       আমার   ঘরে থাকাই দায়॥
   পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে,    বাজে আমার বুকের মাঝে—
                          বাজে বেদনায়॥
           পূর্ণিমাতে সাগর হতে ছুটে এল বান,
                  আমার   লাগল প্রাণে টান।
 আপন-মনে মেলে আঁখি   আর কেন বা পড়ে থাকি
                    কিসের ভাবনায়॥

৫৬২ :: এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি

          এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি।
  কেউ বা আসে এ পারে, কেউ   পারের ঘাটে দেয় রে পাড়ি॥
          পথিকেরা বাঁশি ভ’রে   যে সুর আনে সঙ্গে ক’রে
  তাই যে আমার দিবানিশি   সকল পরান লয় রে কাড়ি॥
          কার কথা যে জানায় তারা জানি নে তা,
          হেথা হতে কী নিয়ে বা যায় রে সেথা।
 সুরের সাথে মিশিয়ে বাণী      দুই পারের এই কানাকানি,
          তাই শুনে যে উদাস হিয়া চায় রে যেতে বাসা ছাড়ি॥

৫৬৩ :: আমার আর হবে না দেরি

                    আমার   আর হবে না দেরি—
        আমি    শুনেছি ওই বাজে তোমার ভেরী॥
 তুমি কি, নাথ, দাঁড়িয়ে আছ আমার যাবার পথে?
 মনে হয় যে ক্ষণে ক্ষণে মোর বাতায়ন হতে
                    তোমায় যেন হেরি—
                             আমার   আর হবে না দেরি॥
                    আমার   স্বপন হল সারা,
         এখন    প্রাণে বীণা বাজায় ভোরের তারা।
 দেবার  মতো যা ছিল মোর নাই কিছু আর হাতে,
 তোমার আশীর্বাদের মালা নেব কেবল মাথে
                  আমার ললাট ঘেরি—
            আমার     আর হবে না দেরি॥

৫৬৪ :: পান্থ তুমি পান্থজনের সখা হে

      পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
            পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া।
       যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
             তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া॥
                      চায় না সে জন পিছন-পানে ফিরে,
                      বায় না তরী কেবল তীরে তীরে,
                      তুফান তারে ডাকে অকূল নীরে
                           যার পরানে লাগল তোমার হাওয়া॥
 পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
       পথিকচিত্তে তোমার তরী বাওয়া।
 দুয়ার খুলে সমুখ-পানে যে চাহে
       তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া।
                      বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
                      রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে,
                      যাবার লাগি মন তারি উদাসে—
                           যাওয়া সে যে তোমার পানে যাওয়া॥

৫৬৫ :: ওগো পথের সাথি নমি বারম্বার

             ওগো,   পথের সাথি, নমি বারম্বার।
             পথিকজনের লহো   লহো নমস্কার॥
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি,   ওগো দিনশেষের পতি,
              ভাঙা বাসার লহো নমস্কার॥
ওগো নব প্রভাতজ্যোতি,     ওগো চিরদিনের গতি,
              নব আশার লহো নমস্কার।
জীবনরথের হে সারথি,     আমি নিত্য পথের পথী,
        পথে  চলার  লহো   লহো   লহো  নমস্কার॥

৫৬৬ :: অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে॥

অশ্রুনদীর সুদূর পারে   ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে॥
নিজের হাতে নিজে বাঁধা    ঘরে আধা বাইরে আধা—
       এবার ভাসাই সন্ধ্যাহাওয়ায় আপনারে॥
                     কাটল বেলা হাটের দিনে
              লোকের কথার বোঝা কিনে।
কথার সে ভার নামা রে মন,   নীরব হয়ে শোন্‌ দেখি শোন্‌
       পারের হাওয়ায় গান বাজে কোন্‌ বীণার তারে॥

৫৬৭ :: পথিক হে

পথিক হে,
     ওই-যে চলে, ওই-যে চলে    সঙ্গী তোমার দলে দলে॥
     অন্যমনে থাকি কোণে,    চমক লাগে ক্ষণে ক্ষণে—
     হঠাৎ শুনি জলে স্থলে  পায়ের ধ্বনি আকাশতলে॥
     পথিক হে, পথিক হে,    যেতে যেতে পথের থেকে
                   আমায় তুমি যেয়ো ডেকে।
     যুগে যুগে বারে বারে   এসেছিলে আমার দ্বারে—
     হঠাৎ যে তাই জানিতে পাই, তোমার চলা হৃদয়তলে॥

৫৬৮ :: এবার রঙিয়ে গেল হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে

এবার রঙিয়ে গেল হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে।
আমার সকল বাণী হল মগন সাঁঝের রঙে॥
মনে লাগে দিনের পরে   পথিক এবার আসবে ঘরে,
       আমার   পূর্ণ হবে পুণ্যলগন সাঁঝের রঙে॥
অস্তাচলের সাগরকূলের এই বাতাসে
ক্ষণে ক্ষণে চক্ষে আমার তন্দ্রা আসে।
সন্ধ্যাযূথীর গন্ধভারে    পান্থ যখন আসবে দ্বারে
       আমার   আপনি হবে নিদ্রাভগন সাঁঝের রঙে॥

৫৬৯ :: হার মানালে গো ভাঙিলে অভিমান হায় হায়

হার মানালে গো, ভাঙিলে অভিমান   হায় হায়।
      ক্ষীণ হাতে জ্বালা   ম্লান দীপের থালা
                       হল খান্‌ খান্‌   হায় হায়॥
      এবার তবে জ্বালো   আপন তারার আলো,
রঙিন ছায়ার   এই গোধূলি   হোক অবসান   হায় হায়॥
                        এসো পারের সাথি—
       বইল পথের হাওয়া,   নিবল ঘরের বাতি।
       আজি বিজন বাটে,    অন্ধকারের ঘাটে
সব-হারানো নাটে   এনেছি এই গান   হায় হায়॥

৫৭০ :: আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো

           আমার    পথে পথে পাথর ছড়ানো।
           তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্না-ঝরানো॥
আমার বাঁশি তোমার হাতে   ফুটোর পরে ফুটো তাতে—
           তাই শুনি সুর এমন মধুর পরান-ভরানো॥
তোমার হাওয়া যখন জাগে     আমার পালে বাধা লাগে—
           এমন করে গায়ে প’ড়ে সাগর-তরানো।
ছাড়া পেলে একেবারে         রথ কি তোমার চলতে পারে—
           তোমার হাতে আমার ঘোড়া লাগাম-পরানো॥

৫৭১ :: তুমি হঠাৎ-হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন

          তুমি   হঠাৎ-হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন—
          তাই   হঠাৎ-পাওয়ায় চমকে ওঠে মন॥
গোপন পথে আপন-মনে    বাহির হও যে কোন্‌ লগনে,
              হঠাৎ-গন্ধে মাতাও সমীরণ॥
নিত্য যেথায় আনাগোনা      হয় না সেথায় চেনাশোনা,
              উড়িয়ে ধুলো আসছে কতই জন।
কখন পথের বাহির থেকে    হঠাৎ বাঁশি যায় যে ডেকে,
              পথহারাকে করে সচেতন॥

৫৭২ :: পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোন্‌খানে

         পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোন্‌খানে
              তোমার পরশ আসে কখন কে জানে॥
 কী অচেনা কুসুমের গন্ধে,   কী গোপন আপন আনন্দে,
              কোন্‌ পথিকের কোন্‌ গানে॥
 সহসা দারুণ দুখতাপে   সকল ভুবন যবে কাঁপে,
         সকল পথের ঘোচে চিহ্ন  সকল বাঁধন যবে ছিন্ন
                        মৃত্যু-আঘাত লাগে প্রাণে—
              তোমার পরশ আসে কখন কে জানে॥

৫৭৩ :: আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন

আমার      ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়   পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন!
       তারি গলার মালা হতে   পাপড়ি হোথা লুটায় ছিন্ন॥
       এল যখন সাড়াটি নাই,   গেল চলে জানালো তাই—
       এমন ক’রে আমারে হায়   কে বা কাঁদায় সে জন ভিন্ন॥
   তখন    তরুণ ছিল অরুণ আলো,  পথটি ছিল কুসুমকীর্ণ।
           বসন্ত যে রঙিন বেশে   ধরায় সে দিন অবতীর্ণ।
       সে দিন খবর মিলল না যে, রইনু বসে ঘরের মাঝে—
          আজকে পথে বাহির হব    বহি আমার জীবন জীর্ণ॥

৫৭৪ :: পাতার ভেলা ভাসাই নীরে

                 পাতার ভেলা ভাসাই নীরে,
                 পিছন-পানে চাই নে ফিরে॥
কর্ম আমার বোঝাই ফেলা,   খেলা আমার চলার খেলা।
হয় নি আমার আসন মেলা,    ঘর বাঁধি নি স্রোতের তীরে॥
                 বাঁধন যখন বাঁধতে আসে
                 ভাগ্য আমার তখন হাসে॥
ধুলা-ওড়া হাওয়ার ডাকে   পথ যে টেনে লয় আমাকে—
নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে গান দিয়ে যাই ধরিত্রীরে॥

৫৭৫ :: আমাদের খেপিয়ে বেড়ায় যে কোথায় লুকিয়ে থাকে রে

আমাদের   খেপিয়ে বেড়ায় যে     কোথায়   লুকিয়ে থাকে রে?।
ছুটল বেগে ফাগুন-হাওয়া      কোন্‌ খ্যাপামির নেশায় পাওয়া,
                 ঘূর্ণা হাওয়ায় ঘুরিয়ে দিল সূর্যতারাকে॥
              কোন্‌ খ্যাপামির তালে নাচে পাগল সাগর-নীর।
                 সেই তালে যে পা ফেলে যাই, রইতে নারি স্থির।
চল্‌ রে সোজা, ফেল্‌ রে বোঝা,     রেখে দে তোর রাস্তা-খোঁজা,
                 চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা জেগেছে॥

৫৭৬ :: চলি গো চলি গো যাই গো চলে

             চলি গো, চলি গো, যাই গো চলে।
             পথের প্রদীপ জ্বলে গো গগনতলে॥
বাজিয়ে চলি পথের বাঁশি,    ছড়িয়ে চলি চলার হাসি,
             রঙিন বসন উড়িয়ে চলি জলে স্থলে॥
             পথিক ভুবন ভালোবাসে পথিকজনে রে।
             এমন সুরে তাই সে ডাকে ক্ষণে ক্ষণে রে।
চলার পথের আগে আগে   ঋতুর ঋতুর সোহাগ জাগে,
             চরণ-ঘায়ে মরণ মরে পলে পলে॥

৫৭৭ :: এখন আমার সময় হল

                 এখন আমার সময় হল,
              যাবার দুয়ার খোলো খোলো॥
হল দেখা, হল মেলা,    আলোছায়ায় হল খেলা—
              স্বপন যে সে ভোলো ভোলো॥
                 আকাশ ভরে দূরের গানে,
                 অলখ দেশে হৃদয় টানে।
ওগো সুদূর, ওগো মধুর,   পথ বলে দাও পরানবঁধুর—
                সব আবরণ তোলো তোলো॥

৫৭৮ :: ওরে পথিক ওরে প্রেমিক

           ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক,
     বিচ্ছেদে তোর খণ্ড মিলন পূর্ণ হবে।
                     আয় রে সবে
              প্রলয়গানের মহোৎসবে॥
     তাণ্ডবে ওই তপ্ত হাওয়ায় ঘূর্ণি লাগায়,
মত্ত ঈশান বাজায় বিষাণ, শঙ্কা জাগায়—
     ঝঙ্কারিয়া উঠল আকাশ   ঝঞ্ঝারবে॥
ভাঙন-ধরার ছিন্ন-করার রুদ্র নাটে
যখন সকল ছন্দ বিকল, বন্ধ কাটে,
মুক্তিপাগল বৈরাগীদের চিত্ততলে
     প্রেমসাধনার হোমহুতাশন জ্বলবে তবে।
             ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক,
     সব আশাজাল যায় রে যখন উড়ে পুড়ে
     আশার অতীত দাঁড়ায় তখন ভুবন জুড়ে—
             স্তব্ধ বাণী নীরব সুরে কথা কবে।
                     আয় রে সবে
             প্রলয়গানের মহোৎসবে॥

৫৭৯ :: মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার মোর করুণ রঙিন পথ

মোর     পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার   মোর   করুণ রঙিন পথ!
            এসেছে এসেছে আহা অঙ্গনে এসেছে, মোর   দুয়ারে লেগেছে রথ॥
সে যে    সাগরপারের বাণী   মোর   পরানে দিয়েছে আনি, আহা
তার       আঁখির তারায় যেন গান গায় অরণ্যপর্বত॥
             দুঃখসুখের এ পারে, ও পারে, দোলায় আমার মন—
             কেন অকারণ অশ্রুসলিলে ভরে যায় দু’নয়ন।
ওগো     নিদারুণ পথ, জানি—জানি  পুন নিয়ে যাবে টানি, আহা,   তারে—
             চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া যাবে সে স্বপনবৎ॥

৫৮০ :: ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করি খেলা

         ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী,   একা একা করি খেলা—
         আন্‌মনা যেন দিক্‌বালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা॥
যেমন হেলায় অলস ছন্দে         কোন্‌ খেয়ালির কোন্‌ আনন্দে
         সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা॥
         যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে,
         তার হাতে দিই আমার ছন্দ—  কোথা যায় কে জানে সে।
লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায়      জেনো জেনো মোর সকলই হারায়,
         চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা॥

৫৮১ :: না রে না রে হবে না তোর স্বর্গসাধন

         না রে, না রে,            হবে না তোর স্বর্গসাধন—
সেখানে যে মধুর বেশে ফাঁদ পেতে রয় সুখের বাঁধন॥
ভেবেছিলি দিনের শেষে  তপ্ত পথের প্রান্তে এসে
সোনার মেঘে মিলিয়ে যাবে সারা দিনের সকল কাঁদন॥
         না রে, না রে,            হবে না তোর, হবে না তা—
সন্ধ্যাতারার হাসির নীচে হবে না তোর শয়ন পাতা।
পথিক বঁধু পাগল ক’রে    পথে বাহির করবে তোরে—
হৃদয় যে তোর ফেটে গিয়ে ফুটবে তবে তাঁর আরাধন॥

৫৮২ :: আপনি আমার কোন্‌খানে

                   আপনি আমার কোন্‌খানে
                     বেড়াই তারি সন্ধানে॥
নানান রূপে নানান বেশে   ফেরে যেজন ছায়ার দেশে
তার পরিচয় কেঁদে হেসে শেষ হবে কি, কে জানে॥
     আমার গানের গহন-মাঝে শুনেছিলেম যার ভাষা
                  খুঁজে না পাই তার বাসা।
বেলা কখন যায় গো বয়ে,  আলো আসে মলিন হয়ে—
পথের বাঁশি যায় কী কয়ে বিকালবেলার মূলতানে॥

৫৮৩ :: পথ এখনো শেষ হল না মিলিয়ে এল দিনের ভাতি

পথ এখনো শেষ হল না, মিলিয়ে এল দিনের ভাতি।
       তোমার আমার মাঝখানে হায়   আসবে কখন আঁধার রাতি॥
              এবার তোমার শিখা আনি
                     জ্বালাও আমার প্রদীপখানি,
       আলোয় আলোয় মিলন হবে পথের মাঝে পথের সাথি॥
ভালো করে মুখ যে তোমার যায় না দেখা সুন্দর হে—
       দীর্ঘ পথের দারুণ গ্লানি তাই তো আমায় জড়িয়ে রহে।
               ছায়ায়-ফেরা ধুলায়-চলা
                      মনের কথা যায় না বলা,
        শেষ কথাটি জ্বালবে এবার তোমার বাতি আমার বাতি॥

৫৮৪ :: যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে

যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,
দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে॥
       যাবার বেলা সহজেরে
             যাই যেন মোর প্রণাম সেরে,
                   সকল পন্থা যেথায় মেলে সেথা দাঁড়াই এসে॥
খুঁজতে যারে হয় না কোথাও চোখ যেন তায় দেখে,
সদাই যে রয় কাছে তারি পরশ যেন ঠেকে।
       নিত্য যাহার থাকি কোলে
              তারেই যেন যাই গো ব’লে—
                   এই জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে॥

৫৮৫ :: জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি হে নমি নমি

জয় জয়   পরমা নিষ্কৃতি হে, নমি নমি।
জয় জয়   পরমা নির‍্‍বৃতি হে, নমি নমি॥
                 নমি নমি তোমারে হে অকস্মাৎ,
                 গ্রন্থিচ্ছেদন খরসংঘাত—
                 লুপ্তি, সুপ্তি, বিস্মৃতি হে, নমি নমি॥
                 অশ্রুশ্রাবণপ্লাবন হে, নমি নমি।
                 পাপক্ষালন পাবন হে, নমি নমি॥
                 সব ভয় ভ্রম ভাবনার
                 চরমা আবৃতি হে, নমি নমি॥

৫৮৬ :: আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে

                আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে।
     বলে শুধু, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে॥
                আমি যে তোর আলোর ছেলে,
আমার      সামনে দিলি আঁধার মেলে,
                      মুখ লুকালি— মরি আমি সেই খেদে॥
        অন্ধকারে অস্তরবির লিপি লেখা,
                      আমারে তার অর্থ শেখা।
        তোর    প্রাণের বাঁশির তান সে নানা
                      সেই আমারই ছিল জানা,
                আজ   মরণ-বীণার অজানা সুর নেব সেধে॥

৫৮৭ :: মরণের মুখে রেখে দূরে যাও দূরে যাও চলে

মরণের মুখে রেখে দূরে যাও দূরে   যাও চলে
আবার ব্যথার টানে নিকটে ফিরাবে ব’লে॥
             আঁধার-আলোর পারে    খেয়া দিই বারে বারে,
             নিজেরে হারায়ে খুঁজি— দুলি সেই দোলে দোলে॥
সকল রাগিণী বুঝি বাজাবে আমার প্রাণে—
কভু ভয়ে কভু জয়ে, কভু অপমানে মানে।
             বিরহে ভরিবে সুরে    তাই রেখে দাও দূরে,
             মিলনে বাজিবে বাঁশি    তাই টেনে আন কোলে॥

৫৮৮ :: রজনীর শেষ তারা গোপনে আঁধারে আধো-ঘুমে

      রজনীর শেষ তারা, গোপনে আঁধারে আধো-ঘুমে
বাণী তব রেখে যাও প্রভাতের প্রথম কুসুমে॥
       সেইমত যিনি এই জীবনের আনন্দরূপিণী
শেষক্ষণে দেন যেন তিনি    নবজীবনের মুখ চুমে॥
            এই নিশীথের স্বপ্নরাজি
        নবজাগরণক্ষণে নব গানে উঠে যেন বাজি।
     বিরহিণী যে ছিল রে মোর হৃদয়ের মর্ম-মাঝে
   বধূবেশে সেই যেন সাজে  নবদিনে চন্দনে কুঙ্কুমে॥

৫৮৯ :: কোন্‌ খেলা যে খেলব কখন ভাবি বসে সেই কথাটাই

                   কোন্‌ খেলা যে খেলব কখন ভাবি বসে সেই কথাটাই—
তোমার        আপন খেলার সাথি করো, তা হলে আর ভাবনা তো নাই॥
                   শিশির-ভেজা সকালবেলা আজ কি তোমার ছুটির খেলা—
                   বর্ষণহীন মেঘের মেলা তার সনে মোর মনকে ভাসাই॥
তোমার        নিঠুর খেলা খেলবে যে দিন বাজবে সে দিন ভীষণ ভেরী—
                   ঘনাবে মেঘ, আঁধার হবে, কাঁদবে হাওয়া আকাশ ঘেরি।
                   সে দিন যেন তোমার ডাকে  ঘরের বাঁধন আর না থাকে—
                   অকাতরে পরানটাকে প্রলয়দোলায় দোলাতে চাই॥

৫৯০ :: অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে

               অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে?
         অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে॥
জানি জানি আমার চেনা    কোনো কালেই ফুরাবে না,
               চিহ্নহারা পথে আমায় টানবে অচিন ডোরে॥
         ছিল আমার মা অচেনা, নিল আমায় কোলে।
         সকল প্রেমই অচেনা গো, তাই তো হৃদয় দোলে।
অচেনা এই ভুবন-মাঝে   কত সুরেই হৃদয় বাজে—
             অচেনা এই জীবন আমার,
                   বেড়াই তারি ঘোরে॥

৫৯১ :: আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে

আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে
        দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো এই সাগরের তীরে॥
আবার জলে ভাসাই ভেলা,  ধুলার ’পরে করি খেলা গো,
                হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়ননীরে॥
কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,
        আঘাত খেয়ে বাঁচি নাহয় আঘাত খেয়ে মরি।
আবার তুমি ছদ্মবেশে   আমার সাথে খেলাও হেসে গো,
               নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে॥

৫৯২ :: পুষ্প দিয়ে মারো যারে চিনল না সে মরণকে

পুষ্প দিয়ে মারো যারে চিনল না সে মরণকে।
বাণ খেয়ে যে পড়ে সে যে ধরে তোমার চরণকে॥
     সবার নিচে ধুলার ’পরে    ফেলো যারে মৃত্যুশরে
     সে যে তোমার কোলে পড়ে, ভয় কি বা তার পড়নকে?।
           আরামে যার আঘাত ঢাকা, কলঙ্ক যার সুগন্ধ,
           নয়ন মেলে দেখল না সে রুদ্র মুখের আনন্দ।
     মজল না সে চোখের জলে,  পৌঁছল না চরণতলে,
     তিলে তিলে পলে পলে ম’ল যেজন পালঙ্কে॥

৫৯৩ :: মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’ রাত বলেছে ‘যাই’

     মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’, রাত বলেছে ‘যাই’,
           সাগর বলে ‘কূল মিলেছে—আমি তো আর নাই’॥
              দুঃখ বলে ‘রইনু চুপে  তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে’,
                 আমি বলে ‘মিলাই আমি আর কিছু না চাই’॥
ভুবন বলে ‘তোমার তরে আছে বরণমালা’,
        গগন বলে ‘তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা’।
            প্রেম বলে যে ‘যুগে যুগে   তোমার লাগি আছি জেগে’,
                  মরণ বলে ‘আমি তোমার জীবনতরী বাই’॥

৫৯৪ :: জানি গো দিন যাবে এ দিন যাবে

                জানি গো, দিন যাবে এ দিন যাবে।
         একদা কোন্‌ বেলাশেষে    মলিন রবি করুণ হেসে
            শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে॥
         পথের ধারে বাজবে বেণু,   নদীর কূলে চরবে ধেনু,
            আঙিনাতে খেলবে শিশু, পাখিরা গান গাবে—
               তবুও দিন যাবে এ দিন যাবে॥
         তোমার কাছে আমার এ মিনতি
যাবার আগে জানি যেন   আমায় ডেকেছিল কেন
      আকাশ-পানে নয়ন তুলে শ্যামল বসুমতী
কেন নিশার নীরবতা    শুনিয়েছিল তারার কথা,
        পরানে ঢেউ তুলেছিল কেন দিনের জ্যোতি—
             তোমার কাছে আমার এই মিনতি॥
                  সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা
     যেন আমার গানের শেষে    থামতে পারি শমে এসে—
             ছয়টি ঋতুর ফুলে ফলে ভরতে পারি ডালা।
  এই জীবনের আলোকেতে   পারি তোমায় দেখে যেতে,
          পরিয়ে যেতে পারি তোমায় আমার গলার মালা—
                সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা॥

৫৯৫ :: অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়

অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।
     কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে ‘হায় হায়’॥
         নদীতটসম কেবলই বৃথাই    প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই,
             একে একে বুকে আঘাত করিয়া ঢেউগুলি কোথা ধায়॥
যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে   সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে
      তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহা মহিমায়।
         তোমাতে রয়েছে কত শশী ভানু,   হারায় না কভু অণু পরমাণু,
             আমারই ক্ষুদ্র হারাধনগুলি রবে না কি তব পায়॥

৫৯৬ :: তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই

তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই—
    কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই॥
        মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ,   দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,
            তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই॥
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে   যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে—
    নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
        অন্তরগ্লানি সংসারভার    পলক ফেলিতে কোথা একাকার
            জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই॥

৫৯৭ :: আমি আছি তোমার সভার দুয়ার-দেশে

    আমি আছি তোমার সভার দুয়ার-দেশে,
           সময় হলেই বিদায় নেব কেঁদে হেসে॥
মালায় গেঁথে যে ফুলগুলি    দিয়েছিলে মাথায় তুলি
     পাপড়ি তাহার পড়বে ঝরে দিনের শেষে॥
          উচ্চ আসন না যদি রয় নামব নীচে,
     ছোটো ছোটো গানগুলি এই ছড়িয়ে পিছে।
কিছু তো তার রইবে বাকি   তোমার পথের ধুলা ঢাকি,
     সবগুলি কি সন্ধ্যা-হাওয়ায় যাবে ভেসে?।

৫৯৮ :: পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই

            পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহো ভাই—
            সবারে আমি প্রণাম করে যাই॥
ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি,     রাখি না আর ঘরের দাবি—
            সবার আজি প্রসাদবাণী চাই॥
            অনেক দিন ছিলাম প্রতিবেশী,
            দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।
প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি,     নিবিয়া গেল কোণের বাতি—
            পড়েছে ডাক, চলেছি আমি তাই॥

৫৯৯ :: আমার যাবার বেলাতে

              আমার    যাবার বেলাতে
         সবাই     জয়ধ্বনি কর্।
              ভোরের আকাশ রাঙা হল রে,
         আমার     পথ হল সুন্দর॥
কী নিয়ে বা যাব সেথা     ওগো তোরা ভাবিস নে তা,
             শূন্য হাতেই চলব বহিয়ে
      আমার     ব্যাকুল অন্তর॥
             মালা প’রে যাব মিলনবেশে,
      আমার    পথিকসজ্জা নয়।
             বাধা বিপদ আছে মাঝের দেশে,
      মনে     রাখি নে সেই ভয়।
যাত্রা যখন হবে সারা    উঠবে জ্বলে সন্ধ্যাতারা,
             পুরবীতে করুণ বাঁশরি
       দ্বারে     বাজবে মধুর স্বর॥

৬০০ :: আঁধার এল ব’লে

              আঁধার এল ব’লে
     তাই তো ঘরে উঠল আলো জ্বলে॥
              ভুলেছিলেম দিনে,    রাতে নিলেম চিনে—
          জেনেছি কার লীলা আমার বক্ষোদোলার দোলে॥
     ঘুমহারা মোর বনে
বিহঙ্গগান জাগল ক্ষণে ক্ষণে।
                   যখন সকল শব্দ    হয়েছে নিস্তব্ধ
           বসন্তবায় মোরে জাগায় পল্লবকল্লোলে॥

৬০১ :: দিন যদি হল অবসান

                   দিন যদি হল অবসান
          নিখিলের অন্তরমন্দিরপ্রাঙ্গণে
                   ওই তব এল আহ্বান॥
চেয়ে দেখো মঙ্গলরাতি   জ্বালি দিল উৎসববাতি,
       স্তব্ধ এ সংসারপ্রান্তে    ধরো    ধরো তব বন্দনগান॥
              কর্মের-কলরব-ক্লান্ত,
                  করো তব অন্তর শান্ত।
    চিত্ত-আসন দাও মেলে,   নাই যদি দর্শন পেলে
         আঁধারে মিলিবে তাঁর স্পর্শ—
              হর্ষে জাগায়ে দিবে প্রাণ॥

৬০২ :: তোমার হাতের অরুণলেখা পাবার লাগি রাতারাতি

তোমার হাতের অরুণলেখা পাবার লাগি রাতারাতি
স্তব্ধ আকাশ জাগে একা পুবের পানে বক্ষ পাতি॥
          তোমার রঙিন তুলির পাকে    নামাবলীর আঁকন আঁকে,
          তাই নিয়ে তো ফুলের বনে হাওয়ায় হাওয়ায় মাতামাতি॥
এই কামনা রইল মনে— গোপনে আজ তোমায় কব
পড়বে আঁকা মোর জীবনে রেখায় রেখায় আখর তব।
      দিনের শেষে আমায় যবে     বিদায় নিয়ে যেতেই হবে
           তোমার হাতের লিখনমালা
                সুরের সুতোয় যাব গাঁথি॥

৬০৩ :: দিনের বেলায় বাঁশি তোমার বাজিয়েছিলে অনেক সুরে

দিনের বেলায় বাঁশি তোমার বাজিয়েছিলে অনেক সুরে—
গানের পরশ প্রাণে এল, আপনি তুমি রইলে দূরে॥
         শুধাই যত পথের লোকে  ‘এই বাঁশিটি বাজালো কে’—
         নানান নামে ভোলায় তারা, নানান দ্বারে বেড়াই ঘুরে॥
এখন আকাশ ম্লান হল, ক্লান্ত দিবা চক্ষু বোজে—
পথে পথে ফেরাও যদি মরব তবে মিথ্যা খোঁজে।
         বাহির ছেড়ে ভিতরেতে    আপনি লহো আসন পেতে—
               তোমার বাঁশি বাজাও আসি
                     আমার প্রাণের অন্তঃপুরে॥

৬০৪ :: মধুর তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ

মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ—
       ভুবন জুড়ে রইল জেগে আনন্দ-আবেশ॥
            দিনান্তের এই এক কোণাতে   সন্ধ্যামেঘের শেষ সোনাতে
                  মন যে আমার গুঞ্জরিছে কোথায় নিরুদ্দেশ॥
সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার ’পরে
       অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে।
            এই গোধূলির ধূসরিমায়  শ্যামল ধরার সীমায় সীমায়
                  শুনি বনে বনান্তরে অসীম গানের রেশ॥

৬০৫ :: দিন অবসান হল

                        দিন অবসান হল।
আমার    আঁখি হতে অস্তরবির আলোর আড়াল তোলো॥
অন্ধকারের বুকের কাছে    নিত্য-আলোর আসন আছে,
                সেথায় তোমার  দুয়ারখানি খোলো॥
সব কথা সব কথার শেষে   এক হয়ে যাক মিলিয়ে এসে।
স্তব্ধ বাণীর হৃদয়-মাঝে   গভীর বাণী আপনি বাজে,
                সেই বাণীটি আমার কানে বোলো॥

৬০৬ :: শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে

শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
     আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে॥
          সাঙ্গ হলে মেঘের পালা   শুরু হবে বৃষ্টি-ঢালা,
                বরফ-জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে॥
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে,
       অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
           পুরাতনের হৃদয় টুটে    আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
                জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে॥

৬০৭ :: রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি

রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি,
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী॥
       সময় যেন হয় রে এবার    ঢেউ-খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার,
              সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে অমর হয়ে রব মরি॥
যে গান কানে যায় না শোনা সে গান যথায় নিত্য বাজে
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভা-মাঝে॥
       চিরদিনের সুরটি বেঁধে   শেষ গানে তার কান্না কেঁদে
              নীরব যিনি তাঁহার পায়ে নীরব বীণা দিব ধরি॥

৬০৮ :: কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়

কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?
                জয় অজানার জয়।
এই দিকে তোর ভরসা যত, ওই দিকে তোর ভয়!
                জয় অজানার জয়॥
জানাশোনার বাসা বেঁধে    কাটল তো দিন হেসে কেঁদে,
        এই কোণেতেই আনাগোনা নয় কিছুতেই নয়।
                জয় অজানার জয়॥
        মরণকে তুই পর করেছিস ভাই,
                জীবন যে তোর তুচ্ছ হল তাই।
দু দিন দিয়ে ঘেরা ঘরে     তাইতে যদি এতই ধরে,
        চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?
                জয় অজানার জয়॥

৬০৯ :: জয় ভৈরব জয় শঙ্কর

         জয় ভৈরব, জয় শঙ্কর!
জয়   জয় জয় প্রলয়ঙ্কর,  শঙ্কর শঙ্কর॥
জয় সংশয়ভেদন,  জয় বন্ধনছেদন,
         জয় সঙ্কটসংহর  শঙ্কর শঙ্কর॥
তিমিরহৃদ্‌‍বিদারণ    জ্বলদগ্নিনিদারুণ,
মরুশ্মশানসঞ্চর   শঙ্কর শঙ্কর!
বজ্রঘোষবাণী,  রুদ্র, শূলপাণি,
         মৃত্যুসিন্ধুসন্তর  শঙ্কর শঙ্কর॥

৬১০ :: আগুনে হল আগুনময়

                 আগুনে    হল আগুনময়।
                    জয় আগুনের জয়॥
মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে    এইবেলা সব যাক-না-পুড়ে,
         মরণ-মাঝে তোর জীবনের হোক রে পরিচয়॥
              আগুন এবার চলল রে সন্ধানে
              কলঙ্ক তোর লুকিয়ে আছে প্রাণে।
আড়াল তোমার যাক রে ঘুচে,    লজ্জা তোমার যাক রে মুছে,
         চিরদিনের মতো তোমার ছাই হয়ে যাক ভয়॥

৬১১ :: ওরে আগুন আমার ভাই

            ওরে,    আগুন আমার ভাই,
               আমি    তোমারই জয় গাই।
      তোমার ওই    শিকল-ভাঙা এমন রাঙা মূর্তি দেখি নাই॥
তুমি   দু হাত তুলে আকাশ-পানে   মেতেছ আজ কিসের গানে,
         একি    আনন্দময় নৃত্য অভয় বলিহারি যাই॥
যেদিন    ভবের মেয়াদ ফুরোবে ভাই, আগল যাবে সরে—
সে দিন    হাতের দড়ি, পায়ের বেড়ি, দিবি রে ছাই করে।
সে দিন   আমার অঙ্গ তোমার অঙ্গে     ওই নাচনে নাচবে রঙ্গে—
                সকল দাহ মিটবে দাহে, ঘুচবে সব বালাই॥

৬১২ :: দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন

           দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন—
পার আছে রে এই সাগরের বিপুল ক্রন্দন॥
            এই জীবনের ব্যথা যত    এইখানে সব হবে গত,
                  চিরপ্রাণের আলয়-মাঝে অনন্ত সান্ত্বন॥
         মরণ যে তোর নয় রে চিরন্তন—
দুয়ার তাহার পেরিয়ে যাবি, ছিঁড়বে রে বন্ধন।
            এ বেলা তোর যদি ঝড়ে   পূজার কুসুম ঝ’রে পড়ে,
                  যাবার বেলায় ভরবে থালায় মালা ও চন্দন॥

৬১৩ :: মরণসাগরপারে তোমরা অমর

      মরণসাগরপারে তোমরা অমর,
                 তোমাদের স্মরি।
      নিখিলে রচিয়া গেলে আপনারই ঘর,
                 তোমাদের স্মরি॥
সংসারে জ্বেলে গেলে যে নব আলোক
      জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক—
                 তোমাদের স্মরি॥
         বন্দীরে দিয়ে গেছ মুক্তির সুধা,
                 তোমাদের স্মরি।
         সত্যের বরমালে সাজালে বসুধা,
                 তোমাদের স্মরি।
রেখে গেলে বাণী সে যে অভয় অশোক,
         জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক—
                 তোমাদের স্মরি॥

৬১৪ :: যেতে যদি হয় হবে

                    যেতে যদি হয় হবে—
                    যাব, যাব, যাব তবে॥
লেগেছিল কত ভালো    এই-যে আঁধার আলো—
          খেলা করে সাদা কালো উদার নভে।
গেল দিন ধরা-মাঝে    কত ভাবে, কত কাজে,
          সুখে দুখে কভু লাজে, কভু গরবে॥
                প্রাণপণে কত দিন  শুধেছি কঠিন ঋণ,
                      কখনো বা উদাসীন ভুলেছি সবে।
কভু ক’রে গেনু খেলা,    স্রোতে ভাসাইনু ভেলা,
          আনমনে কত বেলা কাটানু ভবে॥
                জীবন হয় নি ফাঁকি,  ফলে ফুলে ছিল ঢাকি,
                      যদি কিছু রহে বাকি কে তাহা লবে!
দেওয়া-নেওয়া যাবে চুকে,  বোঝা-খসে-যাওয়া বুকে
           যাব চলে হাসিমুখে— যাব নীরবে॥

৬১৫ :: পথের শেষ কোথায় শেষ কোথায় কী আছে শেষে

পথের   শেষ কোথায়, শেষ কোথায়,    কী আছে শেষে!
         এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে?।
              ঢেউ ওঠে পড়ে কাঁদার,    সম্মুখে ঘন আঁধার,
পার আছে গো পার আছে— পার আছে কোন্‌ দেশে?।
         আজ ভাবি মনে মনে,     মরীচিকা-অন্বেষণে    হায়
বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই।      মনে ভয় লাগে সেই—
          হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে॥

৬১৬ :: যাত্রাবেলায় রুদ্র রবে বন্ধনডোর ছিন্ন হবে

         যাত্রাবেলায় রুদ্র রবে     বন্ধনডোর ছিন্ন হবে।
                          ছিন্ন হবে, ছিন্ন হবে॥
মুক্ত আমি, রুদ্ধদ্বারে    বন্দী করে কে আমারে!
       যাই চলে যাই অন্ধকারে   ঘণ্টা বাজায় সন্ধ্যা যবে॥

৬১৭ :: আজকে মোরে বোলো না কাজ করতে

        আজকে মোরে বোলো না কাজ করতে,
যাব আমি দেখাশোনার নেপথ্যে আজ সরতে
                     ক্ষণিক মরণ মরতে॥
অচিন কূলে পাড়ি দেব,  আলোকলোকে জন্ম নেব,
         মরণরসে অলখঝোরায় প্রাণের কলস ভরতে॥
                     অনেক কালের কান্নাহাসির ছায়া
                     ধরুক সাঁঝের রঙিন মেঘের মায়া।
আজকে নাহয় একটি বেলা    ছাড়ব মাটির দেহের খেলা,
                    গানের দেশে যাব উড়ে সুরের দেহ ধরতে॥